যুক্তরাষ্ট্রের নতুন শুল্ক নীতিতে বাংলাদেশে তৈরী পোশাক রপ্তানি কি হুমকির মুখে পড়বে?

ট্রাম্পের তুলে ধরা তথ্য অনুযায়ী যুক্তরাষ্ট্রের পণ্যের ওপর বাংলাদেশ শুল্ক আরোপ করে ৭৪ শতাংশ। যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের পণ্যের ওপর শুল্ক আরোপ করতো ১৫ শতাংশ, সেটি বাড়িয়ে ৩৭ শতাংশ করা হবে বলে জানিয়েছে ট্রাম্প প্রশাসন।

যুক্তরাষ্ট্র
আমদানিকৃত পণ্যের ওপর নতুন করে শুল্ক ঘোষণার এ দিনটিকে ডোনাল্ড ট্রাম্প ‘স্বাধীনতা দিবস’ হিসেবে বর্ণনা করেছেন।

২ এপ্রিল (২০২৫) হোয়াইট হাউজের রোজ গার্ডেনে এক অনুষ্ঠানে ট্রাম্প কোন দেশের ওপর কত পারস্পরিক শুল্ক [রেসিপ্রোকাল ট্যারিফ] আরোপ করছেন, তার একটি তালিকা তুলে ধরেছেন।

সেখানে মার্কিন পণ্যের ওপর শুল্ক আরোপের প্রতিক্রিয়ায় বাংলাদেশের ওপর ৩৭ শতাংশ, ভারতের ওপর ২৬ শতাংশ, চীনের ওপর ৩৪ শতাংশ এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) ওপর ২০ শতাংশ শুল্ক বসানোর তথ্য উল্লেখ ছিলো। বাংলাদেশের পত্রিকাগুলো যে বিষয়টি পরিষ্কার করতে ব্যর্থ হয়েছে— এই হার সবক্ষেত্রে নতুন শুল্ক পরিমাণ নয়। বরং এখানে বলা হয়েছে রিসিপ্রোকাল ডিসকাউন্টেড ট্যারিফ এবং কমবাইন্ড ট্যারিফ।

২০২৪ সালের ২৪ অক্টোবর ডোনাল্ড ট্রাম্প জানিয়েছিলেন, তিনি জাতীয়ভাবে শুল্ক বাড়িয়ে পণ্যের দাম বাডানোর পক্ষপাতী নন, তিনি বরং আন্তর্জাতিক পণ্যের ওপর শুল্ক বাডাতে আগ্রহী।

 

বাংলাদেশ এবং ভারতের ক্ষেত্রে এটি ডিসকাউন্টেড রিসিপ্রোকাল ট্যারিফ, কিন্তু চীনের ক্ষেত্রে কমবাইন্ড ট্যারিফ। অর্থাৎ বাংলাদেশ আগে যে ১৫ শতাংশ শুল্ক দিতো, তার সাথে এখন ৩৭ শতাংশ যুক্ত হয়ে ৫২ শতাংশ হবে না, ৩৭ শতাংশ-ই থাকবে। কারণ, যুক্তরাষ্ট্রের পণ্যে বাংলাদেশ ৭৪ শতাংশ শুল্ক আরোপ করে বলে ৫০ শতাংশ বিয়োগ করে বাংলাদেশ ৩৭ শতাংশ-এর সুবিধা পাবে। ভারতের ক্ষেত্রেও একই নীতি প্রয়োগ করা হলেও ৫০ শতাংশ ডিসকাউন্ট রেটে ভারত সুবিধা পাচ্ছে ২৬ শতাংশ। যেহেতু যুক্তরাষ্ট্রের পণ্যে ভারত শুল্ক আরোপ করে ৫২ শতাংশ। অতএব, ৫০ শতাংশ  ডিসকাউন্টেড রিসিপ্রোকাল হিসেবে ভারতীয় পণ্যে যুক্তরাষ্ট্রকে শুল্ক দিতে হবে ২৬ শতাংশ। চীনের দিতে হবে কমবাইন্ড ট্যারিফ— আগের ২০ শতাংশের সাথে বাড়তি ৩৪% = ৫৪%।

চীন ৩ এপ্রিল তারিখ রয়টার্সকে তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া জানিয়ে বলেছে, যুক্তরাষ্ট্র শুল্ক প্রত্যাহার না করলে তারাও কোনো কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হবে। ওদিকে যুক্তরাষ্ট্র জানিয়েছে চীন বাণিজ্য চুক্তি অনুযায়ী প্রতি বছর যুক্তরাষ্ট্র থেকে ২০০ বিলিয়ন ডলারের পণ্য কিনতে ব্যর্থ হয়েছে।

ট্রাম্প আরও জানান, তিনি যুক্তরাষ্ট্রে সব আমদানির ওপর ১০ শতাংশ বেজলাইন শুল্ক বসাবেন এবং দেশটির বড় বাণিজ্যিক অংশীদার দেশগুলোর ওপর আরো বেশি শুল্ক আরোপ করবেন। এটি হলে বিনা শুল্কে যুক্তরাষ্ট্রে পণ্য রপ্তানির সুবিধা আর পাওয়া যাবে না।

ট্রাম্পের এ শুল্ক নীতিতে ভারত সবচেয়ে বেশি লাভবান হবে বলে মনে করা হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রে চীনের ৪০০ বিলিয়ন ডলারের রপ্তানি বাজার, যেটির দখল এখন ভারত নিতে চাইবে। চীন নতুন বাজার খুঁজবে। ফলে ইউরোপে চীন বাংলাদেশের আরো বড় প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠবে। বাংলাদেশের রপ্তানি বড় ধরনের ধাক্কা খাবে বলে সহজেই অনুমেয়, বড়সড় কোনো পরিকল্পনা না নিতে পারলে বিশেষ করে পোশাক খাত ধ্বসে পড়তে পারে। উল্লেখ্য, যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের প্রায় ৮০০ কোটি ডলারের পোশাক রপ্তানি রয়েছে।

ডোনাল্ড ট্রাম্প বলেছেন, নতুন এ শুল্কনীতি যুক্তরাষ্ট্রকে আবার ধনী রাষ্ট্রে পরিণত করবে।

ডোনাল্ড ট্রাম্পের নতুন এ শুল্ক নীতিতে ৫ এপ্রিল থেকে যুক্তরাষ্ট্রে আমদানি করা সব পণ্যের ওপর ১০ শতাংশ হারে আরোপিত শুল্ককে সর্বজনীন ভিত্তি হিসেবে ধরা হয়েছে। ইইউ, চীনসহ বিশ্বের প্রায় ৬০টি দেশ ৯ এপ্রিল থেকে উচ্চমাত্রার এ শুল্কের কবলে পড়বে। প্রশ্ন উঠেছে— ভারতের চেয়ে ১১ শতাংশ বেশি কর দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক কি টিকে থাকতে পারবে? তবে বাংলাদেশ যদি যুক্তরাষ্ট্রের পণ্যের ওপর শুল্ক ৭৪ শতাংশ থেকে কমিয়ে নিয়ে আসে, তাহলে রিসিপ্রোকাল ডিসকাউন্টেড পলিসি হিসেবে সুযোগ পাবে। অর্থাৎ বাংলাদেশ যদি যুক্তরাষ্ট্রের পণ্যের ওপর শুল্ক ৪০% করে দেয়, তাহলে যুক্তরাষ্ট্রে ২০% শুল্ক সুবিধায় পণ্য রপ্তানি করতে পারবে। সেক্ষেত্রে চীন বাংলাদেশে বাজার বেশ কিছুটা হারাতে শুরু করবে।

এছাড়া যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমদানিকৃত পণ্যের শুল্ক কমানো খুব সহজ কথা নয়। কারণ, যুক্তরাষ্ট্র থেকে বাংলাদেশ ২০ হাজার কোটি টাকারও বেশি মূল্যের পণ্য আমদানি করে। এ পণ্যগুলো বেশিরভাগই হাইটেক পণ্য এবং তুলা। ফলে আমদানির ওপর ট্যারিফ কমিয়ে রপ্তানি সুবিধা নিতে গেলে সুবিধা করতে পারবে না বাংলাদেশ। যুক্তরাষ্ট্র থেকে যে ধরনের পণ্য বাংলাদেশ আমদানি করে, তাতে তাদের যে হারে লাভ থাকে, তৈরি পোশাক রপ্তানি করে সে হারে লাভ করা সম্ভব নয়। এরপর যদি বাংলাদেশ আমদানি শুল্ক আরো কমিয়ে দেয়, তাহলে সুযোগে আরো অনেক বেশি উচ্চ মুনাফার পণ্য যুক্তরাষ্ট্র থেকে বাংলাদেশে ঢুকে পড়বে। এখন যে পণ্যগুলো ঢোকে সেগুলোর অনেকগুলোতে কোনো ট্যাক্সই আরোপ করে না বাংলাদেশ। যুক্তরাষ্ট্রের সব পণ্যে ট্যাক্স কমালে সেটি ভালো হবে না। সেক্ষেত্রে প্রয়োজনে যুক্তরাষ্ট্রের পণ্য ভারতে উৎপাদিত হয়ে বাংলাদেশে ঢুকবে। সেক্ষেত্রে পোশাক রপ্তানি করে বাংলাদেশ কখনই অর্ধেক ট্যারিফ সুবিধা নিয়েও সমানে সমান হতে পারবে না। কার্যত এই ঘোষণার ফলে বাংলাদেশের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য ঘাটতি অনেকখানি কমে আসবে, অথবা বাংলাদেশের বাণিজ্য ক্ষতিগ্রস্ত হবে। ২০২৪ সালে যুক্তরাষ্ট্র থেকে বাংলাদেশে এসেছে ২.২ বিলিয়ন ডলারের পণ্য। বাংলাদেশ থেকে যুক্তরাষ্ট্রে ঢুকেছে ৮.৪ বিলিয়ন ডলারের পণ্য। বাংলাদেশ তার রপ্তানি আয়ের প্রায় ২০ শতাংশ অর্জন করে যুক্তরাষ্ট্র থেকে। এদিক থেকে সংকট আসলে কতখানি বোঝা কঠিন নয়।

পাশাপাশি এ প্রক্রিয়ায় তৈরি পোশাক শিল্পের মালিকরা সরকারকে আরো চাপে ফেলার সুযোগ পাবে। তারা সরকারের কাছ থেকে বিভিন্ন ধরনের রেয়াত সুবিধা দাবী করবে। অন্যদিকে সরকার যুক্তরাষ্ট্র হতে আমদানি শুল্ক কমিয়ে দিলে তারা তুলা আমদানি আরো কম দামে করতে চাইতে পারে। প্রয়োজনে তারা ভারত হয়ে পণ্য যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানি করবে। বলা যায়— বিপদে পড়তে যাচ্ছে বাংলাদেশ সরকার।