সম্প্রতি এক সমাবেশে ডাঃ জাফরুল্লাহ চৌধুরী সনাতন হিন্দু ধর্মের সমালোচনা করে বলেন, “মহাভারত রামায়ণ, শঠতা, প্ররোচনা ও মিথ্যাচারের গল্প কাহিনী।” এই বক্তব্যের মধ্য দিয়ে প্রমাণিত হলো, বাহিরে প্রগতিবাদী হলেও ভেতরটা আল্লামা শফীর হেফাজতি দর্শনে ভরপুর তার। অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহার হত্যাকাণ্ডের স্বচ্ছ বিচারের ব্যাপারে দেশবাসী ঐক্যবদ্ধ। কিন্তু এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে অনেকের মতো ডাঃ জাফরউল্লাহও ঘোলা পানিতে মাছ শিকারে ব্যস্ত। সম্প্রতি রাজধানীতে এক সমাবেশে জাফরউল্লাহ চৌধুরী বলেন, মেজর সিনহা হত্যাকাণ্ডে ভারতের গোয়েন্দা সংস্থা ‘র’ ও ইসরাইলের গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদ জড়িত থাকতে পারে। এধরনের সাম্প্রদায়িক উস্কানি দিয়ে তিনি রাজনৈতিক ফায়দা হাসিল করতে চেয়েছেন, যার সাথে জামায়াতের অপরাজনীতির মিল খুঁজে পাওয়া যায়। ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার পর নিজামী বলেছিলেন ‘র’ এবং মোসাদ এই কাণ্ডটি করেছে। একাত্তর সালে মওদূদী বলেছিলেন, “পূর্ব পাকিস্তানের গণহত্যা ইন্দো ইসরাইলি মিথ্যা প্রচারণা (দৈনিক সংগ্রাম, ৩ এপ্রিল, ১৯৭১)।
মুক্তিযুদ্ধের সময় ২ নং সেক্টরে খালেদ মোশাররফের অধীনে মেজর হায়দারের বোন ক্যাপ্টেন সেতারা ও ডাঃ এম এ মোবিনের সাথে ডাঃ জাফরউল্লাহ ‘বাংলাদেশ ফিল্ড হাসপাতাল’ গড়ে তুললেও পরবর্তীতে ডা. জাফরউল্লাহর সমস্ত কর্মকাণ্ড স্বৈরাচার ও মুক্তিযুদ্ধ বিরোধীদের রাজনীতি এবং যুদ্ধাপরাধীদের পক্ষে পরিচালিত হয়।
২০১৫ সালের ১৩ তারিখে প্রেসক্লাবে ডক্টর’স অ্যাসোসিয়েশন আয়োজিত এক সভায় যুদ্ধাপরাধী কামারুজ্জামানের ফাঁসিতে রুষ্ট হয়ে ডাঃ জাফরউল্লাহ চৌধুরী বলেন, কামারুজ্জামানকে মৃত্যুর ২০ মিনিট ধরে ঝুলিয়ে রেখে সরকার মানবতাবিরোধী অপরাধ করেছে। সেজন্য কামারুজ্জামানের পরিবারের কাছে সরকারের ক্ষমা চাওয়া উচিৎ। শুধু তাই নয়, কামারুজ্জামানের ইচ্ছানুযায়ী শুক্রবার ফাঁসি না দেওয়ায় ডাঃ জাফরউল্লাহ সরকারের প্রতি উষ্মা প্রকাশ করেন।
ডাঃ জাফরউল্লার চাচাতো ভাই বঙ্গবন্ধুর আত্মস্বীকৃত খুনি নূর চৌধুরীকে তিনি ক্ষমা করে দিতে বলেন। (টকশো, একাত্তর জার্নাল, একাত্তর টেলিভিশন, ১১ জুন ২০১৮)
২০১৮ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর চ্যানেল টুয়েন্টিফোরে মাহমুদুর রহমান মান্নার সঞ্চালনে মুক্তবাক অনুষ্ঠানে ডাঃ জাফরউল্লাহ ও মাহফুজ উল্লাহ যুদ্ধাপরাধী সাকা চৌধুরীর পক্ষে ওকালতি করে বলেন, “অভিযুক্ত সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর অধিকার খর্ব করা হচ্ছে।” একটি বিচারাধীন মামলা চলাকালীন সময়ে মন্তব্য করায় আদালত অবমাননার দায়ে কোর্ট এই দুই আলোচককে আদালতে তলব করেন।
যুদ্ধাপরাধীদের বিচার কার্যক্রম প্রশ্নবিদ্ধ করার জন্য ড. কামাল হোসেনের মেয়ের জামাই ডেভিড বার্গম্যান মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃত করে ব্লগে বিভিন্ন ধরনের বিতর্কিত পোস্ট দেন। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারিক কার্যক্রমকে বাধাগ্রস্থ ও বিতর্কিত করার অভিযোগে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল বার্গম্যানকে সাজা দিলে ডাঃ জাফরউল্লাহ, আসিফ নজরুল ও বদিউল আলমসহ কয়েকজন একটি যুক্ত বিবৃতিতে ট্রাইব্যুনালের বিচারপতিকে ‘মানসিক অসুস্থ’ বলে উল্লেখ করেন। এই বিবৃতির পরিপ্রেক্ষিতে আদালত অবমাননার দায়ে ডাঃ জাফরউল্লাহকে সাজাস্বরূপ আদালতের কাঠগড়ায় ১ ঘন্টা দাঁড় করিয়ে রাখা হয় ও ৫ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়।
গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের জন্য বঙ্গবন্ধু ডাঃ জাফরউল্লাহ চৌধুরীকে ২৩ একর (প্রায় ৭৫ বিঘা) জমি দান করেছিলেন। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর পর মোস্তাক ও জিয়া কর্তৃক জারিকৃত কালো আইন ‘ইনডেমনিটি বিল’-এর বিরুদ্ধে তিনি কোনোদিন প্রতিবাদ করেননি। এমন কি কোনোদিন তার প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে ১৫ আগস্ট জাতির পিতার জন্য শোক দিবস পালন করেছেন বলে শোনা যায়নি।
আইনের শাসনের প্রতি তিনি সোচ্চার। অথচ খালেদা জিয়া অবরোধের ডাক দিয়ে অগ্নি সন্ত্রাস শুরু করলে তিনি তার বিরুদ্ধে কখনও অবস্থান নেননি। খালেদা জিয়ার অগ্নি সন্ত্রাস ব্যর্থ হলেও আজও খালেদা সে অবরোধ তুলে নেননি। খালেদা জিয়ার উপদেষ্টা হিসেবে তিনি মানবতাবিরোধী এই অপরাধের দায় এড়াতে পারেন না।
২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলায় চার্জশিটে তারেক রহমানের নাম আসলে ১৩ অক্টোবর (২০১৮) সময় টিভিতে তিনি বলেন, তারেক রহমানের পরিবারের সাথে তার দীর্ঘদিনের পরিচয়। জিয়াউর রহমানের ছেলে এমন জঘন্য কাজ করতে পারে না।
২১ আগস্ট গ্রেনেড হত্যার মূল নায়ক তারেক জিয়াকে মহাত্মা গান্ধীর সাথে তুলনা করে সময় টেলিভিশনে তিনি আরও বলেন, “তারেক রহমান মহাত্মা গান্ধীর মতো ভূমিকা পালন করতে পারে।”
ডঃ জাফরউল্লাহ ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলাকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করে বর্তমান সেনাপ্রধানকে জড়িত করে ২০১৮ সালের ৯ অক্টোবর সময় টিভির টকশোতে বলেন, “আর্জেস গ্রেনেড কোত্থেকে আসছে? দেখেন আর্জেস গ্রেনেড, আমি জানি না সময়টা মিলে কিনা। আমাদের বর্তমান চীফ অব আর্মি আজিজ সাহেব চট্টগ্রামের কমান্ডেন্ট ছিলেন, জিওসি ছিলেন, তার ওখান থেকে একটা ব্যাপক সংখ্যক অ্যাঁ..এ.. সমরাস্ত্র গোলাগুলি চুরি হয়ে গেছিল, হারিয়ে গেছিল, বিক্রি হয়ে গেছিল। এবং এজন্য একটা কোর্ট মার্শালও হয়েছিল। আজিজের নামে, জেনারেল আজিজের নামে কোর্ট মার্শালও হয়েছিল।” পরবর্তীতে বিষয়টি মিথ্যা প্রমাণিত হলে তিনি ক্ষমা চান। তিনি বলেন, আমি ডায়ালাইসিসের রোগী, কী দিয়ে কী বলেছি নিজেই জানি না।
বিএনপিকে ক্ষমতায় আসার উপায় বাতলে দিয়েছেন ডাঃ জাফরুল্লাহ চৌধুরী। এক সমাবেশে বিএনপি নেতাদের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, “বিএনপির এক লাখ লোক জামিনে আছে। তাদের ডাক দেন, তারা দুদিনের জন্য হাইকোর্টের সামনের প্রাঙ্গণে এসে বসে থাকুক। এর মধ্যে খোদার তখত্ নড়ে যাবে, আর হাসিনা তো উড়ে যাবে।” (যুগান্তর, ০১/০১/২০২০)
বিগত বেশ কিছুদিন যাবৎ ডাঃ জাফরউল্লাহ চৌধুরী গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের নামে জামায়াতের মতো ভয়ঙ্কর আন্তর্জাতিক ফ্যাসিবাদী শক্তি, অগ্নি সন্ত্রাসী, গৃহপালিত রাজনীতিবিদ এবং লাশপ্রিয় নেতাদের সাথে ঐক্য গড়ে তোলেন। নিয়মতান্ত্রিক পথে আন্দোলন বেগবান করতে না পেরে, তিনি তার গণবিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রককে ফোনালাপে বলেন, মারপিটের জন্য বেশি ছাত্র লাগে না। পঞ্চাশ জন ছাত্র রেডি করে রেখ। দুটি মেয়েকে দিয়ে নারী নির্যাতনের মামলা দাও।
নার্সদের করোনা কম হওয়াতে তিনি ভীষণ রকম অসন্তুষ্ট। ২৫ এপ্রিল রাতে একটি টকশোতে তিনি বলেছেন, “নার্সদের ২য় শ্রেণির অফিসার পদমর্যাদা দেওয়া ঠিক হয়নি। নার্সরা ঠিকমতো কাজ করে না। এজন্য নার্সরা করোনায় আক্রান্ত হচ্ছে না।” (বাংলাদেশ নিউজ ২৪, ২৬ এপ্রিল ২০২০)