গতরাতে ঝড়-বৃষ্টিতে একটি বাদুড় এসে আটকে গিয়েছিল আমাদের বাগানের জালে, বুকে তার বাচ্চাটা তখনো মায়ের স্তন কামড়ে ছিল, আর দুধ পান করছিল। দুপুরে একজন ঐ পথ দিয়ে যাওয়ার সময় দেখতে পায় এ দৃশ্য। সে বলার পর আমি গিয়ে দেখি, তারপর আব্বুকে ডেকে দেখাই। আব্বু এসে দেখে বাদুড়টাকে জাল কেটে বের করে, আমি আব্বুকে সাহায্য করি। এরপর ওটাকে একটা গাছে ঝুলিয়ে দেওয়া হয় চলে যাওয়ার জন্য। কিছুক্ষণ পর বাদুড়টা সেখান থেকে উড়ে চলে যায় বাচ্চাটাকে বুকে নিয়ে। আব্বু আর আমি খুব খুশি হয়ে দেখছিলাম ওর সুস্থভাবে উড়ে চলে যাওয়া।
আজ দুপুরে এটা দেখে মন ফিরে গেল বিশ-বাইশ বছর পেছনের একটি ঘটনায়। এরকমই একটা ঝড়-বৃষ্টির রাত, সে রাতে আমি আর মা মামাবাড়ি ছিলাম, আব্বু বাড়িতে ছিল। অন্ধকার রাতে ঝড়ে পথ হারিয়ে একটা বড় সারস পাখি উড়ে এসে পড়ে আমাদের বাগানে। সকালে আব্বু পাখিটাকে পায় এবং খুব যত্ন করে ঝাকায় রেখে দেয়। আব্বু বাদে বাড়ির অন্য সবারই ইচ্ছা এবং প্রস্তুতি ছিল— পাখিটাকে খাওয়ার। ঐদিনই আব্বু আমাদের নিয়ে আসে মামাবাড়ি থেকে। বাসায় গিয়েই পাখিটার কথা বলে আর আসার সময় সারাপথ গল্প করতে করতে আসে পাখিটার। আমিও খুব অস্থির ছিলাম কখন বাড়ি পৌঁছাব, কখন পাখিটাকে দেখব। পথে আব্বুর কোলে বসে পাখির কথা শুনেই শুরু হল আমার ননস্টপ প্রশ্ন করা— পাখিটা কোথায় থাকে, ওর বাসা কোথায়, ও কেন এসেছে, ওর বাসায় কে কে আছে, তারা কী করছে, আরো অনেক অনেক সব কৌতুহলী প্রশ্ন।
আব্বুও উত্তর করতে লাগলো একটার পর একটা— ও ঝড়ে বৃষ্টিতে পথ হারিয়ে অসুস্থ হয়ে এসে পড়েছিল আমাদের বাড়ি, ওর হয়ত বাসায় ছোট্ট বাচ্চা আছে, হতে পারে ওর বাচ্চারা অপেক্ষা করছে মায়ের জন্য, মা ওদের জন্য হয়ত খাবার নিতে বেরিয়েছিল। আরো সব উত্তর আমার অবুঝ প্রশ্নের জবাবে।
আব্বুর কথাগুলো বুকের কোথায় গিয়ে যেন লাগলো, তখন এত কিছু বোঝা বা ভাবার বয়স হয়নি, তবে এটুকু বুঝতে পারছিলাম যে, আমার খুব কষ্ট হচ্ছিল পাখিটা আর ওর বাচ্চাগুলোর জন্য। আমি আব্বুকে বললাম— আমরা এটা খাবো না, আমি পাখিটাকে ওর বাসায় দিয়ে আসতে চাই, আব্বু খুব খুশি হলো আর বললো— আমরা তো ওর বাসা চিনি না, চলো, ওকে রাস্তার পাশে মাঠে ছেড়ে দিয়ে আসি, ও নিজেই উড়ে চলে যাবে ওর বাসায়। তারপর আমি আর আব্বু মিলে রাস্তায় নিয়ে গিয়ে মাঠের পাশে ছেড়ে দিলাম বড় সারসটাকে। ও উড়ে চলে গেল আমাদের চোখের সামনে, আমি আর আব্বু হাততালি দিচ্ছিলাম অনেক। কী যে খুশি লাগছিল সেদিন তা বলে বোঝানো যাবে না।
আজও আব্বু যখন এই পাখিটা উড়ে যাওয়ার সময় হাততালি দিচ্ছিল আমার ঐ সারস পাখিটার কথাই মনে হচ্ছিল। শুকরিয়া আল্লাহর কাছে— এরকম একজন মানুষ আমার আব্বু । এমন একজন মানুষ আমার জন্মদাতা আর এমন একজন মানুষের বুকে আমার বেড়ে ওঠা যে কারনে এমন শত শত সুখের আর খুশীর স্মৃতিতে মোড়া আমার শৈশব।
লেখা এবং ছবি: তনিমা জামান, গোয়ালমাঠ, বাগেরহাট।