ক্লাসিক্যাল ও নিও-ক্লাসিক্যাল অর্থনীতি তত্ত্বের উদ্ভব ও বিকাশ: পরিবেশ বিপর্যয়ের সূত্রপাত

এডাম স্মিথ

ক্লাসিক্যাল অর্থনৈতিক তত্ত্ব, যার ভিত্তি স্থাপন করেন Adam Smith (1776) তার বিখ্যাত গ্রন্থ “An Inquiry into the Nature and Causes of the Wealth of Nations”-এ, এমন এক বাজার ব্যবস্থার পক্ষে যুক্তি দেয় যেখানে ব্যক্তিগত স্বার্থের অনুশীলন সমষ্টিগত কল্যাণে রূপান্তরিত হয়। স্মিথের “অদৃশ্য হাত” (Invisible Hand) ধারণা অনুসারে, প্রত্যেক ব্যক্তি যদি তার নিজ স্বার্থকে অনুসরণ করে, তবে অবশেষে তা সামগ্রিকভাবে সমাজের সর্বোচ্চ মঙ্গল সাধন করবে। এই চিন্তাধারাই পরবর্তীতে মুক্ত বাজার অর্থনীতির ভিত্তি হিসেবে বিবেচিত হয় এবং বিশ্বব্যাপী নীতিনির্ধারকদের এক বড় অংশ এই তত্ত্বকে গ্রহণ করে। নিওক্লাসিক্যাল অর্থনৈতিক তত্ত্ব এই ধারণাকে আরো সুসংগঠিত করে, যেখানে মানুষকে “rational agent” হিসেবে বিবেচনা করা হয়, যে সর্বোচ্চ উপযোগ বা মুনাফা অর্জনের জন্য প্রতিনিয়ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে।

এ ধরনের অর্থনৈতিক চিন্তা ও চর্চার একটি প্রতিফলন পাওয়া যায় স্ট্যান্ডার্ড অর্থনৈতিক টেক্সটবুকগুলোর মডেল উপস্থাপনায়, যেমন Gregory Mankiw তার Principles of Economics (2021) গ্রন্থে অর্থনৈতিক কার্যক্রমকে সাধারণত একটি চক্রাকার প্রবাহ (circular flow diagram) হিসেবে চিত্রিত করেছেন, যেখানে গৃহস্থালি, ফার্ম ও সরকারের মধ্যে সম্পদ, পণ্য ও সেবার আদান-প্রদান চলে। তবে এই মডেলে প্রকৃতি বা প্রাকৃতিক সম্পদ ব্যবস্থাপনাকে কেবলমাত্র ‘input’ হিসেবে বিবেচনা করা হয় এবং উৎপাদন ও ভোগ শেষে বর্জ্য নিষ্কাশনকে ‘output’ হিসেবে উপস্থাপন করা হয়। এর ফলে প্রকৃতিকে অর্থনৈতিক ব্যবস্থার বাহ্যিক উপাদান বা নিরপেক্ষ ভাণ্ডার হিসেবে দেখা হয়, যার নিজস্ব সীমাবদ্ধতা, পুনঃউৎপাদনের ক্ষমতা কিংবা পরিবেশগত প্রভাবকে বিবেচনায় রাখা হয় না। এই মডেল অর্থনৈতিক কার্যক্রমের স্বয়ংক্রিয়তাকে জোরালোভাবে তুলে ধরলেও এটি প্রাকৃতিক পুঁজি (natural capital)— যেমন বায়ু, পানি, মাটি, বন, এবং জীববৈচিত্র্য–এর সীমাবদ্ধতা এবং পরিবেশগত সহনশীলতা (environmental thresholds) উপেক্ষা করে চলে। ফলে অর্থনৈতিক বিশ্লেষণে পরিবেশীয় ক্ষতি, প্রাকৃতিক সম্পদের অবক্ষয়, ও দূষণ প্রক্রিয়াগুলোর দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব বাদ পড়ে যায়। অর্থনীতিবিদ Herman Daly এ ধরনের দৃষ্টিভঙ্গিকে সমালোচনা করে বলেন, “Treating the economy as if it were wholly contained within the market is like drawing a map of a city with no reference to the surrounding terrain” (Daly, 1992).
এই দৃষ্টিভঙ্গির ফলে বাস্তব সমস্যাগুলো যেমন— পরিবেশ দূষণ, জীববৈচিত্র্যের হ্রাস, জলবায়ু পরিবর্তন, মাটির অবক্ষয়, জলের সংকট— এসবকে মূলধারার অর্থনৈতিক বিশ্লেষণে যথাযথভাবে অন্তর্ভুক্ত করা হয় না। Paul Hawken, Lester Brown এবং Herman Daly-র মতো পরিবেশ অর্থনীতিবিদরা এই ব্যবস্থাকে “growth fetishism” বা অন্ধ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন। Herman Daly তার Steady-State Economics (1977) গ্রন্থে উল্লেখ করেন যে, “A system that treats the environment as an infinite reservoir for resource extraction and waste disposal is doomed to collapse.”
বিশ্ব ব্যাংক ও UNDP-এর রিপোর্টগুলোতেও বলা হয়েছে, পরিবেশের সীমাবদ্ধতা উপেক্ষা করে পরিচালিত অর্থনীতি শেষ পর্যন্ত শুধু পরিবেশ নয়, অর্থনীতিকেও ক্ষতিগ্রস্ত করে। উদাহরণস্বরূপ, ২০১৫ সালের UNEP-এর “The Economics of Ecosystems and Biodiversity (TEEB)” রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে যে, প্রতিবছর বিশ্ব অর্থনীতি প্রায় ৫ ট্রিলিয়ন ডলার সমমূল্যের পরিবেশগত সেবা হারাচ্ছে, যার মধ্যে রয়েছে বন উজাড়, মাটি ও পানির গুণমানের অবনতি ও জীববৈচিত্র্যের হ্রাস।
বিশ্বায়নের পরবর্তী পর্যায়ে বিশ্ব অর্থনৈতিক পরিমণ্ডলে যে দৃষ্টান্তমূলক পরিবর্তন লক্ষ করা যায়, তার অন্যতম প্রধান রূপ হলো নব্য উদার অর্থনৈতিক ব্যবস্থা (Neoliberal Economic System)। ব্যক্তি মালিকানা, বাজারের অবাধ প্রবাহ এবং রাষ্ট্রের সীমিত ভূমিকার উপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠা এই অর্থনৈতিক ধারা ১৯৭০-এর দশক থেকে বিশ্ব অর্থনীতিকে বিশেষভাবে প্রভাবিত করে আসছে। ১৯৭৩ সালে চিলিতে “Chicago Boys” নামক অর্থনীতিবিদদের একটি দল জেনারেল পিনোচেটের সামরিক শাসনে এই মডেল বাস্তবায়ন করে। পরে এটি যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট Ronald Reagan এবং যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী Margaret Thatcher–এর অধীনে নীতিগত স্বীকৃতি পায়। David Harvey (2005) তার বিখ্যাত গ্রন্থ A Brief History of Neoliberalism এ উল্লেখ করেন- “Neoliberalism is… a theory of political economic practices that proposes that human well-being can best be advanced by liberating individual entrepreneurial freedoms and skills within an institutional framework characterized by strong private property rights, free markets, and free trade.” অর্থাৎ নব্য উদার অর্থনৈতিক ব্যবস্থা মূলত একটি বাজারকেন্দ্রিক অর্থনৈতিক কাঠামো, যার ভিত্তি ব্যক্তিগত মালিকানা, অবাধ বাজার এবং সরকারী হস্তক্ষেপের পরিমিততায় গঠিত। এই ব্যবস্থায় রাষ্ট্রের ভূমিকা ধীরে ধীরে সীমিত হয়ে আসে এবং নীতিনির্ধারণের কেন্দ্রবিন্দুতে থাকে বেসরকারি মুনাফা ও কর্পোরেট স্বার্থ। যদিও এই ব্যবস্থার লক্ষ্য ছিলো অর্থনৈতিক দক্ষতা ও প্রবৃদ্ধি বৃদ্ধি, তবে বাস্তবতা হলো— এই কাঠামোর ফলে বৈষম্য, সামাজিক অসাম্য, মানসিক স্বাস্থ্য সংকট এবং পরিবেশগত ভারসাম্যহীনতা দিনদিন তীব্রতর হচ্ছে।
Nassau Senior, William Stanley Jevons, Leon Walras, এবং Alfred Marshall-এর হাত ধরে যে নিওক্লাসিক্যাল অর্থনীতি (Neo-classical Economy) গড়ে ওঠে, তা মানুষকে “rational agent” হিসেবে উপস্থাপন করে, যে প্রতিনিয়ত সর্বোচ্চ উপযোগ বা লাভের সন্ধানে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। এই কাঠামোতে চাহিদা ও যোগানের মাধ্যমে বাজারে স্বয়ংক্রিয় সাম্যাবস্থা (equilibrium) প্রতিষ্ঠিত হয়। পরিবেশকে এখানে একটি ‘externality’ বা বহিঃপ্রভাব হিসেবে ধরা হয়— অর্থাৎ এটি ততক্ষণ পর্যন্ত বাজারে বিবেচনায় আসে না, যতক্ষণ না এটি উৎপাদন বা ভোগ প্রক্রিয়ায় সরাসরি কোনো ব্যয় সৃষ্টি করে। উদাহরণস্বরূপ, যখন কোনো শিল্প প্রতিষ্ঠান নদীতে বর্জ্য ফেলে, তখন সেই দূষণের সামাজিক খরচকে বাজারমূল্যে প্রতিফলিত করা হয় না— কিন্তু এটি পরিবেশের জন্য ঋণাত্মক বহিঃপ্রভাব হিসেবে কাজ করে। Baumol & Oates (1988) বলেন, “Environmental degradation often arises from the inability of the price system to reflect the full social costs of production and consumption.”
নব্য উদারনীতির তাত্ত্বিক ভিত্তি রচনা করেন মার্কিন অর্থনীতিবিদ Milton Friedman, যিনি বাজারকেন্দ্রিক অর্থনৈতিক মুক্তিকে সবচেয়ে কার্যকর নীতি বলে গণ্য করেন। নব্য উদারনীতির মূল বৈশিষ্ট্যগুলোর মধ্যে রয়েছে সরকারি খাতের বেসরকারীকরণ, শ্রম বাজারের নমনীয়তা, কর্পোরেট কর হ্রাস এবং জনকল্যাণমূলক ব্যয়ের ছাঁটাই। এর ফলে মানুষের সামাজিক বন্ধন, মানসিক সুস্থতা ও পরিবেশগত ভারসাম্য ধীরে ধীরে পেছনে পড়ে যায়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (WHO) ২০২২ সালের এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, “অর্থনৈতিক বৈষম্য ও কর্মসংস্থানের অনিশ্চয়তা মানুষের মানসিক স্বাস্থ্যে গভীর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে,” যা স্পষ্টতই এই ব্যবস্থার অন্তর্নিহিত সংকটের প্রতিফলন। নব্য উদারনীতি প্রাকৃতিক সম্পদকে শুধুই মুনাফার উৎস হিসেবে দেখে। রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণহীনতার সুযোগে কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানগুলো অনিয়ন্ত্রিতভাবে বন, নদী, খনিজ ও জ্বালানির উপর দখল প্রতিষ্ঠা করে পরিবেশের ভারসাম্য বিনষ্ট করে ফেলছে। উদাহরণস্বরূপ, Harvey (2005) লেখেন— “Nature is commodified and reified as capital, to be exploited freely, without social or ecological accountability.” উদারনীতির সুযোগ নিয়ে বিশ্বজুড়ে কর্পোরেট জায়ান্টরা বিলিয়ন ডলারের মুনাফা অর্জন করছে, কিন্তু সাধারণ মানুষের জীবনে সামগ্রিক সুখ বা সামাজিক সংহতির উন্নয়ন ঘটছে না। নব্য উদারনীতির অন্যতম পরিণতি হলো বৈষম্যের চরম বিস্তার। Oxfam (2022) এর Inequality Kills রিপোর্টে বলা হয়— “During the COVID-19 pandemic, the world’s ten richest men doubled their fortunes while over 160 million people were pushed into poverty.” এই বৈষম্য শুধু অর্থনৈতিক নয়, সামাজিক বৈষম্য ও রাজনৈতিক ক্ষমতার অসম বণ্টনকেও উৎসাহিত করে। এই চরম বৈষম্য নব্য উদারনীতির অন্তর্নিহিত অসাম্য ও অমানবিকতার প্রকৃষ্ট উদাহরণ।
পরিবেশগত দিক থেকে দেখলে নব্য উদার অর্থনীতির প্রভাব আরো বিপজ্জনক। অতিরিক্ত ভোগবাদ, কার্বন নির্গমনের উর্ধ্বগতি, জীবাশ্ম জ্বালানির লাগাতার ব্যবহার এবং বন উজাড় করে শিল্পায়নের ফলে বিশ্ব পরিবেশ এক সংকটময় পর্যায়ে উপনীত হয়েছে। জাতিসংঘের জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক আন্তঃসরকারি প্যানেল (IPCC)-এর ২০২৩ সালের রিপোর্ট অনুযায়ী, “যদি ২০৩০ সালের মধ্যে বৈশ্বিক কার্বন নির্গমন অর্ধেকে না আনা যায়, তবে জলবায়ু বিপর্যয় অনিবার্য হয়ে উঠবে।” শুধু তাই নয় জলবায়ু পরিবর্তন, জীববৈচিত্র্য হ্রাস, ভূমি ও পানির দখলদারিত্ব—এসবই এই ব্যবস্থার একাধিক পরিবেশগত পরিণতি। ১৯৮৯ সালে মার্কিন অর্থনীতিবিদ পল সুইজি The Monthly Review-এর একটি প্রবন্ধে সতর্ক করেছিলেন, “পুঁজিবাদী ব্যবস্থার প্রকৃতি হলো নিরন্তর প্রবৃদ্ধি ও ভোগ। এই প্রবণতা একদিকে যেমন প্রাকৃতিক সম্পদের নিঃশেষ ঘটায়, অন্যদিকে গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমনের মাধ্যমে জলবায়ু সংকট তৈরি করে।” সুইজির এই সতর্কতা আজ বাস্তব রূপ নিয়েছে। গবেষণাগুলো দেখাচ্ছে, বৈশ্বিক উষ্ণায়ন, মেরু অঞ্চলের বরফ গলে যাওয়া, এবং জৈব বৈচিত্র্যের ধ্বংস— সবই এই অর্থনৈতিক কাঠামোর ফল। এভাবে, নব্য উদার অর্থনৈতিক ব্যবস্থা কেবল আর্থিক বৈষম্য নয়, বরং সামাজিক বিচ্ছিন্নতা, মানসিক স্বাস্থ্য সংকট এবং পরিবেশগত বিপর্যয়ের এক জটিল চক্র তৈরি করেছে, যা থেকে বেরিয়ে আসা দিনকে দিন কঠিন হয়ে পড়ছে। এই প্রেক্ষাপটে বিশ্বব্যাপী বিকল্প অর্থনৈতিক ভাবনার প্রয়োজনীয়তা আজ আরও গভীরভাবে অনুধাবন করা জরুরি।
ক্লাসিক্যাল ও নিওক্লাসিক্যাল দৃষ্টিভঙ্গিতে অর্থনীতিকে ‘সার্বিক সেট’ (Universal Set) বিবেচনা করে পরিবেশকে উহার একটি ‘উপসেট’ (Sub Set) বিবেচনা করা হয় যেখান থেকে প্রাকৃতিক সম্পদ আহরণ করা যায় এবং বর্জ্যও নিষ্কাশন করা যায়, অথচ পরিবেশের সীমাবদ্ধতা, পুনঃউৎপাদনের ক্ষমতা বা দূষণ সহনক্ষমতার কোনো যথাযথ মূল্যায়ন থাকে না (চিত্র-১)।

পরিবেশ বিপর্যয়
চিত্র-১ঃ ক্ল্যাসিকাল ও নব্য উদার অর্থনীতি তত্ত্ব অনুসারে বাস্তুতন্ত্র এবং পরিবেশের মধ্যে সম্পর্ক।

 

চিত্রটি পর্যালোচনা করে দেখা যায়, i) বিভিন্ন অর্থনৈতিক এজেন্টরা উৎপাদন ও বর্জ্য নিষ্কাশনের ক্ষেত্রে সরাসরি প্রাকৃতিক বাস্তুতন্ত্রের উপর নির্ভরশীল, ii) ইকোসিস্টেম থেকে উপকরণ গ্রহণ না করলে অর্থনৈতিক উৎপাদন সম্ভব না, iii) অর্থনৈতিক কার্যক্রমে উৎপাদিত বর্জ্য ইকোসিস্টেম ধারণ করতে না পারলে পরিবেশ দূষণ বেড়ে গিয়ে ভবিষ্যতের অর্থনীতিকে হুমকির মুখে পড়তে পারে, iv) গৃহস্থলী, প্রতিষ্ঠান, সরকার এবং বিদেশি এজেন্টরা এই গতিশীল সম্পর্কের অংশ হওয়ায়, কার্যকর নীতিমালা পরিচালনার মাধ্যমে পরিবেশগত পরিসেবার সুষম ব্যবহার এবং বর্জ্য নিষ্কাশনের হার স্থায়ীভাবে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব, v) পরিবেশের ওপর নেতিবাচক প্রভাব, যেমন দূষণ ও সম্পদের অপব্যবহার কমাতে, সরকার অর্থনৈতিক কার্যকলাপ নিয়ন্ত্রণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।
তবে Ecological economists, যেমন Herman Daly ও Robert Costanza, এই দৃষ্টিভঙ্গির বিরোধিতা করে বলেন, “The economy is a subsystem of the finite biosphere. It must conform to ecological limits”. উভয় অর্থনৈতিক তত্ত্বে পরিবেশকে উপেক্ষা করে কেবল বাজার ও মুনাফাভিত্তিক সাম্যবস্থা পরিচালনা বাস্তবতার সঙ্গে সাংঘর্ষিক, কারণ প্রকৃতি ও পরিবেশ কোনো বাহ্যিক বিষয় নয়— অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড প্রকৃতপক্ষে প্রকৃতিরই একটি অংশ বা উপসেট।
কেননা যখন অর্থনৈতিক উন্নয়নের সূচকে কেবল কী পরিমাণ সম্পদ আহরণ করা হলো তা গণনা করা হয়, কিন্তু পরিবেশের যে ক্ষয়ক্ষতি হচ্ছে তা অর্থনীতির ব্যালান্স শিটে প্রতিফলিত হয় না, তখন সেটি একধরনের “false accounting” হয়ে দাঁড়ায়। এই মডেলের ফলাফলই হলো— ব্যাপক শিল্পায়ন, অনিয়ন্ত্রিত খনিজ আহরণ, দূষণ এবং অতিরিক্ত প্রাকৃতিক সম্পদ আহরণ, যার কারণে আজ আমরা জলবায়ু সংকট, খাদ্য নিরাপত্তাহীনতা, ও জল সংকটের মুখোমুখি। এই ধরণের অর্থনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি ও প্রক্রিয়া দীর্ঘমেয়াদে টেকসই নয়। “Nature is not a subset of the economy; the economy is a subset of nature” —এই সত্যকে ভিত্তি করেই ভবিষ্যতের অর্থনৈতিক মডেল নির্মাণ করতে হবে। কেননা পরিবেশ, সমাজ ও অর্থনীতির মধ্যে ভারসাম্য আনয়ন ব্যতীত কোনো উন্নয়নই টেকসই হতে পারে না।
UNDP Human Development Report (2021) এ বলা হয়, সামাজিক, পরিবেশগত এবং অর্থনৈতিক ন্যায়বিচার একে অপরের সঙ্গে গভীরভাবে জড়িত। সেজন্য নব্য উদার অর্থনৈতিক ব্যবস্থা একটি সময়ের প্রেক্ষিতে প্রয়োজনীয় হলেও, বর্তমানে এর সীমাবদ্ধতা ও সংকট সুস্পষ্ট। এটি কেবল বৈষম্যকেই বাড়িয়ে তোলে না, বরং মানুষের ভেতরকার মূল্যবোধ ও সামাজিক সংহতিকেও ধ্বংস করে। বর্তমানে রাষ্ট্রের উচিৎ মুনাফা নয়, মানুষের কল্যাণকে অর্থনীতির কেন্দ্রে স্থাপন করা —এটাই হবে একটি ন্যায়ভিত্তিক, টেকসই ও মানবিক সমাজ গঠনের প্রথম পদক্ষেপ।


মোঃ ওসমান গনি
জনতা ব্যাংক পিএলসি. তে কর্মরত
এম.এস., ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

মোহাম্মদ ওসমান গনি
লেখক, মোহাম্মদ ওসমান গনি।