ভারতবর্ষের প্রতিবাদ-রাজনীতির ভাষা-ভাব-বয়ানে মানবিক শূন্যতা

লেখকঃ শেকস্ রাসেল, এমএস, এমপিএস, এমডিপিএস


ভারতবর্ষ তথা বাংলাদেশ, ভারত এবং পাকিস্তানে সাম্প্রতিক পারস্পারিক রাজনৈতিক উত্তেজনা ও ধর্মীয় মেরুকরণে ইসলামী মৌলবাদ এবং হিন্দুত্ববাদ— দুই প্রবাহই একে অপরের দ্বারা পুষ্ট ও শক্তিশালী হচ্ছে। উভয় গোষ্ঠীই ধর্মীয় গ্রন্থ, ভয়ের রাজনীতি, এবং পরিচয়ভিত্তিক সংঘাতকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছে, ফলে মানবিক ও সার্বজনীন রাজনৈতিক ভাষা সংকুচিত হয়ে পড়ছে। মুসলিম নেতৃত্ব এবং জনগোষ্ঠীর ভয়-নির্ভর এবং অবশ্যপালনীয়-নির্ভর সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক চাপ পাল্টা প্রতিক্রিয়া হিসেবে হিন্দুত্ববাদকেও উগ্রবাদী হয়ে উঠতে আহ্বান করছে। এতে করে হিন্দুত্ববাদের পদ্ধতিগত নিপিড়ণের বিষয়টি আড়াল হয়ে যাচ্ছে। এভাবে কতিপয় হিন্দুত্ববাদী মহাজনই লাবভান হচ্ছে। “কোরআন ব্রিগেড” এবং “গীতা ব্রিগেড”— উভয়ই কাঠামোগতভাবে একই রকম প্রাতিষ্ঠানিক আচরণ তৈরি করে, যদিও তারা ভিন্ন ধর্মতত্ত্বে দাঁড়িয়ে আছে। এই ধর্মীয় বাইনারি সাধারণ মানুষের জীবনের বাস্তব সংকটকে প্রতিফলিত করে না; বরং শাসকগোষ্ঠী, রাজনৈতিক এলিট এবং কিছু পুঁজিপতি গোষ্ঠীর স্বার্থে পরিচালিত এক ধরনের ব্যবস্থাগত সংঘাত। এর মাধ্যমে দারিদ্র্য, বৈষম্য, গণতান্ত্রিক ক্ষয়, এবং রাষ্ট্র–পুঁজির যোগসাজশ আড়াল হয়ে যায়।

এই প্রবন্ধে যুক্তি দেওয়া হয়েছে যে, দক্ষিণ এশিয়ার বর্তমান ধর্মীয় রাজনীতির ভাষা মানবতাবাদী প্রতিবাদের স্থান সংকুচিত করেছে, এবং মানবতাবাদ–কেন্দ্রিক রাজনৈতিক ফ্রেমওয়ার্ক পুনর্নির্মাণ ছাড়া এই পারস্পরিক উগ্রবাদ থেকে উত্তরণ সম্ভব নয়।

মূল শব্দ: ইসলামিক মৌলবাদ, হিন্দুত্ববাদ, পারস্পরিক উগ্রবাদ, ভারতবর্ষ, পরিচয় রাজনীতি, মানবতাবাদ, মানবিক সংকট


দক্ষিণ এশিয়া দীর্ঘদিন ধরেই ধর্মীয় পরিচয়ভিত্তিক রাজনীতির উর্বর ক্ষেত্র। ভারত, বাংলাদেশ এবং পাকিস্তানে ধর্মীয় পরিচয়ের ওপর ভিত্তি করে রাজনৈতিক সংঘাত ও আন্দোলন নিয়মিত ঘটে থাকে (Jaffrelot, 2019)। সাম্প্রতিক দশকে ভারতের হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির উত্থান যেমন দৃশ্যমান, তেমনি তার সমান্তরালে দক্ষিণ এশিয়ার মুসলিম সমাজে বিভিন্ন মৌলবাদী প্রবাহও জোরদার হয়েছে (Ahmed, 2021)। এই প্রবন্ধের লক্ষ্য হলো— এই দুই প্রবাহ কীভাবে একে অপরকে পুনরুৎপাদন করছে এবং কীভাবে তারা সাধারণ মানুষের মানবিক রাজনৈতিক সম্ভাবনাকে ধ্বংস করছে, তা সমাজতাত্ত্বিক বিশ্লেষণের মাধ্যমে ব্যাখ্যা করা।

পরিচয়ভিত্তিক রাজনীতির বিশ্লেষণে দুটি ধারণা বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। প্রথমত, reciprocal radicalization, যা ব্যাখ্যা করে কীভাবে দুটি বিরোধী গোষ্ঠী একে অপরের অস্তিত্ব ব্যবহার করে নিজ নিজ উগ্রতা বাড়ায় (Neumann, 2017)। দ্বিতীয়ত, political technology of polarization, যা নির্দেশ করে যে শাসকগোষ্ঠী ইচ্ছাকৃতভাবে ধর্মীয়–পরিচয়ভিত্তিক অস্থিরতা তৈরি করে রাজনৈতিক সুবিধা গ্রহণ করে (Chakrabarty, 2020)। দক্ষিণ এশিয়ায় ইসলামী মৌলবাদ এবং হিন্দুত্ববাদ একে অপরকে পুনরুৎপাদন করে পরিচয়ভিত্তিক যে সংঘাত সৃষ্টি করছে, সেটি রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সুবিধার জন্য একটি প্রযুক্তি হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে।

দক্ষিণ এশিয়ার কিছু মুসলিম গোষ্ঠী ধর্মীয় শুদ্ধতার নামে ভয়ের সংস্কৃতি তৈরি করতে চায়। এটি ঘটে ধর্মীয় অনুশাসনকে রাজনৈতিক চাপ হিসেবে ব্যবহার, সামাজিক মাধ্যম ও গণমাধ্যমের মাধ্যমে ‘নৈতিক পুলিশিং’ এবং স্ক্রিপচারাল কর্তৃত্বের আগ্রাসী প্রয়োগের মাধ্যমে। এর ফলে “কোরআন ব্রিগেড” –ধর্মীয় মনস্তত্ত্ব সমাজে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়। অন্যদিকে, হিন্দুত্ববাদ দীর্ঘদিন ধরে “ঐতিহাসিক বিপন্নতার স্মৃতি” নির্মাণ করে এসেছে (Bhatt, 2001)। হিন্দুত্ববাদের এই অনুশোচনা মৌলবাদী ইসলামী চাপে উগ্রবাদী হয়ে প্রতিক্রিয় দেখায়। ফলাফলস্বরূপ, “মুসলিম হুমকি” বয়ান আরো শক্তিশালী হয়, সংখ্যাগরিষ্ঠত্বের আধিপত্য ন্যায্যতা পায় এবং রাষ্ট্রীয় নীতি কঠোর ও একত্রীকৃত হয়। ভারতে “গীতা ব্রিগেড” –ধর্মীয়, গোষ্ঠীর আগ্রাসী আচরণ বৃদ্ধি পায়।

যদিও আদর্শ ভিন্ন, দুই গোষ্ঠীর আচরণে কাঠামোগত সাদৃশ্য লক্ষ্য করা যায়। তারা দ্বন্দ্বমুখী পরিচয় নির্মাণ করে, মানবিকতার জায়গা সংকুচিত করে, অসহিষ্ণুতা ও নৈতিক পুলিশিং প্রয়োগ করে এবং সমাজকে পবিত্র/অপবিত্র ভাগে বিভাজিত করে। এই কাঠামো সাধারণ মানুষের স্বাভাবিক জীবন ও মানবিক রাজনৈতিক চর্চাকে একপ্রকার শূন্য করে দেয়।

ধর্মীয় মেরুকরণ রাজনৈতিক দলকে সুযোগ দেয় ভোটব্যাংক সংহত করতে, বিরোধী রাজনৈতিক প্রশ্নকে পাশ কাটাতে এবং গণতান্ত্রিক জবাবদিহিতা দুর্বল করতে। পাশাপাশি পরিচয়ভিত্তিক সংঘাত থেকে উপকৃত হয় নিরাপত্তা শিল্প, মিডিয়া কর্পোরেশন, ধর্মীয় ব্যবসা (ডোনেশন, মাদরাসা, আশ্রম), এবং দাঙ্গা–পরবর্তী পুনর্গঠন ঠিকাদার। এর ফলে দারিদ্র্য, বেকারত্ব, কৃষি সংকট, পরিবেশ সমস্যা— এসব গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক ও অর্থনৈতিক প্রশ্ন পিছনে পড়ে যায়।

ধর্মীয় রাজনীতি “পবিত্রতার লড়াই” হিসেবে ফ্রেম তৈরি করলে সাধারণ মানুষের মানবিক ভাষায় প্রতিবাদ করা কঠিন হয়ে পড়ে। সম্প্রতি কোরআন ও গীতা উভয়ই “প্রতিবাদের প্রতীক” হিসেবে ব্যবহৃত হলেও মানবিক প্রশ্ন— মানবাধিকার, শ্রম, সামাজিক নিরাপত্তা প্রায় অদৃশ্য হয়ে যায়। এটি মানবতাবাদী প্রতিবাদের স্থান সংকুচিত করে এবং রাজনৈতিক ভাষাকে ধর্মীয় ছাঁচে বন্দি করে।

দক্ষিণ এশিয়ার বর্তমান ধর্মীয় উত্তেজনা সাধারণ মানুষের লড়াই নয়; বরং এটি রাষ্ট্র, রাজনৈতিক এলিট এবং পুঁজিপতি গোষ্ঠীর ক্ষমতার কৌশলগত হাতিয়ার। ইসলামীক মৌলবাদ ও হিন্দুত্ববাদ একে অপরকে শক্তি দিচ্ছে, যা একটি পারস্পরিক উগ্রতার চক্র সৃষ্টি করেছে। এই চক্র ভাঙতে হলে মানবতাবাদী, সার্বজনীন ও অধিকারভিত্তিক রাজনৈতিক ভাষা পুনর্নির্মাণ জরুরী। মানুষকে বুঝতে হবে— হিন্দু–মুসলিম সংঘাত তাদের জীবনের উন্নয়ন বা নিরাপত্তার লড়াই নয়; এটি ক্ষমতাধর গোষ্ঠীর স্বার্থ রক্ষার রাজনীতি।

ভারতবর্ষে হিন্দুত্ববাদের বিরোধিতা ঐতিহাসিকভাবে জরুরী ছিলো। কিন্তু সেটি ইসলাম দিয়ে করার অর্থ পদ্ধতিগত এবং কাঠামোবদ্ধ মহাজাপ্রথার বিরুদ্ধে সমষ্টিগত এবং সিদ্ধান্তপ্রসূত মহাজনপ্রথা দাঁড় করানো। এটা আরো বিপদজনক হয়েছে। কতিপয়ের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে গিয়ে ভারতবর্ষে ইসলাম এসে সবাইকে ইসলামিক কতিপয় হতে বলছে। কিন্তু ‘সবাই’ কীভাবে ‘কতিপয়’ হবে? মানুষ হতে ইসলাম হিন্দুদের বলছে না, হিন্দুত্ববাদের বিপরীতে ইসলামিক শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠিত করতে চাইছে। অবশেষে ইসলামিক কতিপয় আর হিন্দু কতিপয় ভিন্ন অলংকারে কিন্তু একই তত্ত্বে লালিত হয়ে মানবতাবাদকে চেপে ধরেছে। ফলে বাংলাদেশের কোরআন ব্রিগেড, আর ভারতের গীতা ব্রিগেডের মধ্য আসলে কোনো পার্থক্য নেই। মানবতার খুনীরা মানুষের হাতে কোরআন এবং গীতা ধরিয়ে দিয়ে কেড়ে নিয়েছে প্রতিবাদের প্রকৃত ভাষা।

হিন্দু মুসলিমের এই দ্বন্দ্ব দ্বারা অবশেষে কতিপয় পুঁজিপতি, ক্ষমতাপ্রিয় এবং অহংকারপ্রিয় মানুষ লাভবান হলেও সাধারণ মানুষ এবং প্রাণ-প্রকৃতি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এখান থেকে বের হতে হলে মানুষকে বুঝতে হবে হিন্দু মুসলিমের এ যুদ্ধ সাধারণ মানুষের বেঁচে থাকা বা ভালো থাকার যুদ্ধ নয়। এটা শাসকগোষ্ঠীর অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক ক্ষমতার দ্বন্দ্ব । মানুষের স্থুল অহংকার এবং নির্বুদ্ধিতা যেখানে প্রধান মূলধন। সংকট আরো ঘনিভূত হ্য়, যখন মানবতাবাদী অংশ নিজ ধর্মের উগ্রবাদী এবং ধর্ম ব্যবসায়ীদের অপর ধর্মের মৌলবাদী, উগ্রবাদী এবং ধর্ম ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে পাল্টা বয়ান হিসেবে মনে করে, এবং তাদের প্রতি সহিঞ্চু হয়ে পড়ে। ঈশ্বরের আধ্যাত্মিক রূপকে প্রাধান্য দিয়ে বয়ান নির্ভর ধর্মগুলো ছুড়ে ফেলে দেওয়ার যে সংগ্রাম, সংগ্রামের সেই কঠিন পথ থেকে সরে গিয়ে বিপুল সংখ্যক সাধারণ মানুষের হাততালি এবং তাদের কাছ থেকে তাতক্ষণিক হাদিয়া পাওয়ার ইচ্ছাতে এবং জাতিগত ঘৃণার ডোপামিনে বিপুল এ জনগোষ্ঠীর মানবতাবাদী অংশও নিমগ্ন হয়ে পড়েছে কিনা সেটিই এখন বড় প্রশ্ন। এ সংকট থেকে বের হতে হলে এই প্রশ্নটির মীমাংসা হওয়া সবচেয়ে বেশী জরুরী।


References 

Ahmed, R. (2021). Islamic politics and identity in South Asia. Oxford University Press.

Banerjee, S. (2022). Populism, identity, and political conflict in India. Routledge.

Bhatt, C. (2001). Hindu nationalism: Origins, ideologies and modern myths. Berg.

Chakrabarty, D. (2020). The politics of polarization in South Asia. South Asian Studies Journal, 15(2), 45–62.

Jaffrelot, C. (2019). Majoritarian state: How Hindu nationalism is changing India. Hurst.

Neumann, P. (2017). Radicalized: New jihadists and the threat to the West. I.B. Tauris.