
নিউ টাউনে এক তথ্যপ্রযুক্তি সংস্থার অফিসে যেদিন একজন সিনিয়র আধিকারিক ‘আত্মহত্যা’ করলেন, তার পরেরদিনই নিউ ইয়র্কে রাষ্ট্রপুঞ্জ প্রকাশ করল ২০২৫ সালের ‘ওয়ার্ল্ড হ্যাপিনেস রিপোর্ট’। দুটো ঘটনাকে পাশাপাশি রাখলে বেশ অদ্ভুত লাগবে। আমরা মোটের ওপর ভেবে নিই, টাকা থাকলেই সুখ আসবে। বা অন্তত— সুখ বা আনন্দ আসাটা ভীষণভাবে টাকার সঙ্গে সম্পর্কিত। অথচ যে ভদ্রলোক ছাদ থেকে লাফ মেরে জীবনে ইতি টেনে দিলেন, তিনি সংস্থার অত্যন্ত শীর্ষপদে চাকরি করতেন। ওই সংস্থায় কর্মরত কয়েকজনের থেকে শুনলাম, তাদের ধারণা— বছরে অন্তত চল্লিশ লাখের কাছাকাছি বেতন পেতেন। দীর্ঘদিন সম্ভবত পশ্চিমের কোনও দেশেও কাজ করেছেন। এই তথ্যগুলো ঠিক বা ভুল হতে পারে। সবটাই শোনা কথা। কিন্তু যেটা মোটের ওপর ধরে নেওয়া যায়, অর্থের বিশেষ অপ্রতুলতা তাঁর ছিল না। বরং দেশের একেবারে শীর্ষ আয়করদাতাদের গোত্রে তিনি পড়তেন। তারপরেও ঠিক কী কারণে তিনি চরম সিদ্ধান্ত নিলেন, আমরা জানি না। তাঁর প্রতি সম্মান রেখে এই উত্তর জানার কোনও চেষ্টাও আমরা করব না। সেটা পুলিশি তদন্তসাপেক্ষ।
ঠিক তার পরেরদিনই রাষ্ট্রপুঞ্জ অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগিতায় প্রকাশ করল ২০২৫ সালের ‘ওয়ার্ল্ড হ্যাপিনেস রিপোর্ট’। এই তালিকায় কারা প্রথম হল বা ভারতের স্থান কত, সেই নিয়ে আমরা কোনও আলোচনাতেই যাব না। কারণ তাতে কোনও সারপ্রাইজ নেই। বরাবরের মত টানা আটবার সর্বোচ্চ স্থান ধরে রেখেছে ফিনল্যান্ড। তাই হয়, হয়ে থাকে। যে কোনও উন্নয়ন সূচকেই স্ক্যান্ডিনেভিয়ার ফিনল্যান্ড-নরওয়ে-সুইডেন সবার ওপরে থাকে। এবারেও সেরা দশে তারা আছে, তাদের সঙ্গে ডেনমার্ক, আইসল্যান্ড, নেদারল্যান্ডস, কোস্টা রিকা, মেক্সিকো, ইজরায়েল, লুক্সেমবার্গ ইত্যাদি আছে। সবার শেষে আছে আফগানিস্তান। ভারত বরাবরের মতই (বা অন্যান্য নানা উন্নয়নমূলক সূচকের মতই) তলার দিকে আছে। আমাদের স্থান, ১৪৭ দেশের মধ্যে ১১৮-তম স্থানে। আমাদের চেয়ে পিছনে আছে বাংলাদেশ ও শ্রীলঙ্কা। ইরাক, যুদ্ধবিধ্বস্ত ইউক্রেন, মোজাম্বিক, নাইজেরিয়া, নামিবিয়া, ক্যামেরুন, কেনিয়া, উগান্ডা, এমনকি পাকিস্তানও খানিক এগিয়ে আছে তালিকায়। আশা করা যায় এই নিয়ে বিশেষ আলোচনা হবে না; বা হলেও এটি যে নিশ্চিতভাবেই ভুল, তা নিয়ে কেন্দ্রের নেতামন্ত্রীরা সওয়াল করবেন।
তাহলে এখানে কী নিয়ে আলোচনা হবে? আমরা একবার দেখব, এই রিপোর্টের মাপকাঠি কী কী। বিজ্ঞানীদের বক্তব্য, শুধুমাত্র সম্পদ বা অর্থেই খুশি আসে না। বরং খুশির একটা অন্যতম শর্ত হল অচেনা, অজানা, সম্পূর্ণ অপরিচিত মানুষের প্রতি বিশ্বাস। যে বিশ্বাস থাকলে একজন ভাববে, আমি বিপদে পড়লেও পাশে পথচলতি আরেকজনকে পাব। রিপোর্টের শুরুতেই বিজ্ঞানীরা লিখেছেন, অপরের হিতকারিতা বা দয়াশীলতা (benevolence, এক্ষেত্রে একটা ভাল প্রতিশব্দ করা যায়— “সহমর্মিতা”) নিয়ে মানুষ চরম নিরাশ। অথচ আমাদের ভাল থাকা নির্ভর করে অপরের দয়াশীলতা বা হিতকারিতা নিয়ে আমাদের ধারণার ওপর। দেখা গিয়েছে, যে সমাজে এইরকম বদান্যতা বা হিতকারিতা বেশি, সেখানে তা সর্বাধিক প্রভাব ফেলে অসুখী মানুষদের ওপর। আমরা একে অপরের প্রতি কতটা ‘কেয়ার’ করি, স্রেফ এইটুকু দিয়েই খুশি থাকার মাপকাঠি ভরিয়ে ফেলা যায়। খুব সামান্য ব্যাপারেই সেগুলো ধরা পড়ে। যেমন, ধরা যাক, অফিসে বা কলেজে খাবার ভাগ করে খাওয়া। রিপোর্টে স্পষ্ট লেখা আছে, “একা একা ডিনার করা কখনও মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য ভাল হয় না। যারা অনেকের সঙ্গে একসাথে বসে খাওয়াদাওয়া করতে অভ্যস্ত, তারা অনেক বেশি ভাল থাকতে পারে। এই একা একা খাওয়ার প্রবণতা অস্বাভাবিক বেড়ে যাওয়ার কারণে আমেরিকার মত অত্যাধিক ধনী দেশে সুখী থাকার মান ক্রমশ অধোগামী হয়েছে।”
এই একাকীত্বে থাকার প্রবণতা সবচেয়ে বেশি যুবসমাজের মধ্যে। ২০২৩ সালের তথ্য বলছে, বিশ্বে ২৩ শতাংশ মানুষ ‘আমাকে আমার মত থাকতে দাও’-তে বিশ্বাসী। তারা মানতেই পারে না, তাদের পাশে কেউ থাকতে পারে বলে। বস্তুত, তারা যতটা ভাবে, আদৌ কিন্তু বাস্তব অতটা কঠিন নয়। কিন্তু তাও তারা ভাবছে। তাদের ভাবনার পরিধিও বাড়ছে। তাকে উল্টোদিকে ভাবানোর মত কিছু পাচ্ছে না। রিপোর্টে ‘Happiness’-এর একটা চমৎকার উল্টো শব্দ আছে। ‘Despair’। বলা হচ্ছে, এই ‘despair’ বা বিষাদ থেকেই আত্মহননের প্রবণতা বাড়ে। তথ্যপ্রমাণ দিয়ে গবেষকরা দেখিয়েছেন, যে দেশে বেশি সংখ্যক মানুষ দান করা, অপরকে সাহায্য করা, নিঃস্বার্থভাবে ভলান্টিয়ার করায় বেশি অংশ নেয়, সে দেশে সুইসাইডের হার লক্ষ্যণীয়ভাবে কম।
এইবার ভাবুন তো, এই যে অপরিচিতের প্রতি বিশ্বাস, ভরসা, আমাদের নিজেদের মধ্যে কি আছে? থাকলে ঠিক কতটা আছে? আমাদের কানে কিন্তু উল্টোটাই আসে। রাস্তায় বেরনোর সময় কানে আসে সতর্কবার্তা, “অচেনা লোকের সঙ্গে বেশি কথা কয়ো না। কেউ কিছু জিজ্ঞেস করলে বলবে না। অচেনা কারুর দেওয়া খাবার খাবে না।” সঙ্গে অনেকে জুড়ে দেন, “কী করব বাছা, দিনকাল খারাপ হয়ে গিয়েছে!” অফিসে কাজ করতে ঢুকলে ভেসে আসে সুপরামর্শ, “এটা কাজের জায়গা, কেউ কারোর বন্ধু নয়। এসেছো, কাজ করবে, চলে যাবে, অত কথার কী আছে বাপু?” সামান্য দশ হাজার টাকা মাইনের চাকরিতে দেখা যায়, ডিপার্টমেন্টে চার জন লোক চার পাঁচে কুড়িরকম লেঙ্গিবাজি করছে। রাস্তায় বেরোতে আজকাল ভয় লাগে। সামান্য গায়ে ঘষা খেলেও পায়ে পা লাগিয়ে লোকে ঝগড়া করছে। রাস্তায় বাস ট্রাফিক সিগন্যাল খুলে যাওয়ার পরে পাঁচ সেকেন্ড বেশি দাঁড়ালে পিছনে গাড়ি হর্ন মেরে অস্থির করে দেবে। সঙ্গে চলবে ড্রাইভারকে তেড়ে গালাগাল। অল্পেই কথা কাটাকাটি লেগে যাচ্ছে। কোনও গাড়ি ওভারটেক করলেই “শালা ওকে দেখে নেব” বলে শুরু হবে রেষারেষি। হাতাহাতি যেন নিত্যদিনের ব্যাপার। অথচ কেউ অজ্ঞান হয়ে রাস্তায় পড়ে গেলে পথচলতি লোক জড়ো হয়ে তাকে ধরাধরি করে বাড়ি পৌঁছে দেওয়া বা ডাক্তারখানায় নিয়ে যাওয়া আজ থেকে দশ বছর আগে অন্তত এই কলকাতা শহরে বেশ চেনা দৃশ্য ছিল। আজ সেসব বিরল।
আমাদের দেশ কেন সুখী রিপোর্টে পিছিয়ে আছে, তার কারণ এই নয় যে, এখানে লোকের পয়সা কম। তার কারণ, এখানে এত বেশি লোক যে, কেউ কাউকে পরোয়া করে না। বা করার ফুরসৎ পায় না। সে অফিস হোক বা বাড়ি। কর্পোরেট হোক বা মুদির দোকানি। কেউ কেমন আছে, তার প্রতি দয়া, সহমর্মিতা, তার পাশে দাঁড়ানোর মত সময় বা ফুরসৎ কারোর নেই। মানুষ বিপদে পড়ে থানায় গেলে উলটে পুলিশের রুক্ষ ব্যবহার হজম করতে হয় বা শুনতে হয়, “এটা এখানকার এলাকা নয়, আপনি অমুক থানায় যান।” কারোর কিছু যায় আসে না। তথ্যপ্রযুক্তি সংস্থা জানে, প্রতি বছর লক্ষ লক্ষ ছেলেমেয়ে বিটেক পাশ করছে। একজন কোম্পানি ছাড়লে একশোটা নতুন সিভি পেয়ে যাব। আমজনতা মনে করে, অচেনা কেউ বিপদে পড়ে হেল্প চাইছে বলে দাবি করছে মানেই নির্ঘাত কোনও অসাধু উদ্দেশ্য আছে। অসাধু কাজকর্মের পরিমাণটাও এত মাত্রাতিরিক্ত বেশি যে— কে সৎ আর কে নয়— এটা বুঝতে পারাটাই একটা বিরাট কৃতিত্বের কাজ বলে ধরা হয়। আশেপাশে অনেকেই বলাবলি করেন— “উফফ, অমুকের চোখ একেবারে জহুরির চোখ, এখানে চালাকি চলবে না!”
তথ্যপ্রযুক্তি বা কর্পোরেট সেক্টরে কতটা মানসিক স্বাস্থ্যের বারোটা বাজে, সে নিয়ে অনেকে বলছেন, পরেও বলবেন। মানে, শুনতে যতই খারাপ লাগুক— এরকম বলার মত উপলক্ষ্য ভবিষ্যতে বহু আসবে। তবে আমাদের সমস্যাটা বোধ হয় সার্বিক। খুব সহজ, সাধারণ সমস্যা। বাসে, ট্রেনে, মেট্রোয়, অফিসের ডেস্কে আমার পাশের সিটে বসে থাকা সহনাগরিক খুব ভাল মানুষ, এই ছোট্ট বিশ্বাসটুকু আমাদের নেই। যেটা থাকা ভীষণ জরুরি। যে কারণে কেউ একটু ভাল ব্যবহার করলে আমার ভীষণভাবে মনে থেকে যায়। নিজেকে ভাগ্যবান বলে ভাবতে থাকি। এক সপ্তাহ সেই ঘটনার রেশ থাকে। অথচ কখনও মনে হয় না, এমনটাই তো হওয়ার কথা ছিল। এর উল্টোটা হচ্ছে, সেটাই তো অস্বাভাবিক। কিন্তু না, মনে হয় ঠিক তার উল্টো। খারাপ হওয়াটাই নর্মাল, আমি ভাগ্যবান তাই আমার সঙ্গে আজ কেউ ভাল ব্যবহার করল।