“যে নদীর সঙ্গে শৈশব জড়িয়ে থাকে, যে নদীকে একসময় প্রায় বন্ধুর মতো মনে হয়, তার জন্যে যে ভালোবাসা তা আজন্ম থেকে যায়”
— সমরেশ মজুমদার (আত্মকথায় সমরেশ)
সমরেশ মজুমদারের সাথে সহমত পোষন করেই বলছি— আমারও বন্ধুর মতো এক নদী ছিল। সুযোগ পেলেই যার কাছে ছুটে যেতে মন উচাটন হতো। সে নদী এখন মুমূর্ষু, দখল দূষণে মৃত্যুর প্রহর গুনছে। সে নদীর জন্য আমার আজন্ম ভালোবাসা। সে নদীকে আমি লালন করি অস্তিমজ্জায়। আমার শৈশবের ছোটনদী, আমার খানিক আনন্দ আশ্রয়। সে নদীর জলে পা ভেজাতে এখনও বসতে ইচ্ছে করে, নদী তীরের সবুজ ঘাসের গালিচায়।
গাজীপুরের শ্রীপুরে রাথুরা শালবনের ভেতর দিয়ে প্রবাহিত প্রাকৃতিক এক জলাভূমির নাম লবণদহ বা লবলং সাগর (নদী)। শোনা যায়, বাদশা বদিউজ্জামালের জাহাজ ডুবে গিয়েছিল এই লবলং সাগরে। এ নিয়ে স্থানীয় পুঁথিপালাতে বলে,
ডুবল জাহাজ লবলং সাগরে/ জামাল রূপে পাগল হইয়া/ডুবল জাহাজ লবলং সাগরে ।
গাজীপুরের শ্রীপুরের লবলং সাগর (নদী)। ইতিহাস থেকে জানা যায়, এটি এক সময় উচ্ছ্বল প্রাণবন্ত এক নদী ছিল। এক সময় এ নদী দিয়ে চলত পালতোলা নৌকা, মাঝির কণ্ঠে শোনা যেত আকুল করা গান। এই নদী ময়মনসিংহ জেলার ভালুকা উপজেলার ক্ষীরু নদীর সংযোগস্থল থেকে উৎপত্তি হয়ে আঁকাবাঁকা দীর্ঘ পথ অতিক্রম করে মীর্জাপুরের কাছে তুরাগ নদে গিয়ে মিশেছে। লবণদহের বিবরণ নেই সরকারি নথিতে। কিন্তু এই লবণদহকেই গাজীপুরের ইতিহাস গবেষক ফরিদ আহমদ প্রাচীন ‘লৌহিত্য সাগরের’ একটি ধারা বলে দাবি করতে চান। তার মতে, নিশ্চয়ই সমুদ্রের সঙ্গে সংযোগ ছিল এই দহের এবং দহের পানি লবণাক্ত ছিল বলেই এর নাম হয়েছিল লবণদহ। তিনি বলেন, লবণদহের দুটি ধারার একটি নরসিংদী দিয়ে ভৈরবের কাছে গিয়ে মেঘনায় মিলিত হত। অন্যটি বর্তমানে নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁওয়ের কাছে পুরাতন ব্রহ্মপুত্র দিয়ে সমুদ্রে যুক্ত হত। ভূগোলের ছাত্র ও শিক্ষক এই গবেষকের মতে, লালমাটির এই উঁচু ভূমিতে ভূমিকম্পের ফলে অনেক নদ-নদীর গতিপথ পরিবর্তিত হয়েছে।
অনেক শিল্প-কারখানা গড়ে উঠছে নদীটির বুক চিরে। বর্তমানে এই নদীটির মুমূর্ষু অবস্থা। দূষণ আর বর্জ্যের সাথে লড়াই করে করে সরু খাল হয়ে বেঁচে আছে নদীটি। একদিকে নদী আর ফসলি জমি ভরাট করে তৈরি করা হচ্ছে কারখানা, অন্যদিকে অবশিষ্ট জায়গায় ফেলা হচ্ছে কল-কারখানার তরল ও কঠিন বর্জ্য। কিছুদিন আগেও লবলং এর তীর ঘেঁষা জমিগুলোতে প্রচুর ধান হত।
লবলং নদী ঘিরে আমার শৈশবের অনেক স্মৃতি রয়েছে। যদিও আমি শৈশব থেকেই নদীটিকে দেখছি খাল আকৃতির। লবলং খালের পাশ ঘেঁষে আমাদেরও ধানী জমি ছিল। চাচা কিংবা দাদার সাথে প্রতিবেশী বন্ধুদের নিয়ে দল বেঁধে চলে যেতাম লবলং নদীর পাড়ে। ছোট্ট ছিলাম তাই মায়ের কড়া নিষেধ ছিল, পাথারে যেতে পারিস কিন্তু নদীতে নামবি না। আমাদের এলাকার স্থানীয় লোকেরা লবলং-এর দুপাড়ের এলাকাকে পাথার বলে। ছোট নদীর টলমল জলের কাছে গেলে মন মানতে চাইত না। সাঁতার জানতাম না আর মায়ের নিষেধের কথা ভেবে ভয়ে পানিতে নামা হত না। লবলং-এর পাড়ে পা ঝুলিয়ে বসে থাকতাম। ঝিরি ঝিরি বাতাসে ছোট ছোট ঢেউ এসে তীর ছুঁয়ে যেত। মাছরাঙা হঠাৎ ছোঁমেরে মাছ নিয়ে উড়াল দিত। স্থানীয় অনেকেই জাল ফেলে মাছ ধরত। নদীর পাড়ে বসে বসে এসব দেখতাম আর বার বার পানিতে পা ভিজাতাম— অনেকটাই দুধের স্বাদ ঘোলে মেটানোর মতো। লোকজন কাজে লাগিয়ে দিয়ে দাদা, চাচা ক্ষেতের আলে দাঁড়িয়ে কাজের তদারকি করতেন, সাথে আমাদের খেয়াল রাখতেন। কিছুক্ষণ পর পর দাদা হুংকার ছাড়তেন— সাবধান পানিতে নামিস না, ডুবে যাবি। বর্ষাকালে পাথারের জমি গুলোতে হালচাষ হতো, কখনও কখনও হাঁটুবর কাঁদা মাড়িয়ে লাঙলের পেছন পেছন ছুটতাম মাছ ধরার জন্য। একটি মাছ পেলেই যেন আনন্দের শেষ থাকতো না। লবলং নদীই শৈশবে আমাকে নদীকে ভালোবাসতে শিখিয়েছিল। আজ অবধি সেই নদীপ্রেম যেন রন্ধ্রে রন্ধ্রে বহমান।
লবলং ছিল আমার শৈশবের ছোট নদী—
আমাদের ছোট নদী চলে বাঁকে বাঁকে,
বৈশাখ মাসে তার হাঁটুজল থাকে।
পার হয়ে যায় গরু, পার হয় গাড়ি,
দুই ধার উঁচু তার, ঢালু তার পাড়ি।
ছোট বেলায় রবীন্দ্রনাথের এই ছোট নদী কবিতাটি পড়লেই চোখের সামনে ভেসে উঠতো
প্রিয় লবলং নদী, আমাদের ছোট নদী,
রবীন্দ্রনাথের ছোট নদীর জায়গায়
লবলং কে কল্পনা করতে করতে হারিয়ে যেতাম অন্য এক জগতে।
লবলং ঘিরে রয়েছে আমার শৈশবরের অগণিত স্মৃতি। অগ্রহায়ণ এলেই পাথারে ধান কাটার উৎসব শুরু হত। দাদার সাথে ধান কাটা দেখতে যেতে চাইতাম। না নিয়ে গেলে সে কী কান্না! ধান কাটার পর সোনালী ধানের আটি সারি সারি সাজিয়ে রাখা হত মাটিতে। এক এক করে গরু কিংবা মহিষের গাড়ি বোঝাই করা হত ধানের আটি দিয়ে। সেসব দৃশ্য এখন কেবলই স্মৃতি। এখন ধানের চাষ নেই বললেই চলে, যেটুকু ধান চাষ হয় তার ভেতর ঢুকে যাচ্ছে দূষিত মাটি, পানির বিষক্রিয়া।
মুরুব্বিদের মুখে শুনেছি লবলং নদীতে এক সময় জাল ফেললেই উঠে আসতো হরেক রকম মাছ। এ নদীর মাছ খেতে খুব সুস্বাদু ছিল। আমরাও ছোট বেলায় লবলং নদীর মাছ খেয়েছি। মাছের প্রাচুর্যে ভরা নদীটিতে আজ কোনো জলজ প্রাণীরই অস্তিত্ব আর খুঁজে পাওয়া যায় না। কুচকুচে কালো বর্ণের পানি আর দুর্গন্ধ পরিবেশকে বিষিয়ে দিচ্ছে। এর প্রভাব পড়ছে মানব স্বাস্থ্যে। খালের পাড়ের অনেকটা জায়গাই এখন ময়লা আবর্জনার ভাগাড়। ময়লার স্তুপ জমে জমে খালের মধ্যে পানির চলাচল বিঘ্নিত হচ্ছে। ময়লা পঁচার দুর্গন্ধে দূষিত হচ্ছে বাতাস, আর দূষিত বাতাস আমাদের নিঃশ্বাসের সাথে ঢুকিয়ে দিচ্ছে জীবনক্ষয়ী বিষ। অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে এবং দুষিত মাটিতে জন্ম নিচ্ছে ধানের মতো সব ধরনের ফসল— যা মানুষের স্বাস্থ্যের জন্য খুব ক্ষতিকর। আমরা নিজেরাই নিজেদের নিঃশ্বাসের টুটি চেপে ধরছি। লবলং নদী দূষণের মধ্যে দিয়ে পরিবেশ, কৃষি জমি ও ভূগর্ভস্থ পানি নষ্ট হয়ে যাচ্ছে— এগুলো ধ্বংসের হাত থেকে বাঁচাতে হবে। এই খালটি দিয়েই শ্রীপুর উপজেলার পানি নিষ্কাশন হত। দূষণে জর্জরিত এই নদীটির চিহ্ন ক্রমশই বিলীন হতে চলেছে। যেভাবে এই খাল দখল হয়ে যাচ্ছে, তাতে একসময় শ্রীপুরের প্রধান সমস্যা হবে জলাবদ্ধতা। এসব সমস্যা থেকে উত্তরণের জন্য লবলংকে বাঁচাতে হবে।
শুধু লবলং খাল নয়, সারা দেশে এ রকম অনেক খাল, নদ-নদী দখল-দূষণের কবলে পড়ে হারিয়ে যাচ্ছে। খাল ও নদীর তীরে স্থাপিত শিল্প-কারখানার বর্জ্যে বিষাক্ত হচ্ছে পানি। প্রিয় লবলং সহ দেশের সকল নদী ও খাল মুমূর্ষু অবস্থা থেকে প্রাণ ফিরে পাক— এটাই আমাদের প্রত্যাশা। আশার কথা হলো যে, নদী রক্ষায় অনেকেই সচেতন হচ্ছে, শ্রীপুর শাখার নদী পরিব্রাজক দল সহ অনেক সামাজিক সংঘগঠন লবলং সাগর (নদী) রক্ষায় কাজ করছে।