একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির আন্তর্জাতিক ওয়েবিনার: ‘অবিলম্বে সরকারিভাবে ’৭১-এর গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি এবং পাকিস্তানি যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে’
১৬ অক্টোবর (২০২১) বিকেল ৩টায় ‘বাংলাদেশের গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি এবং পাকিস্তানি গণহত্যাকারীদের বিচার’ শীর্ষক একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির আন্তর্জাতিক ওয়েবিনার অনুষ্ঠিত হয়।
নির্মূল কমিটির সভাপতি লেখক সাংবাদিক শাহরিয়ার কবিরের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এই আলোচনা সভার প্রধান অতিথি ছিলেন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মাননীয় মন্ত্রী মুক্তিযোদ্ধা এডভোকেট আ. ক. ম. মোজাম্মেল হক এমপি।
সভায় বক্তব্য প্রদান করেন মৌলবাদ ও সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী দক্ষিণ এশীয় গণসম্মিলনের সভাপতি বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক, নির্মূল কমিটির সহসভাপতি শিক্ষাবিদ শহীদজায়া শ্যামলী নাসরিন চৌধুরী, সর্বইউরোপীয় নির্মূল কমিটির সভাপতি মানবাধিকার নেতা তরুণকান্তি চৌধুরী, প্রজন্ম ’৭১-এর সভাপতি শহীদসন্তান আসিফ মুনীর তন্ময়, নির্মূল কমিটির সুইজারল্যাণ্ড শাখার সভাপতি মানবাধিকার নেতা খলিলুর রহমান, নির্মূল কমিটির অস্ট্রেলিয়া শাখার সভাপতি ডা. একরাম চৌধুরী, নির্মূল কমিটির যুক্তরাজ্য শাখার নির্বাহী সভাপতি মানবাধিকার নেতা সৈয়দ এনামুল ইসলাম, নির্মূল কমিটির বেলজিয়াম শাখার সাধারণ সম্পাদক মানবাধিকার নেত্রী আনার চৌধুরী, দৈনিক সমকালের সিনিয়র রিপোর্টার সাংবাদিক আবু সালেহ রনি, বাংলাদেশ প্রতিদিনের সিনিয়র রিপোর্টার সাংবাদিক আরাফাত মুন্না, ৭১ টিভির বিশেষ প্রতিনিধি সাংবাদিক মিল্টন আনোয়ার, দৈনিক ভোরের কাগজের ডেপুটি চিফ রিপোর্টার সাংবাদিক ঝর্ণা মনি এবং নির্মূল কমিটি কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক মানবাধিকার নেতা কাজী মুকুল।
নির্মূল কমিটির সভাপতি লেখক সাংবাদিক শাহরিয়ার কবির বলেন, ‘এ বছর বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপনকালে আমাদের মনে রাখতে হবে ২০২১ সাল বাংলাদেশের গণহত্যারও ৫০ বছর। আমাদের দীর্ঘদিনের দাবির কারণে বর্তমান সরকার ২৫ মার্চ জাতীয় গণহত্যা দিবস হিসেবে পালনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলেও বাংলাদেশের গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি অর্জনের কোনও উদ্যোগ নেয়া হয়নি, যা গণহত্যাকারীদের বিচারের জন্য অত্যন্ত জরুরি। নির্মূল কমিটির পক্ষ থেকে আমরা গত ১৫ বছর ধরে দেশে ও বিদেশে বাংলাদেশের গণহত্যার স্বীকৃতি এবং গণহত্যাকারীদের বিচারের জন্য আন্দোলন করছি। মুক্তিযুদ্ধকালে ভারত ও রাশিয়া সহ বিভিন্ন দেশের সরকার, আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম এবং বিশিষ্ট নাগরিকরা পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী এবং তাদের এদেশীয় সহযোগীদের দ্বারা সংঘটিত গণহত্যার ভয়বতা ও ব্যাপকতা তুলে ধরে এর প্রতিবাদ করেছেন। নির্মূল কমিটি ছাড়াও মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে যেসব সংগঠন ও ব্যক্তি কাজ করছেন তারাও বিভিন্ন ফোরামে বাংলাদেশের গণহত্যার বিষয়টি তুলে ধরে গণহত্যাকারীদের বিচারের পক্ষে জনমত সংগঠিত করছেন। এ ক্ষেত্রে সরকারের উদ্যোগহীনতা দুর্ভাগ্যজনক।’
শাহরিয়ার কবির আরও বলেন, ‘জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু দেশে ফিরেই ’৭১-এর ঘাতক দালালদের বিচারের জন্য আইন প্রণয়ন করে যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশে ৭২টি ট্রাইব্যুনাল গঠন করেছিলেন এবং তার শাসনামলে সাড়ে তিন বছরে এসব ট্রাইব্যুনালে আড়াই হাজারেরও বেশি ব্যক্তির বিচার হয়েছিল, যেখানে ৭৫২ জনকে মৃত্যুদণ্ড ও যাবজ্জীবন সহ বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড প্রদান করা হয়েছিল। বঙ্গবন্ধুর নৃশংস হত্যাকাণ্ডের পর জেনারেল জিয়াউর রহমান দালাল আইন বাতিল করে এই বিচার শুধু বন্ধ করেননি, সাজাপ্রাপ্ত ও বিচারাধীন গণহত্যাকারী ও যুদ্ধাপরাধীদের সঙ্গে নিয়ে বিএনপি প্রতিষ্ঠা করেছেন। বঙ্গবন্ধু ’৭১-এর গণহত্যাকারী মৌলবাদী সাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক দল গঠন সাংবিধানিকভাবে নিষিদ্ধ করেছিলেন, জেনারেল জিয়া পাকিস্তানকে তুষ্ট করার জন্য ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল গঠনের উপর নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করে তাদের দল করার সুযোগ দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় ঐক্যবদ্ধ জাতিকে বিভক্ত করার উদ্যোগ নিয়েছিলেন, যার মাশুল এখনও দিতে হচ্ছে। স্বাধীনতার প্রায় চার দশক পর বঙ্গবন্ধুর কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশের ও বিদেশের যাবতীয় বাধা অগ্রাহ্য করে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রক্রিয়া আরম্ভ করেছিলেন। দুর্ভাগ্যের বিষয় এই বিচার প্রক্রিয়া এখন স্থবির হয়ে পড়েছে। কী কারণে দুটি ট্রাইব্যুনালকে কমিয়ে একটিতে নামিয়ে আনা হল কী কারণে ট্রাইব্যুনালে এখনও পাকিস্তানি যুদ্ধাপরাধী এবং গণহত্যাকারী অন্যান্য সংগঠনের বিচার হচ্ছে না তা আমাদের বোধগম্য নয়। ’৭১-এর গণহত্যার ৫০ বছর অতিক্রান্ত হওয়ার প্রাক্কালে আমরা আবারও দাবি জানাচ্ছি— অবিলম্বে ’৭১-এর গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি এবং পাকিস্তানি গণহত্যাকারীদের বিচার আরম্ভ করতে হবে।’
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মাননীয় মন্ত্রী মুক্তিযোদ্ধা এডভোকেট আ. ক. ম. মোজাম্মেল হক এমপি বলেন, ‘যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ও বাংলাদেশের গণহত্যার স্বীকৃতির মতো বিষয়গুলোতে একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে এগিয়ে আসে। ‘বাংলাদেশের গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি’ এখন জাতীয় দাবি। মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয়, আইন মন্ত্রণালয় ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সমন্বিতভাবে নির্মূল কমিটির সহযোগিতায় কাজ করলে এই দাবি পূরণ হবে বলে আমি মনে করি। আমাদের দূতাবাসগুলো বাংলাদেশের একাত্তরের গণহত্যার নৃশংসতা, ভয়াবহতা বহির্বিশ্বের নিকট তুলে ধরার কাজে সর্বদা নিয়োজিত। তারপরেও আমাদের ত্রুটি বিচ্যুতি আছে। সরকারের বিচ্যুতি ও ভুল-ভ্রান্তি তুলে ধরার ক্ষেত্রে নির্মূল কমিটি তার ভূমিকা সাফল্যের সাথে পালন করছে। আমরা বিশ্বাস করি, যে জাতি তার ইতিহাসকে লালন করে না, সে জাতি মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারে না। যে চার মূলনীতির ভিত্তিতে আমরা মুক্তিযুদ্ধ করেছি— জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা— এগুলোর একটিও থেকে বিচ্যুত হলে আমরা আর ঘুরে দাঁড়াতে পারব না। জাতির পিতার কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বাংলাদেশকে গড়ে তোলার চেষ্টায় অঙ্গীকারবদ্ধ।’
মৌলবাদ ও সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী দক্ষিণ এশীয় গণসম্মিলনের সভাপতি বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক বলেন, ‘এ ব্যাপারে কোন দ্বিমত থাকতে পারে না যে ১৯৭১ সালে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের নয় মাস সময় পাকিস্তানি হানাদার এবং তাদের বাঙালি দোসররা যে গণহত্যা, গণধর্ষণসহ অন্যান্য নির্যাতন চালিয়েছিল তা এমন কি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় নাৎসি বাহিনীর দ্বারা সংঘটিত গণহত্যার চেয়েও প্রকট ছিল এই অর্থে যে নাৎসিরা চার বছরে ৬০ লাখ ইহুদিকে হত্যা করেছিল, অথচ বাংলাদেশে নয় মাস সময়ই ন্যূনতম পক্ষে ৩০ লক্ষ লোককে হত্যা করেছে। যদিও এটি বলা হয় আড়াই লক্ষ নারী নির্যাতিত হয়েছে, কিন্তু নিরপেক্ষ হিসাব অনুযায়ী তাদের সংখ্যা ৫ লক্ষের কম নয়। এ বিষয়ে বিস্তারিত গবেষণা চালিয়ে অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন জানিয়েছেন ধর্ষিতা মহিলার সংখ্যা ৫ লক্ষের কম নয়। আমাদের স্বাধীনতার পর পর চীন, যুক্তরাষ্ট্র এবং মধ্যপ্রাচ্যের কয়েকটি দেশ পাকিস্তানের পক্ষ নেয়ায় বাংলাদেশের গণহত্যা এখনও জাতিসংঘে স্বীকৃতি পায়নি। এখন পরিবর্তিত বিশ্ব পরিস্থিতিতে আমাদের এই দাবি নিয়ে নতুন করে এগুতে হবে, যার জন্য প্রয়োজন আন্তর্জাতিক লবি। এখনও নিশ্চয়ই পাকিস্তান এবং সে দেশের ঘনিষ্ঠতম বন্ধু চীন আমাদের দাবির বিরোধিতা করবে। কিন্তু তার পরেও আমরা জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশের সমর্থন আশা করতে পারি যদি যথোপযুক্ত লবি চালিয়ে যাওয়া যায়। এ ব্যাপারে আমাদের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে ফলপ্রসূ ভূমিকা গ্রহণ করতে হবে। ভারত এবং অন্যান্য বন্ধু রাষ্ট্রের সাহায্যের উপর ভিত্তি করে আমরা এগিয়ে গেলে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পাওয়ার পথ খুলে যাবে। বাংলাদেশে গণহত্যায় অংশগ্রহণকারী পাকিস্তানি সেনাসদস্যদের বিচারের বিষয়ে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে এমন ভূমিকা রাখতে হবে যাতে পাকিস্তানের উপর বিভিন্ন দেশ চাপ সৃষ্টি করতে পারে।’
নির্মূল কমিটির সহসভাপতি শিক্ষাবিদ শহীদজায়া শ্যামলী নাসরিন চৌধুরী বলেন, ‘বাংলাদেশের জন্মলগ্ন থেকেই মুক্তিযুদ্ধ, ৩০ লক্ষ শহীদ, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নিয়ে পাকিস্তানের মিথ্যাচার, অপপ্রচার, ষড়যন্ত্র অনবরত চলছে। ডেভিড বার্গম্যান, শর্মিলা বসু, জুনায়েদ আহমেদ সহ অনেক লেখক, সাংবাদিক অথবা বিভিন্ন ব্যক্তির এসব ভয়ানক মিথ্যাচারে মদদ দিচ্ছে এবং দেশকে অস্থিতিশীল করতে নানা ধরনের অপকর্ম করছে পাকিস্তান সহ বাংলাদেশের জামায়াত, বিএনপি এবং সমমনা দল ও ব্যক্তি। ১৯৭১: গণহত্যা-নির্যাতন আর্কাইভ ও জাদুঘর ট্রাস্ট-এর বাংলাদেশে জেলাভিত্তিক গণহত্যার জরিপে ২০ জেলায় ৫১২১টি গণহত্যার হিসাব পাওয়া গেছে। তাহলে ৬৪ জেলায় সে সংখ্যা কতো হবে তা সহজেই অনুমেয়। এই ভয়াবহ গণহত্যার মূল হোতা পাকিস্তানি যুদ্ধাপরাধীদের আজ পর্যন্ত বিচার হয়নি। এই বিচারহীনতায় বাংলাদেশের শহীদ পরিবারদের ভেতরে প্রচণ্ড ক্ষোভ আছে। যদিও বাংলাদেশের যুদ্ধাপরাধীদের বিচার মন্থর গতিতে হলেও চলছে কিন্তু আমরা তো জানি টিক্কা খান, রাও ফরমান আলিসহ ১৯৫ জন পাকিস্তানি জেনারেল ও অফিসাররাই ছিল আসল জল্লাদ। এদের যদি শাস্তি না হয় তাহলে ভুক্তভোগীদের মনে চিরকাল অশান্তি বিরাজ করবে। বিশ্বশান্তির প্রেক্ষাপটেও এটি চরম অন্যায় বলে বিবেচিত হবে। এ কারণেই প্রয়োজন এদের বিচার এবং বাংলাদেশের গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি।’
সর্বইউরোপীয় নির্মূল কমিটির সভাপতি মানবাধিকার নেতা তরুণকান্তি চৌধুরী বলেন, ‘বাংলাদেশের গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির জন্য নির্মূল কমিটির সর্বইউরোপীয় শাখা সুইডেনে এবং সুইজারল্যান্ডে আন্তর্জাতিক সম্মেলন, মানববন্ধন ও আলোর মিছিলের আয়োজন করেছে। জার্মানী এবং ফ্রান্সেও এ ধরনের আয়োজনের পরিকল্পনা আছে। আগামী ডিসেম্বর মাসে ব্রাসেলস-এ ইউরোপীয়ান পার্লামেন্টের সামনে মানববন্ধন এবং জনসমাবেশের আয়োজন চলছে। সুইডেনের পার্লামেন্টে নির্মূল কমিটির কেন্দ্রীয় সভাপতি শাহরিয়ার কবিরের উপস্থিতিতে গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির দাবি তুলে ধরা হয়েছিল। সুইডিশ আইন প্রণেতারা বাংলাদেশ সরকার-এর কাছ থেকে এই স্বীকৃতির জন্য আনুষ্ঠানিক অনুরোধ প্রত্যাশা করেন। গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পেলে পাকিস্তানী গণহত্যাকারীদের বিচার করা সহজ হবে।
প্রজন্ম ’৭১-এর সভাপতি শহীদসন্তান আসিফ মুনীর তন্ময় বলেন, ‘কঠিন বাস্তবতা হলো, বাংলাদেশ জন্মের ৫০ বছর পরেও বাংলাদেশ সম্পর্কে বিশ্বের অনেক দেশের সাধারণ জনগণ এমনকি নীতি নির্ধারকদের মাঝে বাংলাদেশ সম্পর্কেই ভালোমতো জানা নেই। সেখানে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ও গণহত্যা সম্পর্কে ধারণা আরও অনেক কম। আন্তর্জাতিকভাবে গণহত্যার স্বীকৃতির জন্য একাধারে যেমন আন্তর্জাতিকভাবে প্রভাবশালী দেশ ও রাষ্ট্রীয় জোটের মাঝে তথ্য বিতরণ ও করণীয় সম্পর্কে প্রস্তাব রাখতে হবে, তেমনি ইংরেজী ও অন্যান্য ভাষায় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম, সরকারী বিভিন্ন ওয়েবসাইট ও ওয়েব পোর্টালে সুনির্দিষ্ট তথ্য প্রচারণা চালাতে হবে। এক্ষেত্রে দেশে ও বিদেশে বাংলাদেশী তরুণ সম্প্রদায় ও মুক্তিযোদ্ধা-শহীদ পরিবার-বুদ্ধিজীবীবৃন্দের সমন্বয় দরকার। এই কাজে যেমন সরকারী পৃষ্ঠপোষকতা দরকার, তেমনি নির্মূল কমিটিসহ মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধুর আদর্শে লালিত সকল সংগঠনের একই ধরনের তথ্য প্রচারণা চালাতে হবে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ সমর্থনকারী ‘ফ্রেন্ডস অব বাংলাদেশ’-এর মধ্যে যারা বেঁচে আছেন, তাদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা এবং প্রয়াতদের লিখিত বা অডিও ভিসুয়াল ধারণকৃত বক্তব্যকে এই উদ্যোগে সম্পৃক্ত করারও আহবান জানাচ্ছি।’
নির্মূল কমিটির সুইজারল্যাণ্ড শাখার সভাপতি মানবাধিকার নেতা খলিলুর রহমান বলেন, ‘জেনেভায় আমরা গত তিন বছর ধরে বাংলাদেশের গণহত্যার স্বীকৃতির জন্য নিয়মিত সেমিনার, সম্মেলন ও মানববন্ধন করছি। বাংলাদেশের রাষ্ট্রক্ষমতায় এখন মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সরকার। বাংলাদেশের গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি এবং পাকিস্তানি গণহত্যাকারীদের বিচারের জন্য উচ্চকন্ঠে সোচ্চার হওয়ার এখনই প্রকৃত সময়।’
নির্মূল কমিটির অস্ট্রেলিয়া শাখার সভাপতি ডা. একরাম চৌধুরী বলেন, ‘বাংলাদেশের গণহত্যার দাবিটি আন্তর্জাতিক ফোরামে শক্তভাবে উপস্থাপন না করায় স্বাধীনতার ৫০ বছর পরও দালিলিক প্রমাণ থাকা সত্ত্বেও পাকিস্তানি সেনাবাহিনী কর্তৃক সংঘটিত গণহত্যা আন্তর্জাতিক অঙ্গনে অপরিচিত। যা রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের ব্যর্থতা। পাকিস্তানি গণহত্যাকারীদের বিচারের দাবিটি জোরালো করতে হবে। সংগঠন হিসাবে একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি এবং এর আন্তর্জাতিক শাখা সমূহকে এ বিষয়ে অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হবে।
নির্মূল কমিটির যুক্তরাজ্য শাখার নির্বাহী সভাপতি মানবাধিকার নেতা সৈয়দ এনামুল ইসলাম বলেন, ‘পঁচাত্তরে জাতির পিতাকে হত্যার পরে ক্ষমতাসীন পাকিস্তানপন্থীরা একাত্তরের গণহত্যাকারীদের বিচার বন্ধ সহ দেশের ও বিশ্বের মানুষের মনোজগত থেকে বাংলাদেশের গণহত্যার স্মৃতি মুছে ফেলার চেষ্টা করে। একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি এ বছরকে গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি আদায়ের বছর ঘোষণা করে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বিভিন্ন ক্যাম্পেইন চালাচ্ছে। অথচ লন্ডনস্থ বাংলাদেশ হাই কমিশনের একটি আন্তর্জাতিক ওয়েবিনার ছাড়া এ বিষয়ে সরকারের আর কোনও উদ্যোগ আমার চোখে পড়েনি।
‘কয়েক বছর আগে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল থেকে পাকিস্তানি যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শুরু করার ঘোষণা এসেছিল। সম্ভবত কোন কারণে সরকার পাকিস্তানি ঘাতকের বিচার শুরু করতে ইতস্তত করছেন। আমরা আজকের ওয়েবিনারের প্রধান অতিথি মাননীয় মন্ত্রীর মাধ্যমে সরকারের নিকট দাবি জানাই— অবিলম্বে হানাদার পাকিস্তানি যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শুরু করুন। বিচারের জন্য পাকিস্তান এই যুদ্ধাপরাধীদের বাংলাদেশের হাতে তুলে না দিলে পাকিস্তানের সাথে সকল প্রকার সম্পর্ক ছিন্ন করুন।’
নির্মূল কমিটির বেলজিয়াম শাখার সাধারণ সম্পাদক মানবাধিকার নেত্রী আনার চৌধুরী বলেন, ‘পাকিস্তানি বাহিনীর গণহত্যার বিষয়টি আমাদের সারা বিশ্বে তুলে ধরতে হবে এবং এই গণহত্যার সাথে জড়িতদের বিচারের আওতায় আনতে হবে। গণহত্যার বিচার এবং সাথে সাথে বিষয়টির আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি অনিবার্য।’
দৈনিক সমকালের সিনিয়র রিপোর্টার সাংবাদিক আবু সালেহ রনি বলেন, ‘গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি আদায় করা সম্ভব হলে পাকিস্তানি যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ত্বরান্বিত হবে এবং এই স্বীকৃতি আদায়ই হোক স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপনের অন্যতম লক্ষ্য।’
বাংলাদেশ প্রতিদিনের সিনিয়র রিপোর্টার সাংবাদিক আরাফাত মুন্না বলেন, ‘পাকিস্তানি গণহত্যাকারীদের বিচার বাঙালি জাতির দীর্ঘদিনের চাওয়া। তবে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের কার্যক্রম দীর্ঘদিন ধরে বন্ধ থাকায়, সেই চাওয়া আদৌ পূরণ হবে কি না, তা নিয়ে আমি সন্দিহান। আপিল বিভাগে যুদ্ধাপরাধের ২৭ আপিল ও ২ রিভিউ আবেদন ঝুলছে। ট্রাইব্যুনালে সংগঠন হিসেবে জামায়াতে ইসলামীর বিচারসহ অনেক মামলা পেন্ডিং। তদন্ত সংস্থায় ৭০০ অভিযোগ অপেক্ষমান। বলা চলে গোটা যুদ্ধাপরাধ বিচারটাই থমকে আছে। যুদ্ধাপরাধ বিচার প্রক্রিয়া তরান্বিত করা হোক— সরকারের সংশ্লিষ্টদের কাছে এটাই অনুরোধ করবো।’
’৭১ টিভির বিশেষ প্রতিনিধি সাংবাদিক মিল্টন আনোয়ার বলেন, ‘একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধে সংঘটিত বিশ শতকের সবচাইতে নৃশংস ও বড় গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি না পাওয়ার ক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ ও দূরদর্শিতার অভাবের পাশাপাশি মুক্তিযুদ্ধ প্রশ্নে প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর মতভেদও দায়ী। এই মতভেদ গণহত্যার স্বীকৃতি আদায়ের জন্য উদ্যোগহীনতার অন্যতম কারণ। সেই সাথে এটিও উল্লেখ করা ভালো সরকারের বাইরে যেসব সংস্থা এই স্বীকৃতি আদায়ে বছরের পর বছর নিরবিচ্ছিন্ন কাজ করে চলছে সেসব সংস্থাকে গুরুত্ব না দেয়াও গণহত্যার স্বীকৃতি আদায়ে আপাত ব্যর্থতার কারণ হিসেবে উল্লেখ করলে খুব একটা ভুল বলা হবে না। স্বাধীনতার ৪৬ বছর পর ২৫ মার্চকে গণহত্যা দিবসের স্বীকৃতি দেয়া ও একাত্তরের গণহত্যার স্বীকৃতি আদায়ে সংসদে প্রস্তাব পাস হওয়ার খবর আমাদের স্বস্তি দেয় না, কেননা এই প্রস্তার পাস হবার ২ বছর আগেই জাতিসংঘ আন্তর্জাতিক গণহত্যা দিবসের স্বীকৃতি দিয়েছে । এবং সেখানে উপস্থিত বাংলাদেশের প্রতিনিধিদের অপ্রয়োজনীয় কিন্তু ক্ষতিকর নিরবতা আমাদের গণহত্যার স্বীকৃতিকে দুঃসাধ্য করে তুলেছে। তারপরেও আশাবাদী মানুষেরা কেবল একটি দিবসের বদলে পুরো নয় মাসের গণহত্যার স্বীকৃতি আদায়ের কথা বলছেন। কিন্তু তার জন্য রাষ্ট্র ও নাগরিকদের উদ্যোগ এখনও চোখে পড়ার মতো নয়।’
দৈনিক ভোরের কাগজের ডেপুটি চিফ রিপোর্টার সাংবাদিক ঝর্ণা মনি বলেন, ‘২৫ মার্চের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির কোনো সুযোগ নেই। সুযোগ আছে একাত্তরের গণহত্যার স্বীকৃতির আদায়ের। সারা বিশ্বই গণহত্যার বিরুদ্ধে সোচ্চার। সরকার আন্তরিকভাবে সচেষ্ট হলেই দাবি আদায়ে সক্ষম হবে। একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি সহ মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের একাধিক সংগঠন গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি আদায়ে সোচ্চার। সরকারও বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে ভাবছে। আমি বিশ্বাস করি, আর্মেনিয়া যদি ১০০ বছর পর তাদের গণহত্যার স্বীকৃতি অর্জন করতে পারে বাংলাদেশে ৫০ বছর পরও তা সম্ভব।’
নির্মূল কমিটির সাধারণ সম্পাদক মানবাধিকার নেতা কাজী মুকুল বলেন, ‘বিভিন্ন অজুহাতে ট্রাইব্যুনালকে প্রায় অকেজো করে রাখা হয়েছে— যা প্রমাণ করে সরকার যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে যথেষ্ট মনোযোগী নয়। আমাদের দাবি— যুদ্ধাপরাধীদের বিচার গতিশীল করে সাজাপ্রাপ্ত যুদ্ধাপরাধীদের স্থাবর, অস্থাবর সকল সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করে মুক্তিযোদ্ধা ও শহীদ পরিবারের কল্যাণে ব্যয় করতে হবে।’