শিউরে ওঠার মতো সব ঘটনা! নৃশংসতায় কে কাকে ছাপিয়ে যায়— হিসেব করা যায় না। পশ্চিমবঙ্গের দুর্গাপুরের বেনাচিতিতে, এক ব্যাংক ম্যানেজারের ফ্ল্যাট থেকে সুটকেসবন্দি তরুণীর পচাগলা দেহ উদ্ধারের পর অতীতের আরও কিছু হত্যাকাণ্ড ফিরে আসছে স্মৃতিতে।
প্রত্যেকটা ঘটনা একই প্রশ্ন তুলেছিল মানুষের মনে। এতটা নৃশংসও হতে পারে মানুষ? এভাবে খুন করে দেহ কেটে টুকরো টুকরো করে ফেলতে পারে কেউ? ভরে ফেলতে পারে সুটকেসে বা টিভির বাক্সে? এমন কাণ্ড ঘটানোর পরও, মানুষ ঠাণ্ডা মাথায় প্রমাণ লোপাটের চেষ্টা করতে পারে কীভাবে?
প্রশ্নগুলোর উত্তর খুঁজতে যেতে হবে মনস্তত্ত্ববিদদের কাছে। কিন্তু তার আগে ফিরে দেখা যাক এমন কয়েকটি ঘটনা।
এই সব হত্যাকাণ্ডের অনেকগুলোতেই কিন্তু হত্যাকারীকে ধরতে পারেনি পুলিশ। কোনও ক্ষেত্রে নিহতের পরিচয় পর্যন্তও জানা যায়নি।
২০০৩ সাল: ডানকুনি লোকালে লবণমাখা দেহাংশ
ফেব্রুয়ারি মাস। শিয়ালদহ স্টেশনে ডানকুনি লোকালের কামরায় সাদা রঙের ব্যাগে পাওয়া গিয়েছিল নাভি থেকে ঊরু পর্যন্ত কাটা নুনমাখা দেহাংশ। ঠিক আগের রাতে কল্যাণী স্টেশনে রেল লাইনের ধারে মিলেছিল আর একটি ব্যাগ। তাতে মিলেছিল একটি পুরুষের মাথাসহ দেহের নানান কাটা অংশ। তদন্তে নেমে রেল পুলিশ দুটি ব্যাগের দেহাংশ জোড়া দিয়ে দেখেছিল— সেটি একই পুরুষের। কিন্তু ওই দেহের মালিক কে সেটা জানতে পারেনি রেল পুলিশ। বিভিন্ন রেল স্টেশনে নিহতের ছবি এবং তার সঙ্গে পাওয়া জিনিসপত্রের ছবি পাঠিয়েছিল রেল পুলিশ। ছবি গিয়েছিল বিভিন্ন থানাতেও। খুন করার পর কার দেহ টুকরো টুকরো করে কেটে বস্তায় ভরে বিভিন্ন স্টেশনে ফেলে দেয়া হয়েছিল সেই রহস্যের কিনারাই করতে পারেনি পুলিশ। ফলে তদন্তের কাজ আর এগোয়নি।
২০০০ সাল: চেন্নাই মেলে মহিলার কাটা মাথা
ঠিক একই ভাবে ১৫ বছরেও রেল পুলিশ জানতে পারেনি ২০০০ সালে ডাউন চেন্নাই মেলে বস্তায় মুড়ে কোন নারীর মাথা এবং দুটি হাত রেখে গিয়েছিল দুষ্কৃতীরা।
ওডিশার বোলাঙ্গির স্টেশনে এক মহিলার ধড় এবং হায়দ্রবাদের নামপল্লি স্টেশনে এক মহিলার দুটি পা উদ্ধার হওয়ার পরে সব অংশ জোড়া দিয়ে পুলিশ নিশ্চিত হয় যে, মৃতদেহটি একই মহিলার। কিন্তু সেই মহিলা কে, তাকে কারা খুন করল তা জানতে না পারায় ওই ঘটনার তদন্তই বন্ধ করে দেয়া হয়।
২০০৩ সাল: টিভির বাক্সে দেহ
লালবাজার সূত্রের খবর, ওই বছর নভেম্বরে পারিবারিক কলহের জেরে মিটন দাস নামে এক ব্যক্তিকে খুন করে তারই পরিবারের দুই সদস্য। খুনের পর মিটনের দেহ দু’টুকরো করে অভিযুক্তরা। পরে একটি টিভির বাক্সে মাথা থেকে ঊরু পর্যন্ত দেহাংশ ভরে, ফেলে দেয়া হয় বেলেঘাটা চাউল পট্টি রোডের ধারে একটি খালে। তদন্তে নেমে অবশ্য অভিযুক্তদের গ্রেপ্তার করে পুলিশ।
২০০৮ সাল: শপিং ব্যাগে শিশু
২০০৮ সালের ডিসেম্বরে উল্টোডাঙায় খালের কাছে একটি শপিং ব্যাগের মধ্যে উদ্ধার হয় এক বছরের শিশু ইন্দ্রজিৎ সাহার দেহ। খুনের পরে মৃতদেহ টুকরো টুকরো করে কেটেছিল দুষ্কৃতীরা। এক দিন পরে ডানকুনি টোলপ্লাজার কাছে বস্তাবন্দি অবস্থায় উদ্ধার করা হয় ওই শিশুর মা বুলা সাহার মৃতদেহ।
চার্জশিটে পুলিশ জানায়, পারিবারিক বিবাদের জেরে ওই শিশুকে এবং তার মাকে খুন করেছিল পরিবারেরই দুই সদস্য।
২০০৯ সাল: টিনের বাক্সে নারী
বুলা সাহা কাণ্ডের ঠিক ছয় মাসের মাথায় নারকেলডাঙ্গা খালের পাশে রেল সেতুর নিচে একটি টিনের বাক্সের মধ্যে থেকে উদ্ধার হয় ক্ষতবিক্ষত এক নারীর দেহ। পরে জানা যায় ওই মহিলার নাম স্বপ্না চক্রবর্তী। টিনের বাক্সের সূত্র ধরেই ওই খুনের কিনারা করে কলকাতা পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগের কর্মর্তারা।
২০১১ সাল: বার কোডে সমাধান
কলকাতা পুলিশে দীর্ঘ দিন হোমিসাইড বিভাগে কাজ করা এক গোয়েন্দা কর্মকর্তার কথায়, ঠিক একই রকম ঘটনা ঘটেছিল ২০১১ সালে নিউ আলিপুরে। একটি টিভির বাক্সের ভিতর ক্ষতবিক্ষত অবস্থায় উদ্ধার করা হয় এক প্রতিবন্ধী নারীর দেহ। এমনভাবে ওই নারীর দেহের বিভিন্ন অশে ধারালো অংশ দিয়ে আঘাত করা হয়েছিল যে মৃতদেহটি শনাক্ত করারই উপায় ছিল না। পরে ওই টিভি বাক্সের ওপরে টিভি নির্মাতা সংস্থার ‘বার কোড’ দেখে মহিলাকে শনাক্ত করে কলকাতা পুলিশ। ওই নারীর এক আত্মীয়কে গ্রেপ্তার করেন গোয়েন্দারা।
২০১৪ সাল: বেডিংয়ের ভিতরে কাটা দেহ
ওই বছর ২০ মে শিয়ালদহ স্টেশনের ট্যাক্সিস্ট্যান্ডের কাছে একটি ট্রলি ব্যাগ এবং বেডিং পড়ে থাকতে দেখেন রেল পুলিশকর্মীরা। পরে তা খুলে তাজ্জব হয়ে যান পুলিশকর্মীরা। বেডিংয়ের মধ্যে চাদরে মোড়া গলা থেকে কোমড়। আর ট্রলি ব্যাগের মধ্যে মহিলার মাথা, কাটা হাত-পা মেলে। পরে ওই ট্রলি ব্যাগের সূত্র ধরে পুলিশ জানতে পারে ওই মহিলার নাম জয়ন্তী দেব। ওই ঘটনায় মহিলার স্বামীসহ তিনজনকে গ্রেপ্তার করেছিল রেল পুলিশ। লেকটাউনের বাড়িতে খুন করার পর রাতের অন্ধকারে ফেলে যাওয়া হয় শিয়ালদহ স্টেশনের বাইরে।
২০১৫ সাল: সুটকেসে মা-মেয়ের টুকরো করা দেহ
এই ঘটনাও স্তম্ভিত করে দিয়েছিল সবাইকে। বিবাহ বহির্ভূত সম্পর্কে জড়িয়ে পড়া ব্যাংক ম্যানেজার সমরেশ সরকার— প্রেমিকা আর তাঁর চার বছরের মেয়েকে খুন করেছিল প্রেমিকারই দুর্গাপুরের ফ্ল্যাটে। এরপর তাঁদের দেহ টুকরো টুকরো করে কেটে চারটে সুটকেসে ভরে রাখে। শেওড়াফুলিতে নৌকায় উঠে মাঝগঙ্গায় ওই সুটকেসগুলি ফেলতে গিয়ে সে ধরা পড়ে যায়।
কিন্তু মানুষ এত নৃশংস হয় কীভাবে?
এভাবে খুন করার মানসিক জোর ওই সব খুনিরা পায় কোথা থেকে? মনরোগ চিকিৎসক কেদার বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথায়, ‘এমনিতেই কিছু মানুষ স্বভাবগতভাবে অতি নৃশংস হয়। সেটাই তাঁর মানসিক অবস্থা। এটাকে বলে অ্যান্টিসোশ্যাল পার্সোনালিটি ডিজঅর্ডার। তবে এক দিনে এটা তৈরি হয় না। একেবারে ছোটবেলা থেকেই মানে ৫-৬ বছর বয়স থেকেই এই তাঁদের ভিতর তৈরি হয়। ছোট ছোট নানা ঘটনা ঘটিয়ে এক দিন তাঁরা এমন একটা বড় কিছু করে ফেলেন। এ জন্য তাঁদের কোনও অনুশোচনা বোধও কাজ করে না।’
সূত্র: আনন্দবাজার পত্রিকা