রাস্তা সমতল না। ভারী গাড়ি চলতে চলতে রাস্তার দুইপাশ ডেবে গিয়ে মাঝখান উচু হয়ে গেছে, ফলে চাইলেও বাস ছোট গাড়িগুলোকে সহজে সাইড দিতে পারে না। রাস্তার পাশের মাটি এবং রাস্তার মধ্যে এক বিঘত উচু নিচু, ফলে ভ্যান গাড়িগুলোকে সহজে চাকা নামাতে পারে না। খুবই দুর্ঘটনাপ্রবন রাস্তা এখন বাগেরহাট-পিরোজপুর সড়কটি। প্রচুর ব্যাটারি চালিত ভ্যান চলে এই রাস্তায়, কার্যত পরিসংখ্যান মতে ঘটনা সংখ্যা হিসেবেই এখানে মারণিক দুর্ঘটনা ঘটবে।
সম্ভাবনার অংকগুলো আমার সবসময় খুব ভালো লাগে। অনেকেই এই অংকগুলো সম্পর্কে ধারণা রাখেন, যেমন ৫২খানা তাসের মধ্য থেকে একটি তাস চোখ বুঝে তুলে নিলে সেটি টেক্কা হওয়ার সম্ভাবনা কতখানি? কতখানি? ১৩ বারে এক বার, তাই না? [মোট তাস ৫২খানা, টেক্কা ৪খানা, এই দুইয়ের আনুপাত থেকে সম্ভাব্যতা পাওয়া গিয়েছে।] তার মানে কি এমন যে আপনি ১৩ বার টানলে টেক্কা একটি আসবেই বা একবার টানলে আসবে না?
হ্যা, দুই চারবার পরীক্ষা করে দেখলে গড় হিসেবে সেটি ১৩ হয়ত হবে না, কিন্তু অসংখ্যবার পরীক্ষাটি করলে সেটি ১৩-এর আশেপাশে হবে, একারণেই ৫২খানা তাসের মধ্য থেকে হাতড়ে একটি তাস নিলে সেটি টেক্কা হওয়ার সম্ভাবনা ১৩বারে ১বার।
জীবনযাপনের ক্ষেত্রেও এটি প্রয়োগযোগ্য। দুর্ঘটনার ঘটার বিষয়টি একেবারেই সম্ভাব্যতা মেনে চলে। ঝড়ের মধ্য দিয়ে ওভারলোডেড লঞ্চ মাওয়া পদ্মা পাড়ি দিলে দুর্ঘটনা ঘটতে পারে, এটি হলো তাত্ত্বিকভাবে দুর্ঘটনা ঘটার সম্ভাবনার কথা বলা। এটি গাণিতিকভাবেও ‘বের করা’ সম্ভব যে, কতবার ঝড়ের মধ্য দিয়ে লঞ্চ ওভারলোড হয়ে চললে একটি দুর্ঘটনা ঘটবে। বাস্তবে গাণিতিকভাবে এটি করে দেখা সম্ভব নয় (পরীক্ষাটি করা সম্ভব নয়), কিন্তু অন্তনির্হীত একটি গাণিতিক হিসাব এখানেও আছে।
অর্থাৎ তাত্ত্বিভাবে যে সম্ভাবনা যৌক্তিভাবে মাথায় আসে সেটি গাণিতিকভাবেও প্রমাণযোগ্য, হতে পারে সেটি প্রমাণ করা আমাদের সাধ্যের বাইরে। সেক্ষেত্রে আমরা বিশ্লেষণে যাই, নিবন্ধ লিখি, যুক্তিবিদ্যা প্রয়োগ করি। সরাসরি গণিত প্রয়োগ করতে পারলে এতসব বিষয় লাগত না।
ঠিক একইভাব বলা যায়, এরকম অল্প প্রশস্ত, ভয়ঙ্করভাবে বুক উচু রাস্তা দিয়ে ব্যাটারি চালিত ভ্যান বেশি গতিতে চললে দুর্ঘটনা ঘটবে। এটি তাত্ত্বিকভাবে বলা হলো। কতবার এভাবে চললে এরকম দুর্ঘটনা ঘটবে, সেটি বের করা সম্ভব নয়, কিন্তু নিশ্চিতভাবে বলা যায় এখানেও একটি গাণিতিক হিসাব রয়েছে। যেখানে অনেকগুলো চলক জড়িত। অল্প প্রশস্ত রাস্তা, ব্যাটারি চালিত ভ্যান, বেপরোয়া গতিতে চালানো, বাস চালকদের মনোভাব ইত্যাদি।
এত শতো না বুঝে এটা তো বোঝা যায় যে, যেহেতু পূর্ব অনুমান করা যায় এসব দুর্ঘটনার, তাই এগুলো ঘটার পরে সেগুলোকে দুর্ঘটনা বলার সুযোগ নেই, বলতে হবে অসতর্কতা এবং হঠকারিতা। আমাদের দেশে আমার ধারণা আশি ভাগ দুর্ঘটনা ঠিক দুর্ঘটনা নয়, কারণ, গাণিতিক হিসাবে সেটি ঘটারই কথা।
এবার আসি যে কারণে এই শিবের গীতটা গাইলাম সেখানে। ভ্যানে করে এই রাস্তা দিয়ে বাগেরহাট যাচ্ছি। এমনভাবে চালক ভ্যানটি চালাচ্ছেন মনে হচ্ছে— এই বোধহয় ভ্যানটি বাসের তলে ঢুকে গেলো! চাক্কা একবার পড়ল রাস্তার নিচে বাস পাশ কাটাতে গিয়ে।
আর চুপ করে বসে থাকা যায় না। চালককে ধমকাতে হবে। এই এলাকার লোক আবার ভিন্ন রকমের, প্রত্যেকে বেপরোয়া স্বভাবের, তাই এরকম ভাবার কোনো কারণ নেই যে, প্যান্ট শার্ট পরা ভদ্রলোক দেখে তারা ছেড়ে কথা বলবে।
ফলে আমি তাকে ভদ্রভাবে বললাম না, কারণ, সেটি কোনো কাজে আসবে না। মোটামুটি বয়স্ক লোক, আমি ‘তুমি’ সম্মোধনে আচ্ছা একটা ধমক দিলাম। ধমকের ওজনে ডরায়ে সে সতর্ক হলো। মানে বাধ্য হলো। একটা ক্ষণস্থায়ী সমাধান হলো।
ইতোমধ্যে ভ্যান থেকে দুজন লোক নেমে গেছে তাদের স্টপজে। ভ্যানের পিছনে বসা ছিল একটা পাঁচ ছয় বছরের ছেলে, আমি ওর দিকে মাঝে মাঝে খেয়াল রাখছিলাম। মনে হচ্ছিল, যে কোনো সময় সে ছিটকে যেতে পারে। ওটি যে ঐ ভ্যানালারই ছেলে তা আমি জানতাম না।
বাগেরহাট ব্রিজে ওঠার সময় ভ্যান থেকে আমার ব্যাগটি পড়ে যায়। ভ্যানালা সাথে সাথে নেমে খুব আন্তরিকভাবে ব্যাগটি তুলে আনে। আমি ভাবলাম, ভয়েই সে আন্তরিক হচ্ছে, যদিও সমীকরণ মিলছে না, কারণ, ভয়ে কেউ আন্তরিক হলে তার মধ্যে এতটা স্বতস্ফুর্ততা থাকার কথা নয়।
বাগেরহাট বাসস্টান্ডে এসে একটু দাঁড়ালাম, বাসে একটা কাগজ পাঠাব বলে। সেখানেও সে খুব অমায়িক, তাকে নিয়ে গেলাম শহরের মধ্যে, সবখানেই সে এখন অন্যরকম। আমার সাথে গল্প জুড়ে দিয়েছে, তার বিভিন্ন সুখ দুঃখের কথা বলছে, আমি শুনছি না, মাঝে হু হা শব্দ করছি, যাতে ‘আমি শুনছি না’ এটা সে বুঝতে না পারে। কারণ, মাথায় বিভিন্ন কিছু রয়েছে ফলে তার গল্প শোনার মতো অবস্থায় আমি ছিলাম না।
তবে এটি বুঝলাম যে, কোনো না কোনো কারণে তার হৃদয় বিগলিত হয়েছে। ‘কারণটি’ অবশেষে আবিষ্কৃত হলো। জানলাম, পিছে বসে থাকা ছেলেটি মূলত তারই ছেলে। আমি যে সারাপথ ছেলেটির দিকে খেয়াল রেখেছি এটি তাকে ছুঁয়েছে, ফলে আমার ধমকটা সে যুক্তি দিয়ে বোঝার অবকাশ পেয়েছে, না হলে ওটি আর পাঁচটি ধমকের মতোই হত। অর্থাৎ শাসন করতে হয়, কিন্তু সেখানে যদি ভালোবাসা না থাকে তাহলে তা কোনো কাজে লাগে না।