Headlines

কমরেড নিবেদিতা নাগের জন্মশতবার্ষিকী

প্রাণতোষ তালুকদার, ঢাকা

গত ৪ আগস্ট (২০১৮) অবিভক্ত বাংলার নারীমুক্তি আন্দোলন, শিক্ষা প্রসারের আন্দোলন ও শ্রমিক আন্দোলনের বিশিষ্ট নেত্রী কমরেড নিবেদিতা নাগের জন্মশতবার্ষিকী পালন হয়েছে। তাঁর স্বামী ছিলেন বাংলাদেশে কমিউনিস্ট পার্টির অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা কমরেড নেপাল নাগ, যাঁর সঙ্গে নিবেদিতা নাগের বিয়ে হয়েছিল ১৯৪৩ সালে। ২০১৩ সালে মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত নিবেদিতা নাগ কমিউনিস্ট আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন।

১৯৪৮ থেকে ১৯৫২ সাল অবধি বিস্তৃত মহান ভাষা আন্দোলনে তাঁর অসামান্য অবদানের জন্য ২০০০ সালে বাংলাদেশে তাঁকে নাগরিক সংবর্ধনা প্রদান করা হয়েছে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি ছিলেন কলকাতায়। কমিউনিস্ট পার্টির একজন সদস্য হিসেবে তিনি যুদ্ধরত কমরেডদের এবং নির্যাতনের শিকার দুর্গত মানুষের পাশে এসে দাঁড়িয়েছিলেন। মুক্তিযুদ্ধে অসামান্য অবদানের জন্য নিবেদিতা নাগকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মহাজোট সরকার ২০১৩ সালে বিদেশী নাগরিকদের জন্য সর্বোচ্চ সম্মাননা ‘স্বাধীনতা-মৈত্রী’ পদক প্রদান করেছে।

নিবেদিতা নাগ জন্মেছেন ৪ আগস্ট ১৯১৮ তারিখে, বাংলাদেশের নারায়ণগঞ্জের আমলাপাড়ায় মাতামহ আনন্দ রায়ের বাড়িতে। মা অমিয়াবালা চৌধুরী ছিলেন স্কুল শিক্ষয়িত্রী। বাবা অধ্যাপক সঞ্জীবকুমার চৌধুরী শিক্ষকতা করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এবং নেপালের ত্রিভূবন বিশ্ববিদ্যালয়ে।

সম্পন্ন পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছেন তিনি, বেড়ে উঠেছেন এক বিপ্লবী পরিবেশে। পিতা ছিলেন চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার দখল অভিযানের মহানায়ক সূর্য সেনের সহপাঠী। তাঁর কাকারা সবাই ছিলেন সূর্য সেনের বিপ্লবী দলের সদস্য। চট্টগ্রামের সুচিয়া গ্রামে তাঁর পৈত্রিক বাড়ি ছিল অগ্নিযুগের বিপ্লবীদের গোপন কর্মকান্ডের অন্যতম ঘাঁটি। স্কুলে থাকতেই নিবেদিতা বিপ্লবীদের সাহায্যের জন্য চাঁদা তুলতেন, গোপন চিঠিপত্র আদানপ্রদান করতেন, এমনকি বাড়িতে বিপ্লবীদের অস্ত্রও লুকিয়ে রাখতেন।

স্কুলছাত্রী নিবেদিতাকে বিপজ্জনক মনে হওয়াতে দু বছরের জন্য তাঁকে চট্টগ্রাম থেকে বহিষ্কার করা হয়, যে কারণে নারায়ণগঞ্জে মায়ের পৈত্রিক বাড়িতে থেকে তিনি ম্যাট্রিক পাশ করেন ১৯৩৪ সালে। ১৯৩৭ সালে কলকাতায় বেথুন কলেজে পড়ার সময় তিনি সর্বভারতীয় ছাত্র ফেডারেশনে যোগদান করেন। সংগঠনের ডাকে ধর্মঘট সংঘটিত করতে গিয়ে কলেজ থেকে বহিষ্কৃত হন। ’৩৮ সালে চট্টগ্রাম সরকারী কলেজ থেকে বি এ পাশ করেন। ১৯৪১ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্যে এম এ পাশ করেন।

কমরেড নিবেদিতা নাগ ১৯৪২ সালে কমিউনিস্ট পার্টির সদস্যপদ লাভ করেন। ’৪৩ সালে ঢাকা জেলা মহিলা আত্মরক্ষা সমিতির সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন এবং কলকাতায় অনুষ্ঠিত বঙ্গীয় প্রাদেশিক মহিলা আত্মরক্ষা সমিতির সম্মেলনে অংশগ্রহণ করেন। কমিউনিস্ট পার্টির প্রভাবাধীন নারী সংগঠনে কাজ করতে গিয়ে তিনি সহযোদ্ধা হিসেবে পেয়েছেন আশালতা সেন, লীলা রায় ও সুফিয়া কামালের মতো বরেণ্য নেত্রীদের।

১৯৪৭ সালে নারায়ণগঞ্জে তোলারাম কলেজ প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে তিনি অগ্রণী ভূমিকা গ্রহণ করেছিলেন এবং এই কলেজের প্রতিষ্ঠাতা অধ্যক্ষার দায়িত্ব পালন করেছেন। ২০০০ সালে তিনি যখন দীর্ঘকাল পর বাংলাদেশে আসেন তখন নারায়ণগঞ্জের তোলারাম কলেজের শিক্ষক ও ছাত্ররা তাঁর জন্য বিশাল সংবর্ধনার আয়োজন করেছিল। ’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের সময় তাঁর কলকাতার বাড়ি ছিল কমিউনিস্ট মুক্তিযোদ্ধাদের ঘাঁটি।

তাঁর পার্টি জীবন ও কর্মজীবনের অধিকাংশ সময় কেটেছে ঢাকা ও কলকাতায়। পার্টির শ্রমিক-কৃষক এলাকায় মাঠ পর্যায়ের কর্মীরা তাঁকে জানতেন রিজিয়া বেগম নামে। দীর্ঘ পার্টি জীবনে বহু বিপ্লবী নেতা ও বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গের সংস্পর্শে এসেছেন তিনি। স্থায়ীভাবে ঢাকা ছেড়েছেন পঞ্চাশের দশকের শেষভাগে। তারপরও ২০০০ সালে তাঁকে নিজেদের কাছে পেয়ে ঢাকার সুহৃদ, স্নেহভাজন ও শুভানুধ্যায়ীরা উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠেছিলেন। বিভিন্ন সংবর্ধনা সভায় তিনি বাংলাদেশের কমিউনিস্ট আন্দোলনের গৌরবোজ্জল সেই সব দিনের স্মৃতিচারণ করেছেন।