Headlines

রমজানে খাদ্যাভাস: ভাজা-পোড়ার বিকল্প কী আছে?

বছর ঘুরে আবারো চলে এসেছে রমজান মাস।

রমজান আসার সাথে সাথেই প্রতি বিকেলে পুরনো ঢাকার চকবাজারে শুরু হয়ে যায় ইফতার বিক্রেতাদের হাক-ডাক, আর পুরো রাস্তাজুড়ে ভ্যানে-টেবিলে সাজানো থাকে শত রকমের ইফতারির খাবার।

চিকেন রোস্ট, চিকেন ফ্রাই, শামি কাবাব, সুতি কাবাব, শাহি জিলাপি থেকে শুরু করে হরেক রকম খাবার মিশিয়ে ‘বড় বাপের পোলায় খায়’ নামের অদ্ভূত এক খাবার। কি নেই চকবাজারে!

“সারাদিন রোজা রাখার পর মানুষ একটু ভাজা-পোড়া খেতেই পছন্দ করে।” রমজানে ভাজা-পোড়া খাবার বিক্রির কারণ হিসেবে বললেন চকবাজারের আমানিয়া হোটেলের স্বত্ত্বাধিকারী মোহাম্মদ হানিফ।

মি. হানিফের কথা অবশ্য ভুল নয়। শুধু পুরনো ঢাকার মানুষেরা না, এই এলাকার বাইরে থেকেও মানুষজন চকবাজার থেকে ইফতারি কিনে নিয়ে যান। পুরো মাসে সম্ভব না হলেও, মাসে অন্তত একদিন চকবাজার থেকে ইফতার কিনে বাসায় ফেরেন।

তবে চকবাজারের বাইরেও যেখানেই ইফতারির খাবার কিনতে যান না কেন, সেখানেই পাবেন তেলে ভাজা পেঁয়াজু, বেগুনি, আলুর চপ কিংবা জিলিপি।

কিন্তু সারাদিন না খেয়ে থাকার পর এধরণের খাবার স্বাস্থ্যের ওপর কি প্রভাব ফেলে?

“তেলটা যদি খারাপ হয় তাহলে এসিডিটি থেকে শুরু করে ডায়রিয়া পর্যন্ত হতে পারে। প্রোটিন এবং কার্বোহাইড্রেট জাতীয় খাবার যদি বেশি পোড়ানো হয় তাহলে সেটি আর পরিপাক হয় না।” বলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের খাদ্য এবং পুষ্টিবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক গোলাম মাওলা।

তবে শুধুমাত্র দোকানের ইফতারি নয়, রমজানে বাসায় বানানো ইফতারিতেও থাকে ভাজা-পোড়ার প্রাধান্য।

ঢাকার একজন গৃহিনী আফরোজা শিল্পী বলেন, তার বাসায় ইফতারের মূল খাবার হিসেবে থাকে ভাজা ছোলা, পেঁয়াজু এবং বেগুনী। যদিও এর বাইরে শরবত এবং ফলমূলও থাকে কিন্তু তার তিন শিশুসন্তানের কথা চিন্তা করে পেঁয়াজু-বেগুনির মতো কিছু খাবার বানাতেই হয়।

“এসব খাবারতো আমরা রোজার সময়ই খাই।” মায়ের কথায় সায় দিয়ে বললো কন্যা নিঝুম।

ভাজা-পোড়া বাচ্চারা পছন্দ করবেই। তবে বড়রাও যে পছন্দ করে না তা নয়।

অধ্যাপক মাওলা বলছিলেন, ইফতারের সময় লক্ষ্য রাখতে হবে যে, শরীরে যেন প্রয়োজনীয় পুষ্টি উপাদানের অভাব না হয়। আর সেজন্যে একটি সুষম খাদ্যতালিকা তৈরি করতে হবে।

“আমাদের শরীরের প্রয়োজনীয় ক্যালরি আসতে হবে সুষমভাবে। আমিষ, চর্বি এবং শর্করা সবগুলো থেকেই আসতে হবে।”

“ইফতারে চিকেন স্যুপ খাওয়া যায়, তবে নন-স্পাইসি। কিছু সব্জি রাখতে হবে, ফল-মূল রাখতে হবে। দধিটা শরীরের জন্য খুবই ভাল কারণ এতে প্রোটিন থাকে এবং পরিপাকেও সাহায্য করে। এমন খাবার খেতে হবে যা সহজে হজম হয়।” বলেন অধ্যাপক মাওলা।

বাংলাদেশে ইফতারের এই ভাজা-পোড়া খাবারগুলো কোথা থেকে এলো? সঠিকভাবে কেউ না বলতে পারলেও চকবাজারের শতবর্ষ পুরনো খাবার দোকান, আলাউদ্দিন সুইটমিটের মোহাম্মদ আমিরুদ্দিন বলেন, প্রায় পাঁচ প্রজন্ম আগে তার পূর্বপুরুষেরা এসেছিলেন ভারতের লক্ষ্ণৌ থেকে। তখন থেকেই তারা পুরনো ঢাকায় ইফতারের জন্য এধরণের খাবার বানিয়ে আসছেন।

“ব্রিটিশ আমল থেকেই আমাদের পূর্বপুরুষেরা এভাবেই খাওয়া-দাওয়া তৈরি করতো। সেই ঐতিহ্যই আমরা ধরে রেখেছি।” বলেন মি. আমিরুদ্দিন।

তবে ইফতারের প্লেটে যাই থাকুক না কেন, পুষ্টিবিদদের মতে ইফতারিতে একটি উপাদান সেখানে অবশ্যই থাকতে হবে এবং প্রচুর পরিমাণে থাকতে হবে। সেই উপাদান হচ্ছে পানি।

অধ্যাপক গোলাম মাওলা বলেন, সারাদিন রোজা রাখার ফলে শরীরে যে পানিশূণ্যতার তৈরি হয়, তা অবশ্যই পূরণ করতে হবে।

তিনি বলেন, শরবত, ফলের রস, পানির সাথে গুড় মিশিয়ে কিংবা অন্য যে কোন পানিসমৃদ্ধ খাবার খেয়ে শরীরের পানিশূণ্যতা পূরণ করা যায়।

এদিকে গত কয়েক বছরে ইফতারের পাশাপাশি সেহরিতেও বাইরে খাওয়ার একটি প্রচলন হয়েছে।

ভোররাতেও শখ করে অনেকে ভিড় করেন শহরের রেস্তোরাগুলোয়। যদিও এ সংখ্যা এখনো খুব বেশি নয়।

পুষ্টিবিদ অধ্যাপক মাওলা বলেন, সেহরিতে এমন খাবার খেতে হবে যেটি অনেক্ষন পেটে থাকবে।

“চিড়া-দধিটা ভোররাতের জন্য খুব ভালো খাবার। এর আগে মাছ-মাংস এবং সব্জি খাওয়া যায়। ভোররাতে এর বেশি খাবার দরকার নেই।”

মানুষের মাঝে স্বাস্থ্যসচেতনতা বাড়লেও শুধু স্বাস্থ্যের কথা চিন্তা করে ইফতারে ভাজা-পোড়া খাওয়া একদম বাদ দিয়ে দেবে এমন মানুষ মনে হয় খুজে পাওয়া দুষ্কর।

বিশেষজ্ঞরাও বলছেন, পুরোপুরি বাদ দেয়ার প্রয়োজন নেই, তবে খাওয়া উচিত পরিমিতি বজায় রেখে। রমজানের মূল নীতিতেও আছে যেই সংযমের কথা।


সংবাদটি বিবিসি বাংলা থেকে নেওয়া।