মধু চাষে সফল নারী উদ্যোক্তা সাতক্ষীরার মুন্সিগঞ্জের করুণা রাণী সরদার

করুণা রাণী সরদার

বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে মধু চাষে সাফল্যে পেয়েছেন সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার একমাত্র নারী মৌ চাষী করুণা রানী সরদার (৫২)। গত ১৯ বছর ধরে তিনি দেশের নানা প্রান্তে মৌ বাক্স বাসিয়ে মধু সংগ্রহ করছেন। এই  উদ্যেমী নারী উদ্যোক্তার বাড়ি সুন্দরবন সংলগ্ন মুন্সিগঞ্জ ইউনিয়নের চুনকুড়ি গ্রামে।


করুণা রাণী সরদার

পরিশ্রম ও আগ্রহকে পুঁজি করে দিনের পর দিন এগিয়ে চলেছে সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার এক মাত্র নারী মৌচাষি করুণা রানী সরদার (৫২)। ১৭ বছর যাবত তিনি বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলা এবং উপজেলায় বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ফুল থেকে মধু সংগ্রহের জন্য মৌবাক্স স্থাপন করে মধু সংগ্রহ করে চলেছেন। করুণার বাড়ি সাতক্ষীরার সুন্দরবন সংলগ্ন ইউনিয়ন মুন্সিগঞ্জের চুনকুড়ি গ্রামে। সে ভূপেন্দ্র নাথ সরদারের স্ত্রী। এলাকায় জনপ্রিয়তার কারণে গত কয়েক বছর পূর্বে তিনি ইউপি সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন।
মৌবাক্সোর মাধ্যমে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে লালন পালন করে মৌমাছির স্বাভাবিক জীবন যাপনের সাথে মিল রেখে মৌচাষ করে করুণা রাণী এখন স্বাবলম্বী।

মৌচাষের আয়ের মাধ্যমে করুণা এখন স্বল্প আয়তনের চিংড়ি ঘের মালিক, ইটের গাঁথুনি দিয়ে বাড়ি করেছেন, জমি ক্রয় করেছেন ও সন্তানদের লেখাপড়া শিখিয়েছেন। এ ছাড়া দৈনন্দিন পরিবারের ব্যয় নির্বাহ চালিয়ে যাচ্ছেন।
একদিকে অধিক মুনাফা অর্জন, অন্যদিকে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যের স্বাদ গ্রহণে করুণা রানী মৌ চাষে এগিয়ে আসেন বলে জানান। ২০০৩ সাল থেকে অদ্যবধি এ পেশার প্রতি অতি যত্নবান হয়ে চালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছেন। স্বামী ভূপেন্দ্র নাথ সব সময় তার পাশাপাশি থেকে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে যাচ্ছেন। তার মৌ চাষের খামারের নাম ‘দাদু ভাই’ মৌমাছি খামার। করুণা জানান বিসিক ও প্রশিকার সহায়তায় চার প্রকারের মৌমাছি— ডরসেটা, সেরেনা, ফোরিয়া ও মেলিফেরা জাত নিয়ে মৌ চাষ চালিয়ে আসছেন। বর্তমানে তার ১৭৫টি মৌকলোনি বা মৌ বাক্স আছে। যেখানে মৌমাছির সংখ্যা রয়েছে ১০৫০টি। মধু উৎপাদনের সময় ও ফুল সম্পর্কে বলেন মৌমাছি ফুলের থেকে মধু সংগ্রহ করে যেহেতু সে কারণে বিভিন্ন ফুৃলের সময় বিভিন্ন স্থানে যেতে হয়। নভেম্বর থেকে জানুয়ারী মাস পর্যন্ত সরিষা ফুলের মধু সংগ্রহ হয়। এ সময়ে সিরাজগঞ্জ, টাঙ্গাইল, ঢাকা, মানিকগঞ্জ যেতে হয়। জানুয়ারী, ফেব্রুয়ারী মাসে রাইসরিষা, ধনিয়া, কালজিরা, তিল ফুলের মধু সংগ্রহে শরিয়তপুর, মাদারীপুর, গোপালগঞ্জ, পাবনা, নড়াইল; মার্চ মাসে লিচু ফুলের মধু সংগ্রহে ঢাকা, গাজীপুর, কাপাসিয়া, নাটোর, ঈশ্বরদী, পাবনাসহ অন্যান্য স্থানে যেতে হয় এবং এপ্রিল ও মে মাসে সুন্দরবনের খলিসা, গরান, কেওড়া, বাইনসহ অন্যান্য ফুলের মধু সংগ্রহ করতে হয়। জুন মাসে কালোতিল ফুলের মধু সংগ্রহে ডুমুরিয়া ও অন্যান্যস্থানে যেতে হয়। তিনি বলেন এ সকল কার্যক্রম পরিচালনার জন্য ২জন কর্মচারী রেখেছেন।
মৌচাষের আয় ও ব্যয় সম্পর্কে বলেন যত বেশি মৌ বাক্স বা মৌ কলোনী স্থাপন করা যাবে আয়ের পরিমাণ তত বেশী হবে। নভেম্বর থেকে জুন মাস পর্যন্ত মৌবাক্স থেকে আয় করা সম্ভব হয়। জুলাই থেকে অক্টোবর মাস পর্যন্ত তেমন কোন ফুলের সমারোহ না থাকায় মৌমাছি খাদ্য সংগ্রহ করতে পারে না। এ সময় তাদের কৃত্রিম খাদ্য সরবরাহ করতে হয়। করুণা রানী বলেন দশটি মৌবাক্সোর জন্য সপ্তাহে কেজি করে খাদ্য দিতে হয় যার মূল্য আসে তিনশত টাকা। এভাবে ৫মাস খাদ্য দিতে হয়।
করুণা রানী বেসরকারী সংগঠন বারসিক, প্রশিকা, সুশীলন থেকে এ মৌচাষের জন্য প্রশিক্ষণ পেয়েছেন। তিনি বারসিকের সহায়তায় ভারতের তামিলনাড়ু গিয়ে মোম ও মধু দিয়ে বিভিন্ন দ্রব্য তৈরীর প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেছেন। যেমন মোম দিয়ে লিপজেল, সাবান ও বাম এবং বিভিন্ন প্রকার আচার তৈরীর প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেছেন। তিনি ওয়াইল্ডটিমের সহায়তায় সুন্দরবন সুরক্ষায় অভিজ্ঞতা বিনিময়ের এক সফরে ভারতে গিয়েছিলেন। এ ছাড়া মৌ চাষের পাশাপাশি ম্যানগ্রোভ সুন্দরবন সুরক্ষায় নিজ এলাকায় জেলে বাউয়ালী, মৌয়ালীসহ অন্যান্য পেশাজীবিদের নিয়ে উঠান বৈঠক, আলোচনাসভা ও অন্যান্য অনুষ্ঠানের আয়োজন করে থাকেন। এ জন্য তিনি ওয়াইল্ডটিমের পক্ষ থেকে “বাঘবন্ধু ” উপাধি পেয়েছেন। আরও জানা যায় সমগ্র বাংলাদেশে তিনি একজন মাত্র সফল নারী মৌ চাষি।
করুণা রানী তার মৌ চাষ প্রকল্পের কিছু সমস্যার কথা তুলে ধরে বলেন দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে মধু সংগ্রহ করতে যেয়ে নিরাপত্তার অভাববোধ করতে হয়। উৎপাদিত মধুর সরকারী-বেসরকারীভাবে বাজারজাত করণের ব্যবস্থা না থাকায় ন্যায্য মূল্য পাওয়া যায় না। বিভিন্ন এলাকায় মধু সংগ্রহ করতে গিয়ে সরকারি সহযোগিতা না থাকায় নানান সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়।
উপজেলা কৃষি অফিসার আবুল হোসেন মিয়া বলেন, মৌ চাষি করুণা রানী বাংলাদেশের একটি মডেল। তার সফলতা দেখে অনেক চাষি আগ্রহী হবে। করুণা রানীর সফলতায় কৃষি অফিস পাশে থাকবেন বলে জানান।