মুক্তিযোদ্ধা ফাদার মারিনো রিগান: ধর্ম প্রচার করতে এসে করেছেন মানবতার চর্চা

ইতালি
ইতালি
বাগেরহাট জেলার মংলা উপজেলায় শেলাবুনিয়া গ্রামে সেন্ট পলস্ স্কুল চত্বরে রয়েছে ফাদার মারিনো রিগানের সমাধি।

ফাদার মারিনো রিগান পঞ্চাশের দশকে বাংলাদেশে আসেন। তিনি একজন ইতালীয় ধর্ম প্রচারক, দার্শনিক, লেখক ও অনুবাদক। পরবর্তীতে তিনি ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন এবং যুদ্ধাহত মানুষের সেবা করেন, মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য খাবারের ব্যবস্থা করেন। পরে তাকে বাংলাদেশের সম্মানসূচক নাগরিক ও মুক্তিযোদ্ধা খেতাব দেয়া হয়।


মারিনো রিগান ধর্ম আর দেশের বেড়াজাল ডিঙিয়ে বাঙালির বন্ধু হিসেবেই সমধিক পরিচিত হয়ে ওঠেন। বাংলাদেশে অকৃত্রিম এ বন্ধু ইতালির ভিচেঞ্চায় চিকিৎসাধীন অবস্থায় ২০ অক্টোবর ২০১৭ তারিখে শুক্রবার সন্ধ্যায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। তিনি বাংলাদেশে অসুস্থ হলে চিকিৎসার জন্য তাকে ইতালী নিয়ে যাওয়া হয়েছিল, মৃত্যুর আগে তিনি বাংলাদেশে সমাহিত হওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেন, এজন্য ইতালী থেকে তার মৃতদেহ উড়িয়ে এনে মংলার শেলাবুনিয়ায় সমাধিস্ত করা হয়।  

রিগান ১৯২৫ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি ইতালির ভেনিসের কাছে ভিল্লভেরলা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। ২৮ বছর বয়সে ১৯৫৩ সালে ফাদার মারিনো খ্রিস্টান ধর্ম প্রচারের উদ্দেশ্যে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে আসেন। পুরো দেশ ঘুরে শেষ পর্যন্ত বাগেরহাটের মংলা উপজেলার হলদিবুনিয়া গ্রামে দীর্ঘস্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন। ধর্ম প্রচারের পাশাপাশি তিনি গরিবদের সাহায্য, শিক্ষার প্রসার এবং চিকিৎসাসেবায় এগিয়ে আসেন।

তবে তার সবচেয়ে বেশি অবদান ছিল ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে। মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় তিনি অসুস্থ ও যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয় ও সেবা দেন। এর মাধ্যমেই তিনি সরাসরি বাংলার মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন। তার এই কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ ২০০৯ সালে বাংলাদেশ সরকার ফাদার মারিনো রিগানকে সম্মানসূচক নাগরিকত্ব প্রদান করে।

ফাদার রিগান ছিলেন একজন দার্শনিক, অনুবাদক ও লেখক। তিনি বাংলা শিল্প-সাহিত্য নিয়ে বিস্তর গবেষণা করেন। পরে সেটি ইতালীয় ভাষায় অনুবাদ করেন। তিনিই ইতালীয় ভাষায় অনুবাদ করেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গীতাঞ্জলিসহ প্রায় ৪০টি কাব্যগ্রন্থ, গানের মধ্যে ছিল লালন সাঁইয়ের তিন শতাধিক গান। পাশাপাশি তিনি জসীম উদ্দীনের নকশীকাঁথার মাঠ, সোজন বাদিয়ার ঘাটসহ বিভিন্ন জনপ্রিয় কবিদের কবিতা অনুবাদ করেন। ১৯৯০ সালে তার হাত ধরেই ইতালিতে রবীন্দ্র অধ্যয়ন কেন্দ্র প্রতিষ্ঠিত হয়।

শিক্ষামূলক কার্যক্রমের ফাদার রিগানের ছিল প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ। বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলে তার তত্ত্বাবধানেই প্রতিষ্ঠিত হয় ১৭টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। যেখানে ছিল সুবিধাবঞ্চিতদের জন্য বৃত্তির সুবিধা। তার হস্তক্ষেপেই ১৯৮৬ সালে বাংলাদেশের একটি নৃত্যনাট্যের দল ইতালিতে মঞ্চস্থ করে ‘নকশীকাঁথার মাঠ’। 

ইতালীয় ও ইংরেজি ভাষায় লেখা তার দিনলিপিতে উঠে আসে আমাদের স্বাধীনতাযুদ্ধের খন্ড খন্ড চিত্র। অন্যসব ধর্মযাজকের মতো তিনি শুধু ধর্মীয় কর্মকান্ডেই নিয়োজিত থাকেননি, সেসঙ্গে নিজেকে যুক্ত করেছিলেন শিল্প, সংস্কৃতি আর শিক্ষামূলক বহুমাত্রিক কাজে। 

https://youtu.be/aoCIOLOO-EA