প্রথম ছবিটি ছোট্ট সাধারণ এক খেটে খাওয়া মানুষের বসত বাড়ী। সামনে খাল, পিছনে পানিতে ডুবে যাওয়া মাঠ। এক চিলতে নীচু জমিতে বসবাস জেহাদের পরিবারের। হ্যাঁ,ডেমার কাশিমপুরের জেহাদ— ১১ বছরের ছোট্ট শিশু, যে তার হৃদযন্ত্রের ছিদ্র সারাতে ঢাকায় গিয়েছিল বড় আশা নিয়ে, কিন্তু ফিরে এসেছে করোনার অভিশাপ সাথে নিয়ে।
জন্ম হতেই তার এই রোগ— ভিএসডি। একটু দৌড়ালে হাফিয়ে যেত, কাশি উঠে যেত। খেলতে পারত না, ছুটতে পারত না জেহাদ। গ্রাম্য টোটকা চিকিৎসাই ছিল এগারো বছর ধরে ভরসা!
এপ্রিলের প্রথম দিকে জ্বরে ধরলে আর কমে না, শ্বাস কষ্ট বেশি। এপ্রিলের মাঝামাঝি জিহাদের গরীব বাবা ধারদেনা করে যায় খুলনার এক প্রাইভেট হাসপাতালে দালালের পরামর্শে। এগারো বছর পর জানা গেল জিহাদের হৃৎপিণ্ডে আছে জন্মগত ত্রুটি। হায়রে আমাদের গালভরা প্রান্তিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা, হায়রে শত কোটি টাকার ডিজিটাল হেলথ ভিডিও কনফারেন্সের আড্ডাবাজি, জেহাদের এগারো বছর লেগে গেল তার এই হৃৎপিণ্ডের রোগের কথা জানতে!!
মাঝ এপ্রিলে খুলনা বেসরকারি হাসপাতালের এক বে আক্কেল তাকে পাঠায় ঢাকা হৃদরোগ হাসপাতালে। শুধু ভাবুন— জেহাদের দিন মজুর বাবা মা তাকে এই করোনাকালে কীভাবে ঢাকায় নিয়ে গেল! সন্তানের হৃৎপিণ্ডটা অপারেশন হলে ভালো হয়ে যাবে, তাই আরো ধারদেনা করে ঢাকায়।
বিশাল ঢাকার জাতীয় হৃদরোগ ইন্সটিটিউটের বিশাল প্রাঙ্গণে এরকম জিহাদের বাবাদের খোঁজ কে রাখে বলতে পারেন? সারাদিন ঘুরে ফুটপাতের দোকানে খেয়ে শত মানুষের স্পর্শ আর ছোয়াছুয়ির পর দালাল ধরে জেহাদের ঠাই মেলে বড় হাসপাতালের কোণে। আবার জেহাদের বাবার ধারদেনার বোঝা বাড়ে, শ্বাস কষ্ট বাড়ে জেহাদের, ডাক্তার বলে বাড়ী যাও, করোনাকাল কেটে গেল এস, হবে অপারেশন।
পরদিন বাড়ী ফিরে আসে জেহাদ। নিয়ে আসে অভিশাপ— করোনা! না, জেহাদ পালিয়ে আসেনি, হাসপাতাল কতৃপক্ষের ছাড়পত্র নিয়েই সে এসেছে। দিনমজুর বাবা তাকে বুকে আগলে ফিরিয়ে এনেছে তাদের এক চিলতে নিজ ভুইয়ে!
এক দিন পর তাদের বাড়ীতে শহরের কর্মকর্তাদের উপস্থিতিতে তারা জানতে পারে তাদের এই করোনা অভিশাপের কথা। এখন তারা গৃহে অন্তরিণ। সাহায্য মিলেছে— চাল, ডাল, তেল, কুমড়া, মশলা। ঔষধ কেনার পয়সা নেই, পুস্টিকর খাবারের সংস্থান নেই, ধারদেনাতে আকণ্ঠ, তা শোধবার উপায় নেই।
আমি জানি তবু বেঁচে থাকবে জেহাদ, মৃত্যুকে সাথে করে এগারো বছর লড়ে যে টিকে আছে, সে জিতবেই, হারবে না আর। হায় আমার স্বাস্থ্য ব্যবস্থ্যার বাগাড়ম্বর, একজন শিশু বুকের ভেতর মৃত্যু নিয়ে লড়ে যায় নিরন্তর, জানতেই পারে না কী হয়েছে তার।
তার বাড়ীর সামনে খাল, একটা বাঁশের সাঁকোও নেই সেখানে, প্রতিবেশীর বাড়ীর সামনে এক বাঁশের সাঁকো পার হয়ে আরেকটা বাশের সাঁকো পার হয়ে জেহাদদের চলাচল। লাল পতাকা দিয়ে তাদের সীমাবদ্ধ জীবন এখন আরো গন্ডিবদ্ধ!
করোনা চিহ্ন এই লাল পতাকা উঠে যাবে, মানুষ বিজয়ী হবে, জিতবে জেহাদও। আমি প্রশ্ন রেখে যেতে চাই আমাদের স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনার মাতব্বরদের কাছে— স্বাস্থ্য বিভাগের প্রান্তিক ব্যবস্থাপনার সাফল্য নিয়ে সারাক্ষণ মুখে ফেনা তুলে ফেলা অর্বাচীনদের কাছ!
ডিজিটাইলেজেশনের শত কোটি টাকার টেন্ডার হয়ে যায় নিরবে, এক পর্দা কেনা হয় লক্ষ লক্ষ টাকায়, শত কোটি টাকার আধুনিক যন্ত্র পড়ে নস্ট হয় গুদামে, আমাদের জেহাদ কেন তার হৃৎপিণ্ডের ছিদ্রের কথা এগারো বছরেও জানতে পারে না? কেন তার শৈশব কৈশোর কেটে যায় না খেলে, হাঁপিয়ে?
কেন অসুস্থ বালক হৃৎপিণ্ডের ক্ষত সারাতে বসে রবে বিশাল অট্টালিকার বারান্দায় আর প্রাঙ্গনে সারাদিন! কেন সুস্থ হতে এসে সে ফিরে যাবে আরেক ঘাতক ব্যাধি শরীরে নিয়ে?
তাকে দেখে ফিরে আসার সময় হতে আত্মদংশনে ভুগছি। চিকিৎসক হিসেবে, একজন সমাজকর্মী হিসেবে, একজন রাজনৈতিক কর্মী হিসেবে, স্বাস্থ্য সেবা আন্দোলনের একজন কর্মী হিসেবে মনে হচ্ছে আমরা পরাজিত। স্বাস্থ্য খাতের পরিকল্পনা আজ যাদের হাতে তারা জনবিচ্ছিন্ন, চাটুকার আর দালালরা সব অর্জন ধ্বংস করে দিচ্ছে!
দ্বিতীয় ছবি— জেহাদ, জেহাদের বোন এবং আমি। পিছনে ডুবে যাওয়া মাঠ, ‘ভেন্নাপাতায়’ ছাওয়া জেহাদের মায়ের রান্নাঘর! মা, বোন কেউ মাস্কও পরে ছিল না!
চিকিৎসক এবং সমাজকর্মী