বিভিন্ন পেশার মানুষের, বিশেষ করে সাংস্কৃতিক কর্মী এবং রাজনীতিকদের আড্ডার স্থান ছিল পুরান ঢাকার বিউটিবোর্ডিং। এখানে এক সময় যাতায়াত করতেন নেতাজী সুভাস চন্দ্র বসু, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, কর্নেল অলি আহাদের মত যুগান্তকারী রাজনৈতিক ব্যাক্তিত্ব। বিউটি বোর্ডিংয়ের এ ক্যান্টিনে বসেই চায়ের কাপে আড্ডার ঝড় তুলতেন নির্মলেন্দু গুণ, শহীদ কাদরী, কবি শামসুর রহমান ও শামসুল হকের মত কবি সাহিত্যিকেরা।
আড্ডার পাশাপাশি এখানে চলতো বিতর্ক, সাহিত্যচর্চা, মতবিনিময় সভা। ঢাকার ইতিহাস-ঐতিহ্যের বড় একটি অংশ হিসেবে এখনো কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে বিউটি বোর্ডিং। ১ নং শ্রীশ দাস লেনে (বাংলাবাজারের কাছে) বিউটি বোর্ডিংয়ের দোতলা বিল্ডিংটি ১৯৫০ সাল থেকে এখনো মাথা উচু করে দাড়িয়ে আছে পুরান ঢাকার বুকে।
বিউটি বোর্ডিংয়ের প্রতিষ্ঠাতা প্রহল্লাদ সাহা একজন ব্যবসায়ী ছিলেন। তিনি পশ্চিমবঙ্গ থেকে তামাক পাতা এনে বিক্রি করতেন। বিউটি বোর্ডিংয়ের বর্তমান বাড়িটিতে আগে সাপ্তাহিক সোনার বাংলার অফিস ছিলো। কবি শামসুর রহমানের প্রথম কবিতা মুদ্রিত হয়েছিল এ পত্রিকায়। পত্রিকাটি ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পর কলকাতায় স্থানান্তরিত হয়। তখন বাড়িটি বিক্রি হবে শুনে প্রহল্লাদ সাহা বাড়িটি কিনে নেন এবং বাড়িটিকে বোর্ডিংয়ে রুপান্তরিত করেন। প্রহল্লাদ সাহার বড় মেয়ের নামে বোর্ডিংটির নামকরন করা হয় বিউটি বোর্ডিং।
১৯৭১ সালের ২৮ শে মার্চ বুদ্ধিজীবীদের আড্ডাস্থল হিসেবে পরিচিত হবার ফলে পাকিস্তানী সেনারা প্রহল্লাদ সাহা সহ বিউটি বোর্ডিংয়ের আরও ১৭ জন বোর্ডার এবং স্টাফকে ব্রাশ ফায়ার করে হত্যা করে। ১৯৪৭ সাল থেকেই বাংলাবাজার ঢাকার মুদ্রন ও প্রকাশনা শিল্পের কেন্দ্রস্থল হিসেবে পরিচিত ছিল আর তাই সে সময় থেকেই বিউটি বোর্ডিং হয়ে ওঠে কবি, সাহিত্যিক ও গবেষকদের আড্ডাস্থল। কিন্তু ১৯৭১ সালে প্রহল্লাদ সাহার মৃত্যুর ফলে থমকে যায় বিউটি বোর্ডিংয়ের পথচলা এবং তার গোটা পরিবার কলকাতায় চলে যায়।
দেশ স্বাধীন হবার পর পুনরায় তারা দেশে ফিরে আসেন। আবার নতুন করে প্রান ফিরে পায় বিউটি বোর্ডিং। বর্তমানে প্রহল্লাদ সাহার ছেলে তারক সাহা ও সমর সাহা দুজন মিলে বিউটি বোর্ডিং পরিচালনা করছেন । বিউটি বোর্ডিংয়ের গেট দিয়ে ঢুকতেই চোখে পড়ে সুন্দর সবুজ লন। লনের পাশে এখনো প্রায় ১৫০ বছরের ইতিহাস, ঐতিহ্য ও অহংকার নিয়ে মাথা উচু করে দাড়িয়ে আছে চিরচেনা বিউটি বোর্ডিংয়ের দোতলা ভবনটি। সামনেই অফিস ঘর ও ক্যান্টিন।
বিউটি বোর্ডিংয়ে এখনো থাকা যায়, ক্যান্টিনে মজাদার বাংলা খাবার খাওয়া্ যায়। রান্না ও পরিবেশনে রয়েছে বিশঃষত্ব। এখনো খদ্দেরের ভিড় লেগেই থাকে। নগরের ভোজনরসিকরা এখানে ছুটে আসেন। আর নিয়মিত খান পুরনো ঢাকার বইয়ের মার্কেটের নানা শ্রেণির মানুষ।
ঐতিহ্যের অংশীদার হতে এবং রসনা বিলাসে কিছু সময় কাটাতে চলে আসতে পারেন পুরনো ঢাকার ১নং শিলিষ দাস লেনে অবস্থিত বিউটি বোর্ডিংএ।