আজ ১৯ আগস্ট (২০২১) বিকেল ৩টায় জাতিসংঘ ঘোষিত ‘বিশ্ব মানবহিতৈষী দিবস’ (World Humanitarian Day) উপলক্ষে একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির চিকিৎসা সহায়তা কমিটি কর্তৃক আয়োজিত ‘আফগানিস্তানে ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয়’ শীর্ষক আন্তর্জাতিক ওয়েবিনারে প্রারম্ভিক বক্তব্যে নির্মূল কমিটির কেন্দ্রীয় সভাপতি লেখক সাংবাদিক চলচ্চিত্র নির্মাতা শাহরিয়ার কবির বলেন, ‘রাজনৈতিক, সামাজিক বা প্রাকৃতিক যে কোনও মানবিক বিপর্যয়ে আর্তজনের সাহায্যে সবার আগে এগিয়ে আসেন সেবাকর্মী, উদ্ধারকর্মী, ত্রাণকর্মী, সমাজকর্মী ও মানবাধিকাকর্মীরা। এদের মানবপ্রেম ও ত্যাগকে বিশেষভাবে শ্রদ্ধাজ্ঞাপনের জন্য জাতিসংঘ আজকের দিনটি নির্ধারণ করেছে। বাংলাদেশ সহ সমগ্র বিশ্বে করোনা মহামারীজনিত ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয়ের সময় যেসকল চিকিৎসক ও সেবাকর্মী জীবনের ঝুঁকি নিয়ে নিরলস চিকিৎসা ও স্বাস্থ্য সেবা প্রদান করছেন এবং এই মহান কর্মযজ্ঞে যারা নিজেদের জীবনদান করেছেন তাদের সকলের প্রতি আজকের দিনে বিনম্র শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করতে চাই। আমাদের জাতির পিতা মানবহিতৈষী রাষ্ট্রনায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে ১৯৭৫-এর এই আগস্ট মাসেই হত্যা করা হয়েছিল, যিনি বিশ্বের শোষিত, বঞ্চিত মানুষের জন্য জীবন উৎসর্গিত করেছিলেন।
সমগ্র বিশ্ব যখন করোনা মহামারী মোকাবেলায় দিশেহারা এমন দুর্যোগকালে আফগানিস্তানে জঙ্গী মৌলবাদী সন্ত্রাসী তালেবানদের অবৈধ ক্ষমতাদখলে আমরা গভীরভাবে উদ্বিগ্ন। ধর্ম-বর্ণ-লিঙ্গ নির্বিশেষে সকল মানুষের সম অধিকার ও সম মর্যাদায় যাদের বিন্দুমাত্র শ্রদ্ধা নেই, ২৫ বছর আগে প্রথমবার আফগানিস্তানে ক্ষমতা দখল করে যারা নারী ও শিশু সহ ভিন্নমত, ভিন্নধর্ম ও ভিন্ন জীবনধারায় মানুষদের উপর নজিরবিহীন নির্যাতন ও হত্যাকাণ্ড চালিয়েছিল, সেই অন্ধকারের অপশক্তি উদারতার মুখোশ পরে এখন আফগানিস্তান ও বিশ্বের মানুষদের বিভ্রান্ত করতে চাইছে। নিজেদের সংকীর্ণ ভূ-রাজনৈতিক স্বার্থে পাকিস্তান ও চীনের মতো যেসব দেশ সন্ত্রাসী তালেবানদের অবৈধ ক্ষমতাদখলকে স্বীকৃতি দিতে উন্মুখ তাদের চেহারা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের নিকট উন্মোচন করতে হবে।’
শাহরিয়ার কবির আরও বলেন, ‘যে তালেবানরা এখন উদারতার কথা বলছে তারা কি অতীতের গণহত্যা ও মানবতার বিরুদ্ধে জঘন্য অপরাধের জন্য আফগানবাসী কিংবা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে ক্ষমা চেয়েছে? আফগানিস্তানের ঐতিহাসিক বলখ প্রদেশের নারী গভর্নর সালিমা মাজারিকে গ্রেফতার করে তালেবানরা মুখোশের আড়ালে থাকা ভয়ঙ্কর চেহারা উন্মোচন করেছে। আজ আফগানিস্তানের ১০২তম স্বাধীনতা দিবস। স্বাধীনতা দিবসের প্রাক্কালে জাতীয় পতাকা ওড়াবার জন্য দেশপ্রেমিক আফগানদের গুলি করা হত্যার দৃশ্য আমরা গতকাল আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে দেখেছি। অবৈধ ক্ষমতাদখলকারী সন্ত্রাসী তালেবানদের প্রতি যে কোনও ধরনের নমনীয় ও সহযোগিতামূলক আচরণ জাতিসংঘের এতদসংক্রান্ত সকল সনদবিরোধী এবং মানবতাবিরোধী অপরাধে সহযোগিতাতুল্য অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে।’
নির্মূল কমিটির চিকিৎসা সহায়তা কমিটির সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক ডা. মামুন আল মাহতাব বলেন, ‘আফগানিস্তানে তালেবানদের ১১ দিনে ক্ষমতা দখল কোন আকস্মিক ঘটনা নয়। এর পিছনে বাইরের সমর্থনের বিষয়টি এখন স্পষ্ট। পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী বলেছেন কাবুলের পতনের মধ্যে দিয়ে আফগানিস্তান দাসত্বের শৃঙ্খল মুক্ত হলো। আমরা দেখেছি আমাদের সরকার এরই মাঝে আফগান শরণার্থী গ্রহণ করার একটি মার্কিন প্রস্তাব ফিরিয়ে দিয়েছেন। এটি এখন স্পষ্ট যে তালেবানদের এই উত্থানে পাকিস্তানের এ দেশীয় দালালরা একদিকে যেমন উৎসাহিত হবে তেমনি পাশাপাশি বাংলাদেশের অগ্রযাত্রাকে আরো একবার রুখে দেয়ার জন্য একাত্তরে যারা আমাদের বিরুদ্ধে দাড়িয়েছিল তাদের চক্রান্তও নতুন একটি মাত্রা পেতে যাচ্ছে। এরই মাঝে আমরা সুশীল নামধারী কিছু তথাকথিত বুদ্ধিজীবির বক্তব্য এবং ফেসবুক ষ্টেটাসে এর প্রতিফলন দেখেছি। অতএব কাবুল ঢাকার চেয়ে হাজার মাইল দুরে বলে আমাদের আত্মতুষ্টিতে ভোগার কোন সুযোগই নেই। পাশাপাশি আমরা প্রত্যাশা করবো যে একাত্তরের চেতনায় প্রতিষ্ঠিত বর্তমান সরকার কখনই আফগানিস্তানের সাম্প্রদায়িক সরকারকে স্বীকৃতি দেবে না, কারণ যে চারটি মুলনীতির উপর ভিত্তি করে বাংলাদেশ দাড়িয়ে আছে এটি হবে তার সাথে সাংঘর্ষিক।’
নির্মূল কমিটির চিকিৎসা সহায়তা কমিটির সভাপতি অধ্যাপক ডাঃ উত্তম কুমার বড়ুয়া বলেন, ‘কোনো সন্ত্রাসবাদ বা মৌলবাদ কখনোই কোনো সভ্য সমাজের, রাষ্ট্রের মঙ্গল বয়ে আনতে পারে না। আফগানবাসী এবং বিশ্ববাসীও অতীতে আফগানিস্তানে তালেবান সরকারের নৃশংসতার নমুনা দেখেছে, সেখানে মানবতা ও সভ্যতার লেশ মাত্র ছিলো না। এখান তালেবানরা নানা ধরনের প্রতিশ্রুতি দিলেও অতীতের অভিজ্ঞতা থেকে রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, আফগানবাসীর জন্য মানবতাহীন এক ভয়াবহ দিন অপেক্ষা করছে। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, শিশু-নারীর অধিকার সবই ভূলন্ঠিত হবে। সভ্যতা ও মানবতা মুখ থুবড়ে পড়বে। ঠুনকো অজুহাতে শিরোচ্ছেদ হবে, শিশুরা শিশুখাদ্য পাবে না এবং মা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে। শিশু ও নারীরা অমানবিক আচরণের শিকার হবে। নারীদের শিক্ষা বন্ধ হয়ে যাবে, নারীরা স্বাধীনতা ও অধিকার হারাবে, অমানুষিক ও অমানবিক নির্যাতনের শিকার হবে সকল জনগণ। নারীরা এখন ২৫ বছর আগের সে অমানবিক অবস্থার আশংকায় ভীতসন্ত্রস্ত ও গৃহবন্দী।’
ডা. উত্তম বড়ুয়া তালেবানদের সমর্থন করার জন্য ডা. জাফরউল্লাহ চৌধুরীর বক্তব্যের কঠোর সমালোচনা করে বলেন, ‘একজন মুক্তিযোদ্ধা চিকিৎসক হয়ে ডা. জাফরউল্লাহ তালেবানদের মুক্তিযোদ্ধা বলে আমাদের চিকিৎসক সমাজ, ’৭১-এর বীর মুক্তিযোদ্ধা এবং মহান মুক্তিযুদ্ধকে অপমান করেছেন। ডা. জাফরউল্লাহ আরও বলেছেন, বঙ্গবন্ধু বেঁচে থাকলে নাকি তালেবানদের সমর্থন করতেন। বঙ্গবন্ধু কি তালেবানি শাসন প্রতিষ্ঠার জন্য বাংলাদেশ স্বাধীন করেছিলেন? বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করেছে পাকিস্তানপন্থী মৌলবাদী সাম্প্রদায়িক অপশক্তি, যাদের রাজনৈতিক উত্তরসূরি হচ্ছে তালেবান ও আল কায়দা। এই তালেবানরা ১৯৯৬ সালে আফগানিস্তানের নির্বাচিত রাষ্ট্রপতি ডা. নজিবউল্লাহকে কী নৃশংসভাবে হত্যা করেছে ডা. জাফরউল্লাহ কি তা ভুলে গিয়েছেন’?
সভায় চিকিৎসক বক্তারা তালেবানদের পক্ষে ডা. জাফরউল্লাহ্র বক্তব্যের তীব্র নিন্দা করে বলেন, বাংলাদেশে তালেবানদের পক্ষে যারা কথা বলবে তাদের সন্ত্রাসবাদের সহযোগী ও পৃষ্ঠপোষক হিসেবে চিহ্নিত করে সরকারকে সন্ত্রাসবিরোধী আইনে তাদের বিরুদ্ধে আইনগত পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।