একাত্তরের মাত্র নয় মাসে সারা বাংলাদেশে যে গণহত্যা চালানো হয়েছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর আর কোথাও তা হয়নি। এই গণহত্যার তথ্য-চিত্র তুলে আনছে ‘১৯৭১: গণহত্যা-নির্যাতন আর্কাইভ ও জাদুঘর’।
সংগত কারণেই জাদুঘরটির অস্থান খুলনায়। ১৯৭১ সালে সারাদেশের মতো দক্ষিণাঞ্চলেও সংগঠিত হয়েছিল ভয়াবহ গণহত্যা। খুলনার চুক নগরে একদিনে মাত্র কয়েক ঘণ্টায় হত্যা করা হয়েছিল দশ সহস্রাধিক মানুষ! গণহত্যা জাদুঘর গণহত্যার ইতিহাস, বক্তব্য সংগ্রহ করে, বয়ান তৈরি করে এবং এ প্রজন্মের মানুষের কাছে তা প্রদর্শন করার ব্যবস্থা করে থাকে।
আমাদের মুক্তিযুদ্ধের দুটি দিক- একটি হচ্ছে, যুদ্ধ এবং বিজয়গাঁথা, আরেকটি হচ্ছে, গণহত্যা এবং সর্বস্ব হারানোর বেদনা। বিজয়গাঁথা আমাদের মুক্তির সংগ্রামের আত্মত্যাগ এবং বিভৎসতার দিকটি আড়াল করেছে। শাসকদের উদাসীনতা এবং শোষকদের ষড়যন্ত্রের ফলেও সেটি ঘটেছে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ব্যতীত অন্য কোনো যুদ্ধে এত বেশি লোককে স্বল্প সময়ে হত্যা করার নজির কোথাও নেই। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে নাৎসি বাহিনী মানবতার বিরুদ্ধে যেসব অপরাধ করেছিল তার চেয়েও ভয়ঙ্কর ছিল পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী এবং তাঁদের এদেশীয় দোসরদের অত্যাচার, নির্যাতন এবং হত্যার রকমফের।
মায়ের আঁচল চাপা কান্না অদৃশ্য হয়েছে ভয়ে—যদি আবার ঘটে এমন কোনো বিভৎসতা। ভুক্তভোগীরা কখনই নিশ্চিন্ত হতে পারেনি, স্বাধীনতার প্রায় পঞ্চাশ বছর পার হলেও সামাজিক এবং রাজনৈতিকভাবে এমন কোনো পরিবেশ নির্দিষ্ট সময়কালব্যাপী এদেশে বিরাজ করেনি যাতে মানুষের মনস্তত্ব নতুনভাবে গঠিত হয়, ফলে পূবসূরীদের মতো প্রজন্মও বড় হয়েছে হচ্ছে ধর্মের ওপর ভর করে, সাম্প্রদায়িক জোটবদ্ধতাকে পুঁজি করে ধানঢ্য এবং কর্তৃত্বপরায়ন হওয়ার মানসিকতা নিয়ে।
ধর্মের ভিত্তিতে দেশ ভাগ হওয়ার মধ্য দিয়ে যে বিষবৃক্ষ রোপিত হয়েছিল ১৯৪৭ সালে, তার ক্ষত বারে বারে শুধু বিক্ষত হয়েছে, শুকায়নি কখনও। মানব মুক্তির যে আকাঙক্ষা নিয়ে ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ সংগঠিত হয়েছিল তা কখনও বাস্তব রূপ লাভ করেনি নেতৃত্বের দুর্বলতা এবং চক্রান্তকারীদের চক্রান্তের কারণে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার অল্পকিছুদিনের মধ্যে ট্রাইব্যুনাল করে (নুরেমবার্গ ট্রায়াল) মিত্রশক্তি অক্ষশক্তির যেসব রাজনৈতিক নেতা এবং সামরিক বাহিনীর কর্মকর্তা যুদ্ধাপরাধ এবং মানবতা বিরোধী অপরাধের মতো অপরাধ করেছিল তাঁদের বিচার করে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছিল।
এদিক থেকে মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে আমাদের নেতৃত্ব ভীষণভাবে ব্যর্থ হয়। মানবিক দুর্বলতার কারণেই হোক আর আকাঙক্ষার অতিশয্যে হোক যে বিষ দাঁত নব্য প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশ সেদিন রেখে দিয়েছিল সে দাঁতের দংশনেই বারে বারে মুষড়ে পড়ে দেশ, কাল ও মুক্তির সংগ্রাম। তাই যে কোনো ধরনের সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক উন্নতির চেয়ে সেইসব বর্বরদের বিচার করা অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ কাজ, নইলে সব উন্নয়ন ভুলুণ্ঠিত হচ্ছে এবংহবে।
গণহত্যা সম্পর্কে কেউ জানতে চাইলে দেখবেন মনে হবে এ যেন কোনো দৈত্য দানবের গল্প, যা হয়ত সত্যি কোথাও ঘটেনি, কোনোদিন ঘটবেও না। সত্য হচ্ছে, অবিশ্বাস্য সেসব নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে, ঘটিয়েছে এ দেশেরই কিছু মানুষ (মানুষরূপী), যারা তখন অত্যাচারীর পক্ষ নিয়েছিল, প্রকৃতপক্ষে তাঁরাই অত্যাচারীর, হত্যা এবং নির্যাতনকারীর পক্ষ তৈরি করেছিল।
সাধারণ মানুষের নীরবতা, অবস্থান এবং মনস্তত্ব নিয়ে সবসময়ই প্রশ্ন ওঠে, বলা হয়ে থাকে, সীমাহীন এসব বর্বরতা কীভাবে তাঁরা সহ্য করেছিল তখন। সবাই সমস্বরে এসব ঘটনার প্রতিবাদ করলে কি এরকম ঘটাতে পারতো বর্বরেরা। প্রশ্ন ওঠে- চারপাশের এসব পৈশাচিকতা সহ্য করে কীভাবে তাঁরা (সাধারণ মানুষ) স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে পেরেছিল? ফলে তৎকালীন পূর্বপাকিস্তানের এবং বর্তমান বাংলাদেশের মানুষের মন নিয়েও প্রশ্ন ওঠেই।
তাই গবেষণা শুধু তথ্যগত বিষয় নয়, শুধু কিছু পরিসংখ্যান নয়, আমাদের মুক্তিযুদ্ধ এবং মুক্তিযুদ্ধকালে সংগঠিত গণহত্যার রয়েছে রাজনৈতিক এবং সাম্প্রদায়িক বিচার, ঐতিহাসিক শোধ-প্রতিশোধ, এসব বিষয়ও গবেষণার বিষয়। গণহত্যা জাদুঘর তথ্য সংগ্রহ যেমন করছে, পাশাপাশি অনেক তাত্ত্বিক বিষয় নিয়েও সভা, সেমিনারের আয়োজন করছে, বই প্রকাশ করছে, ফলে প্রজন্ম জানতে পারছে, বুঝতে পারছে, নিজেকে কোনদিকে নেবে তা ঠিক করার সুযোগ পাচ্ছে।
গণহত্যা জাদুঘরটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বরেণ্য ইতিহাসবিদ অধ্যাপক মুনতাসির মামুনের উদ্যোগ এবং প্রচেষ্টায়, তিনিই জাদুঘরের ট্রাস্টিবোর্ডের চেয়ারম্যান, তাঁর নেতৃত্বে ৬৪ জেলার গণহত্যা জরিপ হচ্ছে, প্রকাশিত হচ্ছে ৬৪ জেলার ওপর ৬৪টি বই, পাশাপাশি প্রতিটি গণহত্যা ধরে ধরে বই প্রকাশিত হচ্ছে।
জাদুঘরটির ঠিকানা, ২৬ সাউথ সেন্ট্রাল রোড, খুলনা। সোমবার বন্ধ থাকে, সপ্তাহের বাকীদিনগুলো খোলা।
https://youtu.be/zqW6EhZ2tig