“সাংবাদিকেরাই কেবল সাংবাদিকতাকে বাঁচাতে পারেন।” ডেইলি স্টারের সম্পাদক ও প্রকাশক মাহফুজ আনাম এই শিরোনামে একটি নিবন্ধ লিখেছেন। নিবন্ধে তিনি অনেক প্রয়োজনীয় কথা বলেছেন। কিছু অপ্রয়োজনীয় সাফাইও আছে।
আমি পুরো লেখা নিয়ে কোনো আলোচনায় যাব না, আমার খটকা শিরোনামকে ঘিরে। মাহফুজ আনাম লিখেছেন, “শুধু আমরা সাংবাদিকেরাই আমাদের পেশাকে বাঁচাতে পারি। বাকি সবাই সাংবাদিকতাকে নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করতে চায়।” সাংবাদিকতা পেশাকে শুধু সাংবাদিকরা বাঁচিয়ে রাখতে পারেন? এটা কী বললেন তিনি! এখন আর দশটা পেশার মতো সাংবাদিকতাও ‘মন যোগানোর পেশা’। রিপোর্টারদের প্রথম মন যোগাতে হয় চিফ রিপোর্টারের, নিউজ এডিটরের। তারা মন যোগান সম্পাদকের। তিনি মন যোগান মালিকের। মালিক মন যোগান তিনি যে রাজনৈতিক মতাদর্শ ধারণ করেন তাদের। এর মধ্যে স্বাধীন সাংবাদিকতা, বস্তুনিষ্ঠতার স্থান কোথায়? নিজের মনমতো রিপোর্ট করার পরিসর কোথায়?
এখন মিডিয়া বিভিন্ন লুটেরা ব্যবসায়ী গ্রুপের দখলে। এরা প্রত্যেকেই চায় একচেটিয়া ব্যবসা করতে। কোনো প্রতিদ্বন্দ্বিতাকে তারা সহ্য করতে পারে না। ফলে এক ব্যবসায়িক গ্রুপের মিডিয়া আরেক গ্রুপের বিরুদ্ধে নিউজ করে, তাদের দু’নম্বরি উদ্ভাবনে তৎপর হয়। কিন্তু নিজেদের ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের পক্ষে তারা সাফাই গায়। নিজেদের দু’নম্বরি নিয়ে নিউজ করলে তাদের চাকরি থাকবে? তাহলে সাংবাদিকরা কীভাবে সাংবাদিকতাকে রক্ষা করবে?
মনে পড়ছে একটা ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা। আমি তখন সংবাদে এডিটরিয়াল লিখি। একবার ভোরের কাগজের এক প্রতিবেদনের ভিত্তিতে একটা এডিটরিয়াল লিখলাম— বিভিন্ন আবাসন কোম্পানির হাতিরঝিল দখলের বিরুদ্ধে। সংবাদের তখনকার সম্পাদক বজলুর রহমান এডিটরিয়ালগুলো দেখে দিতেন। ইন্টারকমে বজলু ভাই ডাকলেন। বললেন, এই এডিটরিয়াল কোন নিউজের ভিত্তিতে লিখেছো? কোন কোন আবাসন কোম্পানি হাতিরঝিল দখল করছে, সেটা একটু চেক করে দেখো। এর মধ্যে যদি ইস্টার্ন হাউজিং থাকে, তাহলে এই এডিটরিয়াল যাবে না। কারণ ওরা আমাদের প্রতি মাসে পাঁচ লাখ টাকার বিজ্ঞাপন দেয়। যে টাকায় তোমার-আমার বেতন হয়।
এরপর বজলু ভাই ব্যঙ্গ করে বললেন, “খাল-বিল-ঝিল দখল করা অন্যায়, অপরাধ, মহাপাপ। দখলকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিৎ, প্রয়োজনে তাদের ব্যবসা করার অধিকার কেড়ে নেওয়া উচিৎ, তাদের ফাঁসিতে ঝোলানো উচিৎ। যদি ইস্টার্ন হাউজিং না থাকে!” আমি খোঁজ নিয়ে জানালাম, দখলদারদের তালিকায় ইস্টার্ন হাউজিংয়ের নাম নেই। বজলু ভাই বললেন, “তাহলে এটা এক নম্বর এডিটরিয়াল হবে।” এই অভিজ্ঞতা থেকে আমি বুঝেছি, সাংবাদিকরা সাংবাদিকতাকে বাঁচাতে পারে না। সাংবাদিকতার প্রাণভোমরা অনেকের হাতে। সে নিজে বড় জোর খুন বা আত্মহত্যা করতে পারে। এর বাইরে সাংবাদিকের (ছোট সাংবাদিক) ক্ষমতা খুবই অল্প। এটা কী মাহফুজ আনাম জানেন না? তাহলে তিনি এমন একটা কাঁচা কথা কীভাবে বললেন? তবে কি তারও ‘গরু হারিয়েছে’?
উল্লেখ্য, গত ৮ এপ্রিল ২০২৩ তারিখে ডেইলি স্টারের সম্পাদক মাহফুজ আনামের লেখা “সাংবাদিকেরাই কেবল সাংবাদিকতাকে বাঁচাতে পারেন” শিরোনামে একটি লেখা দৈনিক প্রথম আলো পত্রিকায় প্রকাশিত হয়।