১৯৪৭ সালে দ্বিজাতি তত্ত্বের মধ্যে দিয়ে পৃথিবীর মানচিত্রে চিরশত্রু হিসেবে ভারত এবং পাকিস্তানের আবির্ভাব ঘটে। এর পরবর্তী ২৪ বছর ধরে চলে পূর্ব পাকিস্তানের ওপর পশ্চিম পাকিস্তানের অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক শোষণ। এই শোষণের হাত থেকে মুক্ত হয়ে, দ্বিজাতি তত্ত্বের অসারতা প্রমাণ করে পূর্ব দিগন্তে রক্তিম সূর্যের দেশ হিসেবে পৃথিবীর বুকে জায়গা করে নেয় দক্ষিণ এশিয়ার নবীনতম রাষ্ট্র বাংলাদেশ।
তবে এই স্বাধীনতা সহজে অর্জিত হয়নি। বিনিময়ে আত্মহুতি দিতে হয়েছিল ৩০ লক্ষাধিক মুক্তিকামী মানুষের, ধর্ষিত এবং চরম অমার্যাদার শিকার হয়েছে দশ লক্ষ মা-বোন। এই জঘন্যতম হত্যার পিছনে রয়েছে রাজাকার, আলবদর, আলশামসের মতো পৈচাশিক ঘাতক-দালালরা। দেশ স্বাধীন হওয়ার অব্যবহিত পরে নানান ধরনের রাজনৈতিক টানাপোড়েনে এই ঘাতক-দালালদের উপযুক্ত শাস্তি দেওয়া সম্ভব হয়নি। বঙ্গবন্ধুর হত্যা পরবর্তী সময়ে দীর্ঘ পনেরো বছর বাংলাদেশকে দেখতে হয়েছিল সামরিক অপশাসন। নব্বইয়ের দশকে বাংলাদেশে যখন গণতন্ত্রের দ্বিতীয় ঢেউ ওঠে, সেই সময় পুত্র রুমি এবং স্বামী সহ ত্রিশ লক্ষ শহীদের ঘাতকদের উপযুক্ত শাস্তির দাবিতে, একাত্তরের গণহত্যাকারী ও যুদ্ধাপরাধীদের বিচার এবং জামায়াত শিবির চক্রের মৌলবাদী সাম্প্রদায়িক রাজনীতি নিষিদ্ধ করার দাবিতে ১৯৯২ সালের ১৯ জানুয়ারি জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে গঠিত হয়েছিল ‘একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি ’। বাংলাদেশের বুকে তিনি হয়ে উঠেছিলেন সকল শহীদের জননী।
বাংলাদেশের মহান এই সাম্যের ধাত্রী শহীদ জননী জাহানারা ইমামের জন্ম হয় অবিভক্ত বাংলার মুর্শিদাবাদ জেলার সুন্দরপুর গ্রামে। সময়টা ১৯২৯ সালের ৩ মে, রক্ষণশীল পরিবারে জন্মগ্রহণ করলেও তার প্রবল শিক্ষা লাভের ইচ্ছা তাকে আধুনিক শিক্ষালাভ থেকে বঞ্চিত করতে পারেনি। এক্ষেত্রে তিনি পাশে পেয়েছেন স্বামী শহীদ শরীফ ইমাম এবং পিতা আব্দুল আলী, যিনি পেশায় ছিলেন একজন ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট।
১৯৪৫ সালে কলকাতার লেডি ব্রেবোর্ন কলেজ থেকে তিনি বিএ পাস করেন। ১৯৫২ থেকে ১৯৬০ পর্যন্ত তিনি ঢাকার সিদ্ধেশ্বরী গার্লস স্কুলের প্রধান শিক্ষিকা ছিলেন। ১৯৬৬ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলায় এমএ পাস করেন। এরপর ফুলব্রাইট স্কলারশিপ নিয়ে তিনি আমেরিকায় যান। সেখান থেকে ফিরে এসে ১৯৬৬ সালে যোগদান করেন ঢাকা টিচার্স ট্রেনিং কলেজে। শিক্ষাকতার জীবন তিনি দীর্ঘায়িত করেননি। চাকরি ছেড়ে যুক্ত হন সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে। খুব অল্প সময়ের মধ্যেই তিনিই হয়ে ওঠেন বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক আন্দোলনের অন্যতম কাণ্ডারী।
এর মধ্যেই তিনি প্রচুর লেখালেখিও করেছেন। তার রচনাবলীর মধ্যে অন্যতম— একাত্তরের দিনগুলি, বীরশ্রেষ্ঠ, অন্য জীবন, জীবন-মৃত্যু, বুকের ভিতর আগুন, প্রবাসের দিনলিপি ইত্যাদি। তার অদ্বিতীয় সৃষ্টি ‘একাত্তরের দিনগুলি’, যা মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের অন্যতম দলিল। বইটি প্রকাশিত হয় ১৯৮৬ সালে।
১৯৯৩ সালের ২৬ শে মার্চ যুদ্ধাপরাধীদের দুষ্কর্ম অনুসন্ধানের জন্য জাতীয় গণতদন্ত কমিশন গঠনের ঘোষণা প্রদান করেছিলেন জাহানারা ইমাম, সেদিন ছিল গণআদালতের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী। বিশিষ্ট সাংবাদিক, চলচ্চিত্র নির্মাতা এবং বর্তমানে একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সভাপতি শাহরিয়ার কবির বলেন, জাহানারা ইমাম গণআদালত গঠনের মধ্যে দিয়ে স্বাধীনতার সপক্ষের সকল শক্তিকে একত্রিত করতে পেরেছিলেন। সফলভাবে সব শক্তিকে সংগঠিত করে আন্দোল পরিচালনা করতে পেরেছিলেন। তার আন্দোলনের পথ ধরেই দেশের শীর্ষস্থানীয় যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হয়েছে। কোনো রাজনৈতিক দলের সদস্য না হয়েও মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষ সকল শক্তিকে একত্রিত করার ক্ষেত্রে জাহানারা ইমামের নেতৃত্ব অনন্য।
যতদিন না বাংলাদেশ থেকে মৌলবাদী রাজনীতির শিকড় উপড়ে ফেলা যাবে ততদিন পর্যন্ত জাহানারা ইমামের দেখানো পথেই আমাদের হাঁটতে হবে। সদ্য প্রয়াত বরেণ্য সাংবাদিক, মুক্তিযোদ্ধা কামাল লোহানী বলেছিলেন, “শহীদ রুমির প্রসবিনী মা জাহানারা ইমাম প্রত্যেকটি বাঙালির মনে যে আসন পেতে রেখে গেছেন, ব্যাপক গণআন্দোলনের মাধ্যমে দেশব্যাপী মানুষের মধ্যে অভূতপূর্ব সাড়া জাগিয়ে তিনি সাধারণ মানুষকে যে বিপুল উদ্দীপনায় সাহসী করে নতুন জীবন দিয়ে গেছেন তার জন্য তিনি চির স্মরণীয় হয়ে থাকবেন।”
শহীদজননীর এই সংগ্রামী জীবন সতত সুখের ছিল না। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে পুত্র এবং স্বামীকে হারানোর পর নিজের জীবনেও হানা বসিয়েছিল মারণ রোগ ক্যান্সার। যা শেষ জীবনে তার কথা বলার অধিকার থেকে তাকে প্রায় বঞ্চিত করেছিল। তবে তিনি ছিলেন শিল্পের স্রষ্টা। তাই মারণ রোগ তার স্বর কেড়ে নিলেও তার স্বরলিপি কেড়ে নিতে পারেনি। তিনি লিখে ফেলেন ‘ক্যান্সারের সঙ্গে বসবাস’ বসবাস নামে একটি বই, যেটি তার মৃত্যুর দুই বছর আগে ১৯৯১ সালে প্রকাশিত হয়।
লেখকঃ তাপস দাস, গবেষক, প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়, কলকাতা।