মেয়েদের জন্য যে কারণে বাসে সিট বরাদ্দ প্রয়োজন, এমনকি আলাদা বাসও

আলাদা বাস

প্রথমে কয়েকটি প্রশ্ন দিয়ে লেখাটি শুরু করি–

১. আমাদের দেশের বাসগুলো, এমনকি হতে পারে বেশিরভাগ দেশের, কাদের শরীরের উচ্চতা মাথায় রেখে নির্মিত হয়?

২. মেয়েদের যে ধরনের পোশাক পরে আমাদের সমাজ চলাচল করতে বাধ্য করে, তা কি দৌড়ঝাপ করে বাসে ওঠার মতো?

৩. খুব ছোট সন্তান কার কোলে থাকে সাধারণত?

৪. সন্তান নিয়ে চলাফেরা করতে বাধ্য হন সাধারণত কে, মা না বাবা?

৫. পথে ঘাটে ইভ টিজিং কে কাকে করে? ছেলে মেয়েকে নাকি মেয়ে ছেলেকে?

আসলে উপরের প্রশ্নগুলো করার মধ্যে দিয়েই জবাব দেয়া হয়ে গেছে। তারপরেও কিছু বর্ণনার প্রয়োজন রয়েছে। নিশ্চয়ই আপনারা ছোট ছোট গাড়ি, যেগুলো লেগুনা নামে পরিচিত, এই গাড়িগুলোতে উঠেছেন।

একটু খেয়াল করলে দেখবেন, এ ধরনের গাড়িগুলোতে ধরার জায়গা (রডটি) থাকে মাঝখানে এবং বসতে হয় দুই পাশে সারিবদ্ধ হয়ে। এভাবে সারিবদ্ধ হয়ে বসলে, মানে গাড়ির গতির দিকে মুখ করে না বাসলে গতি জড়তা এবং স্থিতি জড়তার কারণে, অর্থাৎ গাড়িটি চলতে থাকলে বামে হেলে পড়তে হয়, এবং হঠাৎ থামলে ডানে হেলে পড়তে হয়।

ফলে বসে থাকলেও রডটি ধরে বসার প্রয়োজন পড়ে। যেহেতু দুই ধারে বসার জায়গা এবং মাঝখানে রড, তাই এক ধরনের হাতাহাতি সেখানে হয়, মানে কে কোনটুকু ধরবে। কোনো মেয়ে যদি সিটে বসা থাকে আপনার সামনে, দেখবেন, পারতপক্ষে সে ঐ রডটি ধরে না। ধরে না দুটি কারণে–

১. তার এ বিশ্বাস নেই অভিজ্ঞতার কারণে যে আপনি তার হাতটি ইচ্ছে করে বারে বারে ছুঁয়ে দেবেন না;

২. হাত উঁচু করে সামনের রডটি ওড়না সামলিয়ে তার জন্য ধরা একরকম দুঃসাধ্য, তখন সে বিপদে পড়ে অাপনার দৃষ্টি হতে নিজেকে সামলাতে।

রড ধরতে না পারায় সৃষ্টি হয় তার জন্য আরেক বাস্তবতা, তাকে সিড়িমিড়ি করে বসে থাকতে হয় যাতে দুই পাসে অন্যদের গায়ে (বেশিরভাগক্ষেত্রে কোনো পুরুষই বসা থাকে পাশে, যেহেতু রাস্তায় চলাচল পুরুষেরাই বেশি করে) হেলে না পড়ে। অর্থাৎ এক ধরনের অস্বস্তি নিয়ে মেয়েরা এ ধরনের গাড়িতে চলাফেরা করে।

একই বাস্তবতা বাসেও। যে উঁচুতে রডটি থাকে সেটি একটি মেয়ের ধরার জন্য বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই উপযুক্ত নয়। বিদেশ থেকে বডিসহ যে বাসগুলো আমদানি করা হয় তাতে হ্যান্ডেল ঝুলানো থাকে, কিন্তু দেশীয় বাসে এ ধরনের ব্যবস্থা নেই। ফলে একজন মেয়েকে দাঁড়াতে হয় বাসের সিট ধরে, যে সিটে হয়ত একজন পুরুষ বসা, তখন ভিড়ের মধ্যে ঐ পুরুষটি যে মেয়েটির শরীরের নিম্নাংশে হাত দিচ্ছে না, তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। 

এর সাথে আছে বাসে নামাওঠার সমস্যা। বহুবার আমি হেলপারকে বলতে শুনেছি- “মহিলা সিট নেই”। অর্থাৎ সে মহিলা যাত্রী তুলবে না, সিট নেই বলে। তার মানে কী দাঁড়াচ্ছে? সংরক্ষিত সিট ঐ কয়টা না থাকলে কোনো মহিলাই হয়ত উঠতে পারত না কোনো কোনো বাসে।

বিষয়টা দৃষ্টিভঙ্গির, একই সাথে বোঝারও। এটা আমি অনেক পুরুষ যাত্রীকে বলতে শুনেছি, “আপনাদের জন্য সংরক্ষিত সিট আছে, “তাহলে পুরুষের সিটে বসেছেন কেন?” অর্থাৎ আমরা অনেকে ধরেই নিয়েছি যে চালকের পাশে আড়াআড়ি নিম্নমানের ঐ চারটি সিটেই শুধু মহিলারা বসবে!

যেহেতু আমাদের দেশের মানুষের শিক্ষাদিক্ষা এবং বোঝার ক্ষমতা এখনও খুব কম, তাই তাদেরকে বুঝাতে হবে। কারণগুলো ব্যাখ্যা করতে হবে। এদেশের মানুষের একটা সমস্যা আছে, “অজ্ঞতা এখানে বেশি অগ্রসর”। তাই খুব সমজে চলতে হয় এদের, বুঝাতে হয় পরোক্ষভাবে, না হলে আরো বেশি করে খারাপটা করে তারা।

তাছাড়া মেয়েদের অধঃস্তন ভাবা এবং মেয়েদেরকে নির্যাতন করার একটা মানসিকতা অনেকের মধ্যে আছে, আসলে এটা  ‍দুর্বল ভেবে কাউকে অত্যাচার করার যে মানসিকতা সেটিরই একটি বৃহত্তর এবং আদীমতম প্রকাশ।

এটা নিশ্চিত, শুধু সামাজিকভাবে খুব দ্রুত দেশের মানুষকে সচেতন করা যাবে না, তাই আইন প্রয়োগের দরকার রয়েছে। মেয়েদের জন্য বাসে সিট শুধু না, আলাদা গাড়ির ব্যবস্থা করার খুব দরকার। প্রত্যেকটা রুটেই, অন্তত এক ঘণ্টা পরপর। ঢাকা শহরে এই ব্যবস্থাটি এখন সময়ের দাবিতে পরিণত হয়েছে।


দিব্যেন্দু দ্বীপ