”ভীড় করে ইমারত আকাশটা ঢেকে দিয়ে চুরি করে নিয়ে যায় বিকেলের সোনারোদ, ছোট ছোট শিশুদের শৈশব কেড়ে নিয়ে গ্রন্থকীটের দল বানায় নির্বোধ”
নচিকেতার এ গানটির রেশ ধরেই দেখতে গিয়েছিলাম কংক্রিট আর সমাজ-সংসারের ইমারতের নীচে চাপা পড়ে থাকা একগুচ্ছ ফুলের মত ফুটে থাকা কোমল শিশুদের।
”টিচ ফর বাংলাদেশ” প্রজেক্টের সাথে যুক্ত সদ্য বিসিএস (প্রশাসনে) সুপারিশপ্রাপ্ত শামিমা আক্তার জাহান পপি’র কর্মস্থল হাজী ইউসুফ আলী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে আজ আমরা দু’জন নবীন, সুপারিশপ্রাপ্ত বিসিএস ক্যাডার (আমি ও বিসিএস পুলিশ ক্যাডারে সুপারিশপ্রাপ্ত বার্নাড এরিক) গিয়েছিলাম কোমলমতি শিশুদের সাথে একটু সময় কাটাতে আর ওদের সাধ, সাধ্য আর সীমাবদ্ধতাগুলোকে অনুভব করতে।
বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের আন্তরিকতায় আমরা পৌঁছুলাম চতুর্থ শ্রেণীর একটি কক্ষে যেখানে অর্ধ-শত শিশুর জিজ্ঞাসু দৃষ্টি আমাদের অপেক্ষায়। পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতাও যে শিক্ষার একটি অংশ সেটা বুঝলাম শিশুদের নিজের হাতে ঝাড়ু দিয়ে রাখা শ্রেণিকক্ষটি দেখেই।
যখন প্রবেশ করলাম তখন ওদের অভিবাদনে সিক্ত আমরা, যেন কোনো স্বর্গের বাগানে ফুটে থাকা ফুলেরা আমাদের দেখে উচ্ছ্বাসে মুখরিত। আমরা পড়াতে যাইনি, গেছি পড়তে। পাঠের বিষয় : নিন্মবিত্ত ও নিন্ম-মধ্যবিত্ত পরিবারের শিশুগুলোর মনোজগত।
পরিচয় পর্বের পর ওদের কাছ থেকে বেরিয়ে আসতে শুরু হলো ওদের ভেতর লুকায়িত অজস্র প্রতিভা যা কিনা অনেক সম্ভ্রান্ত পরিবারের সন্তানদের মাঝেও মেলে না। কেউ ম্যাজিশিয়ান, কেউ ক্ষুদে আর্টিস্ট, কেউ বা কণ্ঠশিল্পী আবার কেউ খেলোয়াড়।
বেশ কিছুক্ষণ ধরে ওদের নানা প্রতিভার সাথে পরিচিত হলাম আমরা। এরিক দেখালো মজার সংখ্যার ম্যাজিক, আমি দেখালাম কীভাবে হাত না ভিজিয়ে একটি পানিপূর্ণ বাটি থেকে একটি পয়সা উদ্ধার করা যায় তার বৈজ্ঞানিক যাদু।
ওদের চোখে তখন উচ্ছ্বাস ঠিকরে পড়ছিল, যে উচ্ছ্বাসের ঠিকরে পড়া আলো হয়তো পৌঁছায়না আমাদের সমাজ ও রাষ্ট্রের উর্ধ্বতল অব্দি। ওরা ধাঁধাঁ শোনালো অবলীলায়, আর আমরা সত্যিকারের ধাঁধাঁয় পড়ে গেলাম ওদের এমন প্রাণবন্ত উপস্থাপন ভঙ্গিতে; সত্যিই কি এরা সমাজের ঐ শ্রেণি থেকে ওঠে আসা শিশু!
আমরা শুনলাম ওদের বড় হয়ে যার যা যা হবার ইচ্ছা তার কথা। ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, বিজ্ঞানী, পুুলিশ, সেনা কর্মকর্তা, ম্যাজিস্ট্রেট খেকে শুরু করে আর্স্টিস্ট, খেলোয়াড়, ধর্মতাত্ত্বিক, গায়িকা -কী না হতে চায় ওরা!
আশ্চর্য হলাম খেয়ার মুখে শোনা গবেষক শব্দটি শুনে! সায়েন্টিস্ট মানে যে বিজ্ঞানাী বা গবেষক এবং গবেষকের কী কাজ সেটি জেনে আমরা রীতিমত বিস্মিত। ও নিজে হতে চায় সায়েন্টিস্ট আর সে জানেও সায়েনটিস্ট এর কাজ কী! অন্যান্য পেশায় গিয়ে ওরা কী ভূমিকা রাখতে চায় দেশ ও সমাজের সেগুলোও শুনলাম গভীর আগ্রহ নিয়ে।
এরপর আমরা বললাম, নিজের লালিত স্বপ্নটাকে চুরি হতে না দিতে। কোনো পেশাই ছোট নয়। একজন আর্টিস্ট হতে চাইলে যে আমরা হাসি, আর সেটি যে ভুল তা প্রমাণ করে দিল এরিক দু’টো কার্টুন দেখিয়ে। ওরা কি নিখুঁতভাবে বর্ণনা করল কার্টুনের মূল বক্তব্যগুলো!
আমি প্রশ্ন করলাম, তোমাদেরকে যদি বলি যে তোমরা কি কেউ নাপিত হতে চাও? সবাই হু হু করে হেসে উঠলো। আমি তখন শোনালাম বাংলাদেশী ব্যক্তি, অন্যতম বিশ্বসেরা হেয়ার কাটার জায়েদ হাবিবের নাম। ওরা তো শুনে মহা বিস্মিত! চুল কাটাও যে একটা মূল্যবান পেশা হতে পারে সেটা ওরা জানতই না।
এমন অজস্র কথপকথনে মুখরিত সময় পার হতে হলো। রিয়া শুনালো নিজের কণ্ঠে গান। আমরা আলাপ করছিলাম দেশ, জাতি ও মানবপ্রেম নিয়ে। আমাদেরকে অবাক করে দিয়ে এক মেয়ে বলে উঠলো, স্যার, আমাদের তো মানুষের পাশাপাশি পশু-পাখিদেরও ভালবাসা উচিত। ওর কথায় আমাদের চক্ষু চড়কগাছ! আলোচনার স্রোত গেলো ঘুরে। আমরা সর্বজীবে প্রেম থেকে প্রকৃতি প্রেম নিয়ে কথা বললাম। বললাম আজকের পরিবেশ দূষণ ও জলবায়ু পরিবর্তনের পেছনে প্রকৃতি প্রেমের অভাব কতটা দায়ী।
আমরা কথার জোয়ারে ভাসলাম, আমরা আদরের ছোয়ায় পুলকিত হলাম, আমরা ভালবাসায় অভিসিক্ত হলাম। এই অবহেলিত, বঞ্চিত শিশুদের সুপ্ত অগ্নিগিরীগুলোকে কেবল একটু করে মোমের কোমল শিখার মত সুযোগের শিখা ছুঁয়ে দিলেই দাউ দাউ করে জ্বলে উঠবে একটি আশ্চর্য স্বপ্নাতুর প্রজন্ম। ওরা পারবে। আমরা পারবো তো ছোঁয়াতে সেই কাঙ্খিত আগুণের পরশমণি!