Headlines

জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা: কোথায় দাঁড়িয়ে বাংলাদেশ?

টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা
মধ্যম আয়ের দেশের সিঁড়িতে বাংলাদেশ। সাম্প্রতিক সময়ে দ্রুত অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জন, অবকাঠামোগত উন্নয়ন ও জনমানুষের সার্বিক জীবনমান উন্নয়নে বাংলাদেশ অনেকক্ষেত্রে উন্নয়নশীল বিশ্বের রোল মডেল। দেশের টেকসই ও সুষম অর্থনৈতিক উন্নয়নের লক্ষ্যে বাংলাদেশ সরকার যে আর্থিক অন্তর্ভুক্তিমূলক কর্মসূচি গ্রহণ করেছে, তা আজ সফলতার পথে। বিভিন্ন ধরনের পরিসেবা সহ ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের নানামুখী কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে সরকারের উন্নয়নমূলক উদ্যোগগুলো বাস্তবায়ন করার চেষ্টা করে চলেছে। তবে উন্নয়নের এ ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশ টেকসই উন্নয়ন ধারণাটিকে কতটা বজায় রাখতে পারছে সেটিই এখন বড় প্রশ্ন হয়ে দেখা দিয়েছে।
টেকসই উন্নয়নের ধারণাটি বিভিন্ন উপায়ে ব্যাখ্যা করা যায়। তবে এটা দ্বারা এমন এক উন্নয়নের ধারণা বোঝায়, যা পরিবেশগত, সামাজিক এবং মানুষের প্রয়োজনের সীমাবদ্ধতার মাঝে ভারসাম্য রক্ষা করতে তৎপর হয়। টেকসই উন্নয়ন হলো এমন উন্নয়ন, যা ভবিষ্যৎ প্রজন্মের চাহিদার বিষয়টি মাথায় রেখে বর্তমানের প্রয়োজন মেটায়।
টেকসই উন্নয়ন ধারণাটিকে একটি নীতিমালার মধ্য দিয়ে সুস্পষ্ট করা হয়েছে। এক কথায় টেকসই উন্নয়ন হলো মানব উন্নয়ন লক্ষ্য পূরণের জন্য একটি সংগঠিত নীতি এবং সেইসাথে প্রাকৃতিক সম্পদ এবং বাস্তুতন্ত্রের পরিসেবাগুলি প্রদান করার জন্য প্রাকৃতিক ব্যবস্থার সক্ষমতা বজায় রাখা, যার ওপর অর্থনীতি এবং সমাজ নির্ভর করে। কাঙ্ক্ষিত ফলাফল তখনই পাওয়া যায়, যখন কোনো সমাজব্যবস্থা বা একটি রাষ্ট্র প্রাকৃতিক ব্যবস্থার অখণ্ডতা এবং স্থিতিশীলতাকে ক্ষুন্ন না করে মানুষের চাহিদা মেটাতে সক্ষম হয় এবং সেখানে অব্যাহতভাবে জীবনযাপনের ভারসাম্যমূলক ব্যবস্থা এবং সম্পদ ব্যবহার করা হয়।
১৯৮৭ সালের ব্রুন্ডল্যান্ড রিপোর্টে টেকসই উন্নয়নকে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছিল— “এমন উন্নয়ন যা ভবিষ্যত প্রজন্মের নিজস্ব চাহিদা পূরণের ক্ষমতার সাথে আপোস না করে বর্তমান প্রজন্মের চাহিদা পূরণ করে।” টেকসই উন্নয়নের ধারণাটি বিকশিত হওয়ার সাথে সাথে এটি ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য অর্থনৈতিক উন্নয়ন, সামাজিক উন্নয়ন এবং পরিবেশ সুরক্ষার দিকে আরো বেশি মনোযোগ দিয়েছে।
টেকসই উন্নয়নকে প্রথম প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়া হয়েছিল রিও সম্মেলনে মাধ্যমে ১৯৯২ সালে রিও ডি জেনেইরোতে যখন আর্থ সামিট শুরু হয়েছিল। ২০১৫ সালে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য (২০১৫ থেকে ২০৩০) গ্রহণ করে এবং ব্যাখ্যা করে যে, কীভাবে লক্ষ্যগুলো বিশ্বব্যাপী টেকসই উন্নয়ন অর্জনের জন্য একীভূত এবং অবিভাজ্য। সংক্ষেপে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) ২০৩০ হচ্ছে, ২০১৫ সালে অনুষ্ঠিত জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের ১৭টি বৈশ্বিক লক্ষ্যের একটি সংকলন। ২০১৫ সালে জাতিসংঘ দারিদ্র্য বিমোচন, প্রকৃতির সুরক্ষা এবং নতুন একটি টেকসই উন্নয়নের এজেন্ডা হিসেবে সকলের জন্য সমৃদ্ধি নিশ্চিতে ১৫ বছর মেয়াদি ১৭টি লক্ষ্য ও ১৬৯টি সহায়ক লক্ষ্যমাত্রা গ্রহণ করে। এসডিজি জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের রেজুলেশন ৭০/১, ২০৩০-এর এজেন্ডার অংশ। SDGs-এর মেয়াদ ২০১৬ থেকে ২০৩০ সাল পর্যন্ত। এই ১৭টি লক্ষ্য বিশেষভাবে দারিদ্র্য, বৈষম্য, জলবায়ু পরিবর্তন, পরিবেশগত অবক্ষয়, শান্তি এবং ন্যায়বিচার সহ বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করার কথা বলে। ১৯৮৭ সালে জাতিসংঘের পরিবেশ ও উন্নয়ন বিষয়ক বিশ্ব কমিশন ‘আওয়ার কমন ফিউচার’ রিপোর্ট প্রকাশ করে, যাকে সাধারণত ব্রুন্ডল্যান্ড রিপোর্ট বলা হয়। প্রতিবেদনে “টেকসই উন্নয়ন” এর একটি সংজ্ঞা অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে, যা এখন ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়:
টেকসই উন্নয়ন হচ্ছে এমন উন্নয়ন যা ভবিষ্যৎ প্রজন্মের নিজেদের চাহিদা মেটাতে সক্ষমতার সঙ্গে আপস না করে বর্তমানের চাহিদা পূরণ করে।
এটির মধ্যে দুটি মূল ধারণা রয়েছে:

* ‘প্রয়োজন’ ধারণা, বিশেষ করে, বিশ্বের দরিদ্রদের অপরিহার্য চাহিদা, যাকে অগ্রাধিকার দেওয়া উচিত; এবং

* বর্তমান এবং ভবিষ্যতের চাহিদা মেটাতে পরিবেশের ক্ষমতার ওপর প্রযুক্তি এবং সামাজিক সংগঠনের রাষ্ট্র দ্বারা আরোপিত সীমাবদ্ধতার ধারণা।

টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রাঃ
২০১৫ সালের আগস্ট মাসে ১৯৩টি দেশ নিম্নোক্ত ১৭টি লক্ষ্যমাত্রার বিষয়ে একমত হয়েছে।
১. দারিদ্র্য বিমোচনঃ সর্বত্র সব ধরনের দারিদ্র্য নির্মূল করা;
২. ক্ষুধা মুক্তিঃ ক্ষুধা মুক্তি, খাদ্য নিরাপত্তা ও উন্নত পুষ্টির লক্ষ্য অর্জন ও টেকসই কৃষি ব্যবস্থা চালু করা।
৩. সুস্বাস্থ্যঃ স্বাস্থ্যকর জীবনযাপন নিশ্চিত করা ও সব ধরনের বয়সের সবার কল্যাণে কাজ করা;
৪. মানসম্মত শিক্ষাঃ অন্তর্ভুক্তিমূলক ও সমতাভিত্তিক মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করা এবং সবার জন্য আজীবন শিক্ষার সুযোগ তৈরি করা;
৫. লিঙ্গ সমতাঃ লিঙ্গ সমতা অর্জন এবং নারী ও মেয়েদের ক্ষমতায়ন করা।
৬. সুপেয় পানি ও পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থাঃ সবার জন্য পানি ও পয়ঃনিষ্কাশনের সহজ প্রাপ্যতা এবং টেকসই ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করা;
৭. নবায়নযোগ্য ও ব্যয়সাধ্য জ্বালানিঃ সবার জন্য ব্যয়সাধ্য, টেকসই ও আধুনিক জ্বালানি সুবিধা নিশ্চিত করা;
৮. কর্মসংস্থান ও অর্থনীতিঃ সবার জন্য দীর্ঘমেয়াদী, অন্তর্ভুক্তিমূলক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, পূর্ণাঙ্গ ও উৎপাদনশীল এবং উপযুক্ত কাজের সুবিধা নিশ্চিত করা।
৯. উদ্ভাবন ও উন্নত অবকাঠামোঃ দীর্ঘস্থায়ী অবকাঠামো তৈরি করা, অন্তর্ভুক্তিমূলক ও টেকসই শিল্পায়ন করা এবং উদ্ভাবন উৎসাহিত করা;
১০. বৈষম্য হ্রাসঃ দেশের অভ্যন্তরে এবং আন্তরাষ্ট্রীয় বৈষম্য হ্রাস করা;
১১. টেকসই নগর ও সম্প্রদায়ঃ নগর ও মানব বসতিগুলোকে অন্তর্ভুক্তিমূলক, নিরাপদ, দীর্ঘস্থায়ী এবং টেকসই করে তোলা;
১২. সম্পদের দায়িত্বপূর্ণ ব্যবহারঃ টেকসই ভোগ ও উৎপাদন রীতি নিশ্চিত করা;
১৩. জলবায়ু বিষয়ে পদক্ষেপঃ জলবায়ু পরিবর্তন ও এর প্রভাব মোকাবেলায় জরুরি পদক্ষেপ গ্রহণ করা;
১৪. টেকসই মহাসাগরঃ টেকসই উন্নয়নের জন্য মহাসাগর, সাগর ও সামুদ্রিক সম্পদের সংরক্ষণ এবং সেগুলোর টেকসই ব্যবহার করা;
১৫. ভূমির টেকসই ব্যবহারঃ পৃথিবীর ইকোসিস্টেমের সুরক্ষা, পুনর্বহাল ও টেকসই ব্যবহার করা;
১৬. শান্তি, ন্যয়বিচার ও কার্যকর প্রতিষ্ঠানঃ টেকসই উন্নয়নের জন্য শান্তিপূর্ণ ও অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজ তৈরি করা, সবার জন্য ন্যায়বিচারের সুযোগ প্রদান করা এবং সর্বস্তরে কার্যকর, জবাবদিহি ও অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা;
১৭. টেকসই উন্নয়নের জন্য অংশীদারিত্বঃ বাস্তবায়নের উপায়গুলো জোরদার করা এবং টেকসই উন্নয়নের জন্য বৈশ্বিক অংশীদারিত্ব পুনর্জীবিত করা।
বাংলাদেশের অবস্থান:
সূচকের ১২ নম্বরে পরিমিত ভোগ ও টেকসই উৎপাদন নিশ্চিত আর ১৩ নম্বরে জলবায়ু পরিবর্তন ও এর প্রভাব মোকাবেলায় জরুরী পদক্ষেপ গ্রহণের লক্ষ্য বাংলাদেশ অর্জন করেছে। এ দুটি অবস্থানে বাংলাদেশের রঙ ‘সবুজ’। তবে কয়েকটি সূচকে বাংলাদেশের অবনতির তথ্য দেওয়া হয়েছে।
এসডিজি-৪-এ বাংলাদেশকে সূচকের হলুদ তালিকায় রাখা হয়েছে। এর অর্থ হলো এসব ক্ষেত্রে লক্ষ্য অর্জনে আরো অনেক কাজ করতে হবে। এসডিজি-১, এসডিজি-২ , এসডিজি-৫, এসডিজি-৭, এসডিজি-৮, এসডিজি-১০-এ বাংলাদেশকে রাখা হয়েছে কমলা তালিকায়। অর্থাৎ এই ছয় লক্ষ্য অর্জনের পথে বাংলাদেশের সামনে উল্লেখযোগ্য মাত্রায় চ্যালেঞ্জ রয়েছে। এছাড়া এসডিজি-৩, এসডিজি-৬, এসডিজি-৯, এসডিজি-১১, এসডিজি-১৪, এসডিজি-১৫, এসডিজি-১৬ ও এসডিজি- ১৭ লক্ষ্য পূরণে বাংলাদেশকে লাল তালিকায় রাখা হয়েছে। অর্থাৎ এই আটটি ক্ষেত্রে লক্ষ্য পূরণ করতে গেলে বাংলাদেশকে বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে। ২০২১ সালে জাতিসংঘ ৪৮টি দেশে জরিপ চালায়। দেখা গেছে, ২৮ দেশই তাদের বার্ষিক বাজেটে এসডিজির প্রসঙ্গ রাখেনি। তারওপর করোনা মহামারী টেকসই উন্নয়নে মারাত্মক প্রভাব ফেলেছে। মহামারীর কারণে দারিদ্র্যের হার ও বেকারত্ব বেড়েছে। সূচকের শীর্ষে থাকা ফিনল্যান্ড এবং সবচেয়ে এগিয়ে থাকা নর্ডিক দেশগুলোও মহামারীর কারণে এসডিজির বেশ কিছু লক্ষ্য পূরণে কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে। এসডিজি নেটওয়ার্কের প্রেসিডেন্ট জেফ্রি ডি সাকস বলেন, ‘এসডিজির যে ছয়টি মূল লক্ষ্য, সেগুলোতে জোর দিয়েই উন্নয়নশীল দেশগুলোকে আর্থিক পরিকল্পনা সাজাতে হবে। আর্থিক খাতে বরাদ্দ বৃদ্ধি, কর কাঠামোর সংস্কারসহ আন্তর্জাতিক উন্নয়ন ব্যাংকগুলো থেকে অর্থায়ন বৃদ্ধির প্রয়োজন হবে।’ বাংলাদেশ এসডিজি’র যে জায়গাগুলোতে চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে, তার মধ্যে একটি হচ্ছে সুস্বাস্থ্য। বাংলাদেশের স্বাস্থ্যখাতের নাজুক অবস্থার বিষয়টি বিভিন্ন পত্রিকার প্রতিবেদন এবং গবেষণা প্রতিবেদন থেকে স্পষ্ট। বাংলাদেশের জেলা বা উপজেলা শহরে চিকিৎসা সেবার অপ্রতুলতার অভিযোগ বেশ পুরনো। সেখানে ভালো চিকিৎসক থাকেন না, হাসপাতালগুলোয় সরঞ্জামাদির অভাবের অভিযোগ রয়েছে। যতটুকু সেবা দেওয়ার সুযোগ রয়েছে অনিচ্ছুক মানসিকতার কারণে সেই সেবাটুকুও ভুক্তভোগীরা পায় না। শুধু জেলা উপজেলার চিত্র নয়, ঢাকা সহ বিভিন্ন বিভাগীয় শহরগুলোর হাসপাতালগুলোতেও চিকিৎসক, সেবিকা ও টেকনিশিয়ানের অভাব, আইসিইউ ও মেডিকেল সরঞ্জামের অপর্যাপ্ততার নানান চিত্র বিদ্যমান। একইসাথে পত্রপত্রিকায় উঠে এসেছে স্বাস্থ্যখাতের দুর্নীতির বিবিধ চিত্র।
গত কয়েক বছরে দেশজুড়ে যে হাজার হাজার বেসরকারি হাসপাতাল-ক্লিনিক গড়ে উঠেছে, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবসার বিপরীতে চিকিৎসা সেবা প্রদান করার মানসিকতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে প্রায়ই।
এখনো পৃথিবীতে প্রতি তিনজনের একজন স্যানিটেশন ছাড়াই বাস করে। এতে অপ্রয়োজনীয় রোগ ছড়াচ্ছে ও মৃত্যু ঘটছে। যদিও বিশুদ্ধ পানীয় জলের অ্যাক্সেস নিয়ে বিশাল অগ্রগতি সম্ভব করা হয়েছে, বিপরীতে স্যানিটেশনের অভাব এই অগ্রগতিগুলিকে ক্ষুন্ন করছে। আমরা যদি স্বাস্থ্যবিধি অনুশীলনে সাশ্রয়ী মূল্যের সরঞ্জাম এবং শিক্ষা প্রদান করি তবে আমরা এই অর্থহীন দুর্ভোগ এবং জীবনহানি বন্ধ করতে পারি। ২০১০ সালে বাংলাদেশে জনসংখ্যার মাত্র ৫৬% পর্যাপ্ত স্যানিটেশন সুবিধার অ্যাক্সেসে আছে বলে অনুমান করা হয়েছিল। কিন্তু গ্রামীণ অঞ্চলে স্যানিটেশন কভারেজ উন্নত করার জন্য একটি নতুন পদ্ধতি, যেমন— ‘সম্প্রদায়ের নেতৃত্বে সার্বিক স্যানিটেশন ধারণা’ বাংলাদেশে চালু করা হয়েছিল এবং স্যানিটেশন কভারেজ বৃদ্ধিতে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখার জন্য কৃতিত্ব দেওয়া হয়েছিলো। ২০১৫ সালে ৮৭% জনসংখ্যার “উন্নত” পানীয় জলের অ্যাক্সেস ছিল, এবং চিত্রটি গ্রামীণ এবং শহুরে এলাকার সমান ছিল। ২০১৫ সালে এখনো প্রায় ২১ মিলিয়ন জনগন “উন্নত” পানীয় জলের অ্যাক্সেসের অভাব ছিলো। স্যানিটেশন সম্পর্কে বলা যায়— মোট জনসংখ্যার ৬১% “উন্নত” স্যানিটেশনে অ্যাক্সেস ছিল, বা যথাক্রমে ৫৮% এবং ৬২%, শহর ও গ্রামীণ এলাকায়।
অবকাঠামোগত উন্নয়নে গত এক দশকে বাংলাদেশ যথেষ্ট উন্নয়ন করলেও আধুনিক প্রযুক্তির সাথে তাল মিলিয়ে কর্মসংস্থানের নতুন নতুন ক্ষেত্র তৈরিতে ততটা সফলতা অর্জন করেনি। প্রযুক্তিগত অগ্রগতি আমাদের বড় বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে সাহায্য করে, যেমন চাকরি তৈরি করা এবং আরো শক্তি সাশ্রয়ী হওয়া। উদাহরণ স্বরূপ, ইন্টারনেটের বদৌলতে পৃথিবী আরো বেশি আন্তঃসংযুক্ত এবং সমৃদ্ধ হয়ে উঠছে। আমরা যত বেশি সংযুক্ত হব, পৃথিবীর সর্বত্র মানুষের জ্ঞান এবং অবদান থেকে আমরা সবাই তত বেশি উপকৃত হতে পারব। তবে এখনো চার বিলিয়ন লোকের অনলাইনে যাওয়ার কোনো উপায় নেই, তাদের বেশিরভাগই উন্নয়নশীল দেশগুলোতে বসবাস করে। আমরা উদ্ভাবন এবং পরিকাঠামোতে যত বেশি বিনিয়োগ করব, আমরা সবাই তত ভালো থাকব। ডিজিটাল বিভাজন দূর করা, টেকসই শিল্পের প্রচার করা এবং বৈজ্ঞানিক গবেষণা ও উদ্ভাবনে বিনিয়োগ করা এসবই টেকসই উন্নয়নের জন্য গুরুত্বপূর্ণ উপায়।
বিশ্বব্যাপী শহরের জনসংখ্যার ভাগ ১৯৫০ সালের ২৫ শতাংশ থেকে দ্বিগুণ হয়ে ২০২০ সালে প্রায় ৫০ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। আমাদের পৃথিবী আগামী তিন দশকে ২০৫০ সালে ৬৮ শতাংশে নগরায়ন করতে থাকবে। মানবতার ভবিষ্যত শহুরে, এবং আমাদের ফোকাস পরিবর্তন করতে হবে। সামাজিক, অর্থনৈতিকভাবে, পরিবেশগতভাবে বঞ্চিত শহুরে এলাকাগুলিকে সংযুক্ত, গতিশীল, বৈচিত্র্যময় এবং প্রাণবন্ত পাড়ায় রূপান্তরিত করা, যা সকলের জন্য ক্রমবর্ধমান সফলতার মাধ্যমে সমতা অর্জনে সহায়তা করবে।
সাগর মানুষের জীবন সম্ভব করে তোলে। তাদের (সাগরের) তাপমাত্রা, তাদের রসায়ন, তাদের স্রোত, তাদের জীবন চক্র সম্মন্ধে গভীর জ্ঞান অর্জন এবং টেকসইভাবে তা মানুষের অনুকূলে ব্যবহার অত্যন্ত জরুরী একটি বিষয়। ৩ বিলিয়নেরও বেশি মানুষ তাদের জীবিকার জন্য সামুদ্রিক এবং উপকূলীয় বৈচিত্র্যের ওপর নির্ভরশীল। কিন্তু আমরা দেখছি বিশ্বের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ মাছের অত্যধিক শোষণ। এটি জীবনধারণের জন্য একটি টেকসই উপায় নয়। এমনকি যারা সমুদ্রের কাছাকাছি কোথাও বাস করে না তারাও এটি (সমুদ্র) ছাড়া বাঁচতে পারে না। মানুষ যে কার্বন-ডাই-অক্সাইড উৎপন্ন করে তার প্রায় ৩০ শতাংশ মহাসাগর শোষণ করে; কিন্তু আমরা আগের চেয়ে বেশি কার্বন ডাই অক্সাইড তৈরি করছি এবং শিল্প বিপ্লব শুরু হওয়ার পর থেকে এটি সমুদ্রকে আরো অম্লীয়— ২৬% বেশি করে তুলেছে। আমাদের আবর্জনাগুলো ব্যাপকভাবে সমুদ্রকে কলুষিত করে চলেছে—সমুদ্রের প্রতি বর্গকিলোমিটারে ১৩,000 টুকরো প্লাস্টিকের লিটার। অবাক হওয়ার মতো বিষয় বৈকি। টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা পানির নিচের জীবন ব্যবস্থাপনা ও সুরক্ষার লক্ষ্য নির্দেশ করে।
পার্থিব বাস্তুতন্ত্রের টেকসই ব্যবহার রক্ষা, পুনরুদ্ধার এবং পুনস্থাপন, টেকসইভাবে বন ব্যবস্থাপনা, মরুকরণের বিরুদ্ধে লড়াই করা, এবং জমির অবক্ষয় বন্ধ করা এবং বিপরীত করা এবং জীববৈচিত্র্যের ক্ষতি বন্ধ করা।
টেকসই উন্নয়নের জন্য সমাজকে শান্তিপূর্ণ ও অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজে উন্নীত করা, সকলের জন্য ন্যায়বিচারের সুযোগ প্রদান এবং সকল স্তরে কার্যকর, জবাবদিহিমূলক এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা।
টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা একটি খুব বড় করণীয় তালিকা। পারস্পারিক সহযোগিতা ব্যতীত এক্ষেত্রে সফলতা অর্জন দুরূহ। ইন্টারনেট, ভ্রমণ এবং বৈশ্বিক প্রতিষ্ঠানের বদৌলতে বিশ্ব আজ আগের চেয়ে অনেক বেশি আন্তঃসংযুক্ত। জলবায়ু পরিবর্তন বন্ধ করতে একসঙ্গে কাজ করার প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে ইতোমধ্যে ক্রমবর্ধমান ঐকমত্য হয়েছে। টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রাও কোনো ছোট বিষয় নয়। ১৯৩টি দেশ এই লক্ষ্যে একমত হয়েছে। এটি বেশ অবিশ্বাস্য, তবে সত্য। ১৯৩টি দেশ কোনো বিষয়ে একমত! চূড়ান্ত লক্ষ্য এবং অন্যান্য সকল লক্ষ্য অর্জনের জন্য জাতিগুলির জন্য একত্রে কাজ করার একটি উপায় তৈরি করেছে।
বাংলাদেশের ক্ষেত্রে কার্যকরী উন্নয়ন সহযোগিতার জন্য বিশ্বব্যাপী অংশীদারের পর্যবেক্ষণ প্রোফাইল অক্টোবর ২০১৬ অনুযায়ী সরকার একটি যুগান্তকারী সামাজিক নিরাপত্তা কৌশল এবং সপ্তম পঞ্চবার্ষিক উন্নয়ন পরিকল্পনা (২০১৬-২০) চালু করেছে। এটি সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট এজেন্ডা বা টেকসই উন্নয়ন বিষয়সূচি, লক্ষ্য ও লক্ষ্যমাত্রার সঙ্গে ভালোভাবে সংযুক্ত। ১৭টির মধ্যে ১৪টি এসডিজি লক্ষ্য সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় প্রতিফলিত হয়েছে।