নিউমোকক্কাস। শব্দটা যেমন খটমটে, এর কাজটাও ভয়ংকর ও জীবনসংহারী। নিউমোকক্কাস হলো নিউমোনিয়া ও মেনিনজাইটিস রোগের জীবাণু। এর আবার ৯০টিরও বেশি রকমফের রয়েছে। দেশে দেশে ভিন্ন ভিন্ন ধরনের জীবাণু এই দুই রোগের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। বাংলাদেশে কোন কোন ধরনের নিউমোকক্কাস নিউমোনিয়া ও মেনিনজাইটিসের কারণ তা বিশ বছরের গবেষণায় ধরা পড়ল অণুবীক্ষণযন্ত্রের নিচে। আর সেই গবেষণাগারটি ঢাকা শিশু হাসপাতালে। বাংলাদেশের অণুজীববিজ্ঞানীরা জানান দিলেন যে বাংলাদেশে কোন কোন ধরনের নিউমোকক্কাস রয়েছে। বাংলদেশে এই অণুজীববিজ্ঞানীদের নেতৃত্বে ছিলেন সমীর কে সাহা।
অণুজীববিজ্ঞানী সমীর সাহার কয়েক দশক ধরে গবেষণা, শিশুদের প্রাণসংহারী রোগের জীবাণু নিয়ে। সম্প্রতি দারুণ এক স্বীকৃতি পেয়েছেন এই বিজ্ঞানী। অণুজীববিজ্ঞানীদের সবচেয়ে মর্যাদাপূর্ণ সংগঠন আমেরিকান সোসাইটি অব মাইক্রোবায়োলজি চলতি বছর পুরস্কারের জন্য নির্বাচিত করেছে সমীর সাহাকে। ক্লিনিক্যাল মাইক্রোবায়োলজি বিষয়ে গবেষণার জন্য এই পুরস্কার পেয়েছেন তিনি। ১৯৭৮ সাল থেকে দেওয়া হচ্ছে এ পুরস্কার। তালিকায় চোখ বুলিয়ে দেখা গেল, ২৯ বছরের পুরস্কারপ্রাপ্তদের মধ্যে এই উপমহাদেশ তো বটেই, এশিয়ার কোনো দেশের বিজ্ঞানীর নামও নেই। যুক্তরাষ্ট্র আর কানাডার বাইরে এই পুরস্কার আগে দেওয়া হয়নি। মাসখানেক আগে পুরস্কারপ্রাপ্তির আনুষ্ঠানিক চিঠি পেয়েছেন বলে জানালেন তিনি। আগামী ৩ জুন যুক্তরাষ্ট্রের নিউ অরলিয়ন্সে অণুজীববিজ্ঞানের অন্যান্য শাখায় পুরস্কার পাওয়া অন্য বিজ্ঞানীদের সঙ্গে আমেরিকান সোসাইটি ফর মাইক্রোবায়োলজির সভাপতির হাত থেকে পুরস্কার গ্রহণ করবেন সমীর সাহা।
পুরস্কার হিসেবে কী পাচ্ছেন? ‘অণুজীববিজ্ঞানীদের জন্য এটা পৃথিবীর সবচেয়ে বড় স্বীকৃতি। বিজয়ীদের “লরিয়েট” সম্বোধন করা হয়। পুরস্কার দেওয়ার অনুষ্ঠানে পৃথিবীর বিখ্যাত অণুজীববিজ্ঞানীরা উপস্থিত থাকবেন।’ পুরস্কার হিসেবে বিজয়ী বিজ্ঞানীরা পাবেন পদক এবং নিজেদের কাজ সম্পর্কে এক ঘণ্টার একটা উপস্থাপনা দেওয়ার সুযোগ। আমেরিকান সোসাইটি অব মাইক্রোবায়োলজির ওয়েবসাইট থেকে জানা গেল, এই পুরস্কারের জন্য মনোনীত বিজ্ঞানীদের শেষ তিন বছরের কাজ বিবেচনায় নেওয়া হয় না। ‘মানে হলো অণুজীববিজ্ঞানে বিজ্ঞানীর দীর্ঘমেয়াদি গবেষণাকাজকে মূল্যায়ন করে পুরস্কারের জন্য নির্বাচিত করা হয়।’ বললেন সমীর সাহা।
ঢাকা শিশু হাসপাতালের প্রধান ফটক পেরিয়ে হাসপাতাল অংশে ঢুকতেই হাতের ডানে পড়বে সমীর সাহার কর্মক্ষেত্র। তিনি এখানকার বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব চাইল্ড হেলথের অণুজীববিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক এবং প্রধান। চাইল্ড হেলথ রিসার্চ ফাউন্ডেশনের তিনি নির্বাহী পরিচালক। গবেষণাগারে ঢুকতেই দেখা গেল একেক কক্ষে একেক ধরনের কাজ চলছে। সমীর সাহা বললেন, ‘জানেন, প্রায় শূন্য থেকে কাজটা শুরু হয়েছিল। যখন যোগ দিলাম, তখন একটা মাত্র ঘর ছিল। এখন পরিসর বেড়েছে, জীবাণু নিয়ে গবেষণা বা জীবাণু শনাক্ত করার অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতি যোগ হয়েছে। কম্পিউটারে জীবাণুর তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ ও সংরক্ষণের সুবিধাও পাচ্ছি। ভারতের একটি গবেষণাগারের তথ্য-উপাত্ত আমরা পর্যবেক্ষণ করি। এ ছাড়া বিভিন্ন দেশের গবেষণাগারের তথ্যভান্ডার আমরা যেমন ব্যবহার করতে পারি, তেমনি তাঁরাও পারেন আমাদের তথ্য-উপাত্ত ব্যবহার করতে।’
নিউমোনিয়া, মেনিনজাইটিস আর টাইফয়েডের জীবাণু নিয়ে মূলত কাজ করছেন সমীর সাহা। এসব রোগের জীবাণু শনাক্ত করে, সেই জীবাণুর জন্য কেমন ভ্যাকসিন বা টিকা দরকার তা যেমন বলে দেওয়া যায়, তেমনি নতুন কোনো ভ্যাকসিন এলে তা আমাদের দেশের শিশুদের জন্য উপকারী কি না, তা-ও পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হয় এই গবেষণাগারে। শিশু হাসপাতালের গবেষণাগারের পাশাপাশি টাঙ্গাইলের মির্জাপুরের কুমুদিনী হাসপাতাল, রাজধানীর মিরপুরের শিশু স্বাস্থ্য ফাউন্ডেশন হাসপাতাল, চট্টগ্রামের মা ও শিশু হাসপাতাল এবং সিলেটের বালুচরের গবেষণাগার থেকেও তথ্য-উপাত্ত ও নমুনা সংগ্রহ করা হয় বলে জানালেন তিনি। যে কাজ শূন্য থেকে শুরু হয়েছিল, সেই কাজে এখন মাঠকর্মী, বিজ্ঞানী ও চিকিৎসক—সব মিলিয়ে ২০০ জন কাজ করছেন বলে জানালেন সমীর সাহা। এই চারটি গবেষণাগার একটি আরেকটির সঙ্গে যুক্ত। প্রতিটি গবেষণাগারে রোগের জীবাণু নিয়ে গবেষণা তো হয়ই, হাসপাতালে আসা শিশু রোগীদের সব রকমের মাইক্রোবায়োলজিক্যাল পরীক্ষার কাজটাও হয়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৮৩ সালে অণুজীববিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নেন সমীর সাহা। এরপরই যোগ দেন ঢাকা শিশু হাসপাতালের এই গবেষণাগারে। ১৯৮৯ সালে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন ভারতের বেনারসে ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব মেডিকেল সায়েন্স থেকে। ‘ভারত থেকে ফিরে আবার যোগ দিলাম শিশু হাসপাতালের এই গবেষণাগারে। আমি ঠিক করলাম, শিশুমৃত্যুর হার বেশি এমন রোগের জীবাণু নিয়ে কাজ করব। সেই থেকে জীবাণুর তথ্য-উপাত্ত নিয়ে কাজ করে যাচ্ছি। এখন এখানে আমরা ১০০ জন কর্মী ও বিজ্ঞানী রয়েছি।’
ব্যবসায়ী চন্দ্রকান্ত সাহা ও গৃহিণী দুলানী প্রভা সাহার দুই ছেলে ও দুই মেয়ের একজন সমীর সাহা। রাজশাহীর চারঘাট থানার মনমোহনী হাইস্কুল থেকে এসএসসি এবং চাঁদপুর কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করেন তিনি। ‘বাবার ব্যবসা দেখতে পারতাম, কিন্তু আমি চেয়েছি এই গবেষণা নিয়েই থাকতে।’
সমীর সাহার পরিবারকে ‘অণুজীববিজ্ঞানী পরিবার’ বলা চলে। স্ত্রী সেতারুননাহার একজন অণুজীববিজ্ঞানী। সম্প্রতি অবসর নিয়েছেন বাংলাদেশ জনস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট থেকে। এই দম্পতির এক ছেলে ও এক মেয়ে। মেয়ে সেঁজুতি সাহা টরন্টো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মলিকুলার বায়োলজিতে পিএইচডি ডিগ্রি নিয়েছেন। ছেলে সুদীপ্ত সাহা একই বিশ্ববিদ্যালয়ে অণুজীববিজ্ঞান ও গ্লোবাল হেলথ বিষয়ে পড়ছেন।
দীর্ঘ গবেষণাজীবনে অণুজীববিজ্ঞানের আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন জার্নালগুলোয় ১৫০টির বেশি গবেষণা প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে সমীর সাহার। জন হপকিনস বিশ্ববিদ্যালয়, অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি, এডিনবরা ইউনিভার্সিটি, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, বিল অ্যান্ড মেলিন্ডা গেটস ফাউন্ডেশন, স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে কাজ করছেন নিয়মিত। ‘ল্যাবে শুধু গবেষণা করেই আমরা কাজটাকে শেষ করি না বা সীমাবদ্ধ রাখি না। সরকারের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে তথ্য-উপাত্ত দিয়ে তুলে ধরি বাংলাদেশে কোন রোগ বা কোন জীবাণুর জন্য ভ্যাকসিন প্রয়োজন।’
সমীর সাহা মনে করেন, তাদের গবেষণার সবচেয়ে বড় সফলতা নিউমোনিয়া ও মেনিনজাইটিস রোগের জীবাণু সঠিকভাবে শনাক্ত করা। এই শনাক্তকরণ সাহায্য করে সঠিক টিকা আনতে। আমাদের দেশে শিশুদের বেলায় যেসব রোগের প্রকোপ বেশি, সেসবের জীবাণু নিয়েই কাজ করেন এই বিজ্ঞানী এবং তার দল। আমাদের এখানে একটা বড় সমস্যা হলো, বেশির ভাগ ক্ষেত্রে শিশুরা অ্যান্টিবায়োটিক নেওয়ার পর পরীক্ষা করাতে আসে। সমীর সাহা বললেন, ‘অ্যান্টিবায়োটিক নেওয়ার পরে জীবাণু মরে যায়। আমরা এমন পদ্ধতি বের করেছি, যাতে জীবাণু মরে যাওয়ার পরও শনাক্ত করা যায়—এটা কী ছিল। এ কাজগুলো আমাদের করা।’
সমীর সাহা তার দলকে আগলে রাখেন পরিবারের মতো করে। এমনটাই মনে করেন আইসিডিডিআরবির মেটারনাল অ্যান্ড চাইল্ড হেলথ বিভাগের সিনিয়র ডিরেক্টর শামস্ এল আরেফিন। তিনি বললেন, ‘বিজ্ঞানী হিসেবে সমীর সাহা অনেক বড় মাপের। আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন। তিরিশ বছর ধরে একটা গবেষণাগার গড়ে তুলেছেন। এখন দল বড় হওয়ার পরও একটা পারিবারিক পরিবেশ ধরে রাখতে পেরেছেন।’
চাইল্ড হেলথ রিসার্চ ফাউন্ডেশনের ল্যাব ডিরেক্টর মাকসুদা ইসলাম। সমীর সাহার সঙ্গে কাজ করছেন ১৯৮৯ সাল থেকে। বললেন, ‘তখন তো আমাদের তেমন কিছুই ছিল না। এখন একটা বড় দল নিয়ে কাজ করি আমরা। কখনোই মনে হয় না যে চাকরি করছি। আমার তো মনে হয় ল্যাবই আমাদের ঘরবাড়ি। একটা পারিবারিক পরিবেশ থাকে সব সময়।’
ভবিষ্যতে গবেষণাগারের ক্ষমতা ও পরিধি আরও বাড়াতে চান তিনি। ‘যেখানে প্রয়োজন, সেখানে—একেবারে মফস্বল পর্যন্ত এই ল্যাবসুবিধা নিয়ে যেতে চাই।’ গবেষণা, তথ্য–উপাত্ত বিশ্লেষণ, গবেষণাপত্র লেখা নিয়েই থাকেন সমীর সাহা। অবসর পেলে সময় কাটান পরিবারের সঙ্গে। যেহেতু সবাই অণুজীববিজ্ঞানী, তাই তাদের আলাপচারিতায় নানা বিষয়ের সঙ্গে বিজ্ঞানের ভাষাও চলে আসে। আর এসব ঘিরেই সমীর সাহার দিনরাত্রি।
সংবাদ ও বিশ্লেষণ : প্রথম আলো