তাইফুর রহমান প্রতীক আমার ভাই। আমি আমার ভাই হত্যার বিচার চাই…। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, মাননীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, মাননীয় শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি মহোদয়ের কাছে নিম্নে উল্লেখিত বিষয়ে আপনাদের সদয় দৃষ্টি আকর্ষণ করছি…।
সে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (শাবিপ্রবি) জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড বায়োটেকনোলজি (জিইবি) বিভাগে অনার্সে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম স্থান অধিকার করেও শিক্ষকদের চক্রান্তের শিকার। তাইফুর রহমান প্রতীক- নামটি আমাদের পরিবারে এখন শুধুই স্মৃতি। একজন হতভাগা বোন চোখের জলে ভেসে আজ আপনাদের কাছে তার ভাইয়ের আত্মহত্যার দিকে যারা ঠেলে দিয়েছে তার বিচার চায়। কারণ আমি চাই না আমার মত কেউ ভাই হারাক…।
আমার পরিবার আজ যন্ত্রণায় কাতর। ভাইকে অন্ধকার কবরে শুইয়ে এসে ভাইকে নিয়ে লিখছি আজ। একটি বিভাগের শিক্ষকরা একজন মেধাবী ছাত্রের সাথে যে বিমাতৃসুলভ আচরণ করে কীভাবে তিলে তিলে আমার ভাইকে আত্মহত্যার দিকে ধাবিতে করেছে তা আপনাদের লিখছি। আমার জীবনে আজকের এই লেখার মত কঠিন লেখা কোনদিন লেখেনি।
আমার ভাই নরসিংদীর ব্রাহ্মন্দি কে কে এম সরকারী বালক উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি ও ঢাকা সিটি কলেজ থেকে এইচএসসিতে জিপিএ ৫ অর্জন করে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়। শাবিপ্রবির জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড বায়োটেকনোলজি (জিইবি) বিভাগে ভর্তি হয়। তার স্বপ্ন ছিল শিক্ষক ও গবেষক হওয়ার। সে অনার্সে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম স্থান অধিকার করে। তার অনার্সের সুপারভাইজার ছিলেন তখনকার বিভাগ প্রধান অধ্যাপক আজাদ।
জিইবি বিভাগে গত নিয়োগে অনার্সে ১ম ছাত্রকে শিক্ষক হিসেবে নেয়া হয়েছে। কিন্তু এবার তারা বিজ্ঞাপনে উল্লেখ থাকা সত্ত্বেও কেন ভাইভা কার্ড দেননি? আমরা কিন্তু সে বিষয়ে কোন কিছু বলিনি। আমার ভাই কেবল অভিজ্ঞতা অর্জনের জন্যই আবেদন করেছিল। একজন সুপারভাইজার কীভাবে তার ছাত্রকে আবেদন করতে মানা করতে পারে? … এই প্রশ্নের উত্তর আমার শিক্ষকতা জীবনের অভিজ্ঞতায় নেই। তবু আমরা সেটি হাসি মুখে মেনে নিয়েছি। আমাদের পরিবার থেকে আমার ভাইকে পড়াশুনা করতে বলা হয়েছে।
অধ্যাপক আজাদের ল্যাবে আমার ভাইয়ের থিসিসের কাজ চলমান ছিল। অধ্যাপক আজাদের আদেশে জুনিয়র শিক্ষার্থীদের কাজ শিখাচ্ছিল আমার ভাই। সেই সময় তার মানা সত্ত্বেও লেকচারার পোস্টে আবেদন করায় তিনি তাকে সুপারভাইজিং করতে অস্বীকৃতি জানান। বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের বাইরে একটি সিএনজির আঘাতে ঘটা দুর্ঘটনাকে জোর করে বিভাগের ইস্যু বানিয়ে ফেলেন। বিভাগের শিক্ষকরা অধ্যাপক আজাদের নেতৃত্বে আমার ভাইকে সুপারভাইজর না দেয়া, রেফারেন্স না দেয়ার জন্য বিভাগের একাডেমিক কমিটি সিদ্ধান্ত নেন। এই ধরণের সিদ্ধান্ত নিতে পারে বলে আমার শিক্ষকতা জীবনে দেখিনি।
যখন আমার ভাই এবং আমার পরিবারের সদস্যরা বুঝতে পারলেন যে শিক্ষক হিসেবে আবেদনের জন্যই বিভাগের কতিপয় শিক্ষক বিভিন্ন রকম ইস্যু তৈরি করছে। তখন এই বিষয়ে দোষ না থাকা সত্ত্বেও ক্ষমা চেয়ে এসেছেন আমার পরিবার।
আমরা মাননীয় ভিসি মহোদয়ের কাছেও পরিবারের পক্ষ থেকে ক্ষমা চেয়ে আমার ভাইকে একজন সুপারভাইজার দিতে অনুরোধ করি। তিনি আমাদের অনুরোধ রেখে বিভাগের তখনকার প্রধান অধ্যাপক আজাদকে অনুরোধ করেন। যেই বিনীত অনুরোধ আমার ভাইয়ের জীবনে বুমেরাং হয়ে ফিরে আসে। বিভাগ লোক দেখানো তদন্ত কমিটি গঠন করে আমার ভাইকে ডেকে নিয়ে ভিসি মহোদয়ের অনুরোধের ফোনকে আমাদের ক্ষমতা দেখানো বাজে পরিবার, আমাকে কুশিক্ষকের মতো কথা আমার ভাইকে শুনিয়ে তার মনোবল ভেঙ্গে দেয়া হয়।
এমনকি তদন্ত কমিটির নামে আমার ভাইকে ডেকে সুপারভাইজার দেয়া হবে না, রেফারেন্স লেটার দেয়া হবে না বলে আবারো হুমকি দিয়েছেন কতিপয় শিক্ষক। যে সকল ছাত্ররা আমার ভাইয়ের সাথে মিশে তাদের ডেকে নিয়ে আমার ভাইয়ের সাথে মিশলে তাদের দেখে নেয়া হবে- এমন হুমকি দেয়ার কথা নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক অনেকেই জানিয়েছেন।
আমার প্রশ্ন হল, এটা কীসের তদন্ত কমিটি? বিশ্ববিদ্যালয় এলাকার বাইরে সিএনজির ধাক্কায় সংঘটিত দুর্ঘটনার জন্য বিশ্ববিদ্যালয় একজন ছাত্রকে কেন ভিকটিম বানানো হবে? সিএনজি ড্রাইভারের অপরাধের শাস্তি কেন তাইফুর রহমান পাবেন?
উল্লেখ্য, সেই দুর্ঘটনায় আমার ভাইয়ের পায়ে জটিল ফ্রেকচার হয়, শরীরের বিভিন্ন জায়গায় সেলাই লাগে। আমার ভাইয়ের পেছনে যে জুনিয়র ছিল সে মাথায় আঘাত পায়। আল্লাহর রহমতে সে এখন সম্পূর্ণ সুস্থ। বিভাগের বলায় আমার পরিবার সেই জুনিয়র শিক্ষার্থীর জন্য ৫০ হাজার টাকা চিকিৎসা খরচ পাঠায়। আমার পরিবার একবারের জন্যও জিজ্ঞাস করেনি সিএনজি ড্রাইভারের দোষ তবু আমরা কেন টাকা দেব। আমার পরিবার ছেলের পড়ালেখা চলমান রাখার দুশ্চিন্তায় সাজানো ইস্যু সত্ত্বেও সকল অপমান সয়ে ক্ষমা চেয়ে আসে।
আমার ভাইও নিজের দোষ না থাকা সত্ত্বেও দিনের পর দিন ভাঙ্গা পা নিয়ে লেংড়িয়ে লেংড়িয়ে গিয়ে শিক্ষকদের পায়ে ধরে ক্ষমা চেয়ে, লিখিত ক্ষমা চেয়েও মাফ পায়নি শিক্ষকদের কাছে। কী এমন অপরাধ যে তাঁর ক্ষমা নেই?
আমি নিজে একজন শিক্ষক তবু আমি এটি বুঝতে পারিনি। মাননীয় ভিসি মহোদয়ের কাছে ভাল সাজানোর জন্য তখনকার বিভাগ প্রধান অধ্যাপক আজাদ আমার ভাইকে লিখিত ক্ষমা চেয়ে সুপারভাইজর দেয়ার আবেদন করে। সেটি নিয়ে একাডেমিক কমিটির মিটিং হয় এবং সিদ্ধান্ত হয় যে আমার ভাইকে কোন সুপারভাইজর দেয়া হবে না। ততদিনে প্রায় মাস তিনেক গড়িয়ে গেছে। আমার ভাই ভাঙ্গা পা নিয়ে প্রতিদিন বিভাগে যায়, ক্ষমা চায়। তাকে কুকুরের মতো দূরদূর করে তাড়িয়ে দেয়া হয়।
একটি বিষয় খুলে বলা দরকার, তখনকার বিভাগ প্রধান অধ্যাপক আজাদ আমার ভাইয়ের অনার্সের সুপারভাইজর। চলমান থাকা ল্যাবের কাজ শিক্ষক হিসেবে আবেদন করায় সে তার উপর ক্ষিপ্ত হয়। আমার ভাইকে তার চলমান গবেষণাকে থামিয়ে দিয়ে তাকে ল্যাবে আসতে নিষেধ করে। এর আগ পর্যন্ত তিনি আমার ভাইকে কাজ চলমান রাখতে বলে। বিভাগের নিয়মমতো তিনি অনার্সের প্রথমকে মাস্টার্সে নিয়ে থাকেন। শিক্ষক হিসেবে আবেদন করায় তিনি আমার ভাইকে হঠাৎ না করে দিয়ে দ্বিতীয়কে নেন। আমার ভাই মারা যাওয়ার পর সাংবাদিকরা প্রশ্ন করলে তিনি বলেন তিনি কেবল একজনকে নিতে পারতেন। তাই তিনি আমার ভাইকে নেননি। আমার প্রশ্ন প্রথমকে রেখে দ্বিতীয়কে কেন নেবেন? আর নিলেও শুরুতে আমার ভাইকে নিয়ে ল্যাবে কাজ চলমান রাখতে বলেন কেন?
আপনি খেয়াল করুন, যখন বিভাগের প্রধান তার নিজের ছাত্রকে আর সুপারভাইজ করবেন না বলেন, তখন অন্যরা কেন তাকে সুপারভাইজ করবে? এটি তো অন্য শিক্ষকদের প্রতি একধরণের নেতিবাচক ইঙ্গিত দেয়া। তার মানে ভিসি মহোদয়কে আইওয়াশ ও ১ম শ্রেণিতে প্রথম একজন ছাত্রের মূল্যবান সময় ও শিক্ষাজীবন নষ্ট করা।
বলা দরকার যে তার দুর্ঘটনার সাতদিন আগেও অধ্যাপক আজাদের জন্মদিনে আমার ভাইকে পাশে জড়িয়ে ধরে কেক খাওয়ানোর হাস্যোজ্বল ছবি আমি ফেসবুকে দেখেছি। একজন ছাত্র সাতদিন আগেও বেয়াদব ছিল না। সাতদিন পরে কীভাবে খারাপ ছেলে হয়ে যায়? ধরুণ ছাত্রটি চরিত্রহীন, মাদকসেবী, বেয়াদব তাহলে এটি কী শিক্ষকের অভিভাবক হিসেবে দায়িত্ব নয় তাকে ভুল ধরিয়ে দেয়া ও শাসন করা?
চরিত্রহীন, মাদকসেবী এই দুটি শব্দ আমার লেখার কারণ হল আমার ভাই মারা যাওয়ার পর আমরা পরিবার থেকে প্রশ্ন তুলি কেন দেয়া হল না সুপারভাইজর? কেন বলা হল রেফারেন্স লেটার দেয়া হবে না?…এ প্রশ্নের উত্তরে মারা যাওয়া মানুষকে নিয়ে রিউমার ছড়াতেও তাদের শিক্ষক সত্ত্বায় বাঁধছে না।
এমন কি বিভাগের ছাত্রদের কাছে শুনতে পেলাম এখন তারা নাকি পকেটে রেফারেন্স লেটার নিয়ে ঘুরছেন…ছেলেটাকে সুপারভাইজার দিলেন না, থিসিস ছাড়া মাস্টার্স করতে গেল তাকে ২০ নম্বরে ২, ১০ নম্বরে শূন্য দিলেন, ছেলেটা সব কষ্ট মুখ বুঝে মেনে নিয়ে জিআরই দিল বিদেশে পড়তে চলে যাবে বলে, আপনারা তাঁকে রেফারেন্স লেটার দিতেও ঘুরালেন? এখন কেউ কেউ দাবি করছেন রেফারেন্স লেটার দিয়েছেন। যার তারিখ নিয়ে আমাদের পরিবারের সন্দেহ রয়েছে। আপনি এরপরও নিজেকে শিক্ষক দাবি করেন? কীভাবে করেন?
আমি কিছুতেই মনকে বুঝাতে পারছি না, প্রথম শ্রেণিতে প্রথম একজন ছাত্রকে সুপারভাইজর না দেয়া, রেফারেন্স না দেয়ার বিভাগের সিদ্ধান্ত, মাস্টার্সের ২০ নম্বরের পরীক্ষায় ২ দেয়া, ১০ নম্বরের পরীক্ষায় শূন্য দেয়া.. এগুলো শিক্ষক হিসেবে তারা কীভাবে করলেন?
এমন কী আমার ভাই মারা যাওয়ার পর তার বিভাগের যে শিক্ষকরা আমার ভাইকে আত্মহত্যার দিকে ধাবিত করেছে তাদের কেউ দেখতে আসেননি। অধ্যাপক আজাদসহ আমার ভাইকে তিলে তিলে মৃত্যুর পথে ঠেলে দেয়া তদন্ত কমিটির কেউ আমার পরিবারকে সান্ত্বনা দিতে আসেননি। আমি নিজে শিক্ষক হয়ে লজ্জিত। কী দোষ ছিল আমার ভাইয়ের? বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক হতে আবেদন করাই কী তাঁর একমাত্র অপরাধ?
আমার ভাই আজ নেই। আমার হারানোর কিছু নেই। কিন্তু আমি চাই না আমার মত কেউ ভাই হারাক। আমরা অপেক্ষা করছি তদন্ত কমিটির রিপোর্টের জন্য, এটি হত্যা নাকি আত্মহত্যা তা হয়ত জানা যাবে। তবে শাবিপ্রবির জিইবি ডিপার্টমেন্ট আমার ভাইয়ের সাথে একাডেমিক যে বিমাতৃসুলভ আচরণ করেছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন তার বিরুদ্ধে যথাযথ পদক্ষেপ নিবে এটি আমাদের পরিবারের দাবি। আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে অনুরোধ যেন আমার ভাই তার যথাযথ বিচার পায়।
লেখক: প্রতীকের বোন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক।