মিলনের জন্য ছলনা
নারী পুরুষের ভালোবাসায় জৈবিকতা এবং যৌনতার অবদান কতখানি তা মেপে দেখেছেন অনেক গবেষক। অনেক মানুষের (বিশেষত পুরুষের) সহজ স্বীকারোক্তি থেকে জানা যায় যে, মিলনের জন্যই প্রথম তারা তালবাহানা শুরু করে, এরপর কেউ প্রেমে পড়ে কেউ পড়ে না, কেউ প্রেমে না পড়েও সঙ্গীর প্রতি দায়িত্ব অনুভব করে আবার কেউ তা করে না।
একবার ভাবুন তো এই যে ভালোবাসার এত বাহানা —এর মূলে কী রয়েছে আসলে? একটা কিছু তো আছে, পৃথিবীতে কার্যকারণ ছাড়া তো কিছুই হয় না, হয় কি?
আপনি ভ্যালন্টাইনে কত কী করেন —হাস্যকর সব উপমা, অলংকার, হৃদয় আকৃতরি চকলটে বানানো, মগে প্রিয়ার ছবির ছাপ দেওয়া ইত্যাদি ইত্যাদি কত কী! কেন করেন? মায়ের জন্য কেন করেন না? বোনের জন্য কী এতটা আনুষ্ঠানিক হন আপনি? তাদের জন্য কিন্তু আপনার ভালোবাসা কম নয়, ঠিক না?
অন্যান্য প্রাণীরাও কিন্তু এক্ষেত্রে কম যায় না। প্রাণী জগতে বিয়ের কাজটি সোজাসাপ্টা দৈহিক মিলনের মাধ্যমেই সম্পন্ন হয়। তারা কাজী অফিসে যায় না বা পুরোহিত ডাকে না, আবার বন্ধু বান্ধব ডেকেও খাওয়ায় না, পছন্দ হলে প্রস্তাব দেয় এবং বিছানা পাতে। আবার পছন্দও ঠিক লাগে না অনেক প্রাণীর ক্ষেত্রে, পূর্ণাঙ্গ নারী পুরুষ চোখে চোখ রাখে এরপর মিলিত হয়, অথবা কেউ একজন এগিয়ে আসলেই হয়।
তবে প্রাণীদের মধ্যেও নারীদের আগ বাড়িয়ে এগিয়ে আসার ঘটনা খুবই কম। তাই সামাজিক গবেষণাগুলো পূর্ণাঙ্গ হবে না যদি শুধু মানব সমাজ নিয়ে গবেষণা করে মানুষের মনস্তত্ব বুঝতে চাওয়া হয়, কারণ মানব সমাজ গঠিত হওয়ার অনেক আগে থেকেই এনিমেল সোসাইটি রয়েছে। রহস্যের জট খুলতে হলে সেখান থেকেই শুরু করতে হবে।
মানুষ অন্যান্য প্রাণী থেকে এখন ভিন্ন, ভিন্ন বলেই আমরা মানুষ। তবে ঠিক কতটা ভিন্ন, এবং কীভাবে ভিন্ন, আসলেই ভিন্ন কিনা, সিদ্ধান্ত নিয়ে সচেতনভাবে কতটুকু ভিন্ন হওয়া উচিৎ —এগুলো গবেষণার বিষয়। সভ্যতার বিভিন্ন সমীকরণ, ভৌগোলিক এবং সামাজিক উপকরণ দিয়ে মানুষের ক্ষেত্রে নারী পুরুষের সম্পর্ক বিবেচনা করতে হয়। বস্তুত মানব জীবনের অনেক জটিলতা আছে এই সম্পর্কটিকে ঘিরে। কিন্তু এটি তো হওয়ার কথা ইউনিভার্সেল। বাংলাদেশী নারী পুরুষের সম্পর্কের মোলিক প্যাটার্ন তো আমেরিকার নারী পুরুষের সম্পর্কের মৌলিক প্যার্টার্ন থেকে ভিন্ন হওয়ার কথা নয়, যৌক্তিকভাবে চিন্তা করলে। কিন্তু যেহেতু বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি ছাড়াও অনেক ধরনের সামাজিক (যেমন, ধর্মীয়) চলক এই সম্পর্কগুলোকে এখন নিয়ন্ত্রণ করে, তাই সম্পর্কের ধরণটি পৃথিবীব্যাপী আর একরকম থাকেনি।
জটিলতাগুলো তৈরি হয়েছে মানুষ সভ্যতার শিখরে নিজেকে আসীন করার পর থেকেই। সুস্থতার (সুস্থভাবে বাঁচার আকাঙ্ক্ষা) পরে এসেছে সভ্যতা, এরপর সেখানে যুক্ত হয়েছে শালীনতা। মানুষ এখন বিভ্রান্ত এবং বিব্রত, নিশ্চিত না কোনো বিষয় নিয়ে। ঠিক কী করলে ঠিক হয়, এবং কী করা উচিৎ –মানুষ তা নিয়ে লাগাতার গবেষণা করে চলছে, তর্ক বিতর্কের তো শেষ নেই, যুদ্ধ বিগ্রহও আছে।
নারী পুরুষের সম্পর্কের প্রাকৃতিক দিকটি বোঝার চেষ্টা না করলে এবং অন্যান্য প্রাণীদের সাথে তুলনামূলক আলোচনা না করলে মানব সভ্যতার যৌক্তিকতা এবং সীমা নির্ধারণ করা খুব সহজ এবং স্বাভাবিক হবে না।
বেশি বেশি কাপড় পরলে আপনি ভাবছেন তা শালীন হয়, কিন্তু উল্টো কথাও তো আছে গবেষণায়– কাপড় না থাক শরীরে, কিন্তু মানুষের সভ্যতাই মানুষকে নিয়ন্ত্রণ করবে, এবং এই নিয়ন্ত্রণ মানুষ নিজের ওপর তখনই পাবে যখন সে উন্মুক্ত পরিবেশ দেখে দেখে এবং সেখানে থেকে থেকে অভ্যস্ত হবে।
আলোচনার বিষয় ছিল, মিলনের জন্য ছল করা নিয়ে। নিশ্চয়ই এটা সভ্যতা, ঝাঁপিয়ে পড়া সভ্যতা নয়। প্রশ্ন হচ্ছে, এই বিদ্যা কি হুট করে মানুষ রপ্ত করেছে, নাকি প্রাণীকূলের মধ্যে আগে থেকেই তা ছিল? এটা এখন বড় প্রশ্ন যে, এনিমেল বিহেভিয়ার মানুষের মধ্যে ঠিক কীভাবে প্রতিষ্ঠিত আছে। অনেকের মধ্যে জঙ্গলের প্রাণীদের অনেক আচরণ এবং বৈশিষ্ট প্রকট রূপ লাভ করে আছে কিনা। সেগুলো দমন করার জন্য ঠিক কী রকম সামাজিক ব্যবস্থাপনা দরকার।
ছলনার বিষয়ে কিছু উদাহরণ দেওয়া যাক, তাহলে বোঝা যাবে যে, মানুষের জৈবিক এবং জীবনের অনেক বৈশিষ্ট প্রাকৃতিকভাবে আপনি তার মধ্যে প্রতিষ্ঠিত হয়ে আছে।
যেমন, সঙ্গীকে আকৃষ্ট করার জন্য প্রাণীদের মধ্যেও নানান ধরণরে আনুষ্ঠানিকতা রয়েছে। প্রাণীদরে এই আনুষ্ঠানিকতার নাম ‘র্কোটশপি ডিসপ্লে’। সঙ্গীকে ভুলাতে এবং অন্যকে নিজের অধিকারের কথা জানান দিতে তারা নানান ধরনের ভঙ্গী করে থাক। এক্ষেত্রে ময়ূরের পেখম তোলার কথা সর্বজনবিদীত। তবে অনেকের হয়ত জানা নেই যে, ময়ূর এ কাজটি করে থাকে ময়ূরীকে আকৃষ্ট করার জন্য শুধু, মানুষকে দেখানোর জন্য নয়, বা মেঘ দেখে নৃত্য করাও তার মূল উদ্দেশ্য নয়।
পশ্চিম অস্ট্রেলিয়া এবং নিউ গায়ানাতে এক ধরনের সুন্দর পাখি (birds of paradise, family: Paradisaeidae) রয়েছে যারা সঙ্গীকে আকৃষ্ট করার পাশাপাশি শরীরের (পালকের) রং পরর্বিতন করতে পারে। Paradisaeidae ফ্যামিলি তে অনেকগুলো প্রজাতি রয়ছে, এর মধ্যে Superb Bird-of-paradise (বৈজ্ঞানিক নামঃ Lophorina superba) প্রজাতিটিতে নারী পাখির সংখ্যা পুরুষ পাখির তুলনায় অনেক কম, ফলে পুরুষ পাখিদের মধ্যে প্রতিযোগিতা অনেক বেশী। পুরুষ এবং নারীতে রঙের পার্থক্য খুব স্পষ্ট। পুরুষ পাখিটি কালো, নারী পাখি বাদামী রঙের হয়। ‘স্বর্গের এই পুরুষ পাখিটি’ প্রথমে জোরে একটি ডাক দিয়ে নারী পাখির দৃষ্টি আর্কষণ কর। বুকের এবং গলার মুকুটের মতো রঙীন পালক ফুলিয়ে, কাঙ্ক্ষিত নারী পাখিটির চারপাশে ঘুরতে থাকে মিলিত হওয়ার আশায়।
এতসব আঁকিবুকির পরেও কিন্তু নারী পাখিটির মন পাওয়া যায় না। বৈজ্ঞানিক গবেষণায় দেখা গেছে, পনেরো থেকে বিশটি পুরুষ পাখির মধ্য থেকে নারী পাখি একজনকে বাছাই করে অবশেষে।
ভালবেসে উপহার কে না দেয়? ধনী-দরিদ্র সবাই দেয়। যে যার সাধ্যমত দেয়। আবার সাধ্যের বাইরেও যায় অনেকে প্রত্যাশায় অথবা বিভ্রান্তিতে। বেপরোয়া ভালোবাসাও মানুষকে সীমা লঙ্ঘন করায় হয়ত।
কেউ সোনার আংটি দেয়, কেউ দেয় সিটি গোল্ড। উপহার যাইহোক, উদ্দশ্যে একই— ভালোবাসা প্রকাশ করা। সামার্থের প্রকাশ ঘটানোও উপহার দেওয়ার একটি বড় কারণ।
অমানুষ প্রাণীদরে মধ্যেও ভালবেসে অথবা ভালবাসতে উপহার দেওয়ার রেওয়াজ রয়ছে। অন্যান্য প্রাণীরা সঙ্গীকে আকৃষ্ট করার জন্য সাধারণত কচি পাতা, ফল, ফলের বীজ, ছোট পোকা বা এ ধরনের কোনো খাবার উপহার দেয়। কোনো কোনো প্রাণী খেলনা জাতীয় জিনিসও উপহার দয়ে। কিছু পাখি, পোকা এবং মাকড়শা রয়েছে যারা মিলনের ঠিক পূর্ব মুহূর্তে সঙ্গীকে খাবার উপহার দেয়।
ধরা হয়, মানুষ ব্যতীত অন্যান্য প্রাণীদের মধ্যে দৈহিক মিলনের বিষয়টি শুধু বংশ টিকিয়ে রাখার জন্য, তবে এক্ষেত্রেও ব্যতীক্রম রয়েছে— যেমন, ডলফিন এবং বনবো বানর। ডলফিনরা যৌন সর্ম্পকরে মাধ্যমে বিনোদন লাভ করে থাকে, পাশাপাশি ধর্ষণ করার মতো ঘটনাও ডলফিনদের মধ্যে রয়ছে বলে গবেষকরা জেনেছেন। কয়কেটি পুরুষ ডলফিন একটি মহিলা ডলফনিকে ঘেরাও করে বলাৎকার করে বলে জানা যায়। -চলবে