দেশটা আমার এবং আমার বাপের

উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগ

‘ব্যাপার না, বাপের না’ টাইটেল এর ভিডিও টা দেখলাম। কুচ্ছিত বলে একটা ধ্বনিবিপর্যিত শব্দ আছে৷ এই ভিডিওর ক্ষেত্রে সেটা ব্যবহার করা টা শ্রেয়।

কোটা আন্দোলন, সড়ক দুর্ঘটনা, তনু হত্যার বিচার, খেলাপি ঋণ বা অর্থ পাচার এই বিষয় গুলো নিয়ে যে দুর্বল কন্টেন্ট (আমাকে বললে আমি অন্তত একশোটা সলিড কন্টেন্ট খুঁজে দিতে পারতাম, হোম ওয়ার্কটা খুব কাঁচা ছিল) এর উদ্দেশ্য প্রণোদিত ভিডিও টা নেতিবাচক আক্রমণমুখী দেহভংগীকে উপজীব্য করে তৈরি হয়েছে তা দেখে মনে হয় দেশটা বুঝি ভিডিওর অভিনেতাদের ভাষাতেই তাদের ‘বাপের’ও না।

‘বাপের’ শব্দটা ব্যবহার করে আমরা সাধারণত একটা উত্তরাধিকারের ধারা বুঝাই৷ আপনি যখন ঘোষণা করে দেন যে দেশ কারো বাপের না, তখন আমাকে অবশ্যই দ্বিমত হতে হয়। কারণ দেশটা আমার এবং আমার বাপের। আমার হাজার বছরের উত্তরাধিকারের ধারা অস্বীকার করা সম্ভব নয়৷

তনু হত্যার বিচার না পাওয়া যদি এদেশের সবচেয়ে বড় ব্যর্থতা হয় তাহলে আমি অন্তত দুইশোটা রেইপ কেস দেখাতে পারবো যা বিএনপি জামায়াতের আমলে হয়েছে এবং সেসবের বিচার হয়নি। পয়েন্ট এটা না যে, এই জন্য তনু হত্যা কে সমর্থন করতে হবে। পয়েন্ট এটা যে, ধর্ষিতার হত্যাকাণ্ডের বিচার না পাওয়ার ঘটনায় দুই দলের পয়েন্ট যেহেতু শূন্য, তাই এটা কোনো এক দলের নির্বাচন ক্যাম্পেইন-এর প্রচারের বিষয় হতে পারে না৷ 
একইভাবে অন্তত একশোটা তুমুল আলোচিত ঘটনা দেখানো যায় যেখানে বখাটেদের অত্যাচারে আত্মহত্যা হয়েছে, এসিড সন্ত্রাস হয়েছে এবং বিএনপি জামাতের আমলে তার কোনো বিচার হয়নি। 
একইভাবে আপনি চাকরি চাইলে ( কোটা বাতিল আর চাকরি চাওয়া এক বিষয় না) মার খেয়েছেন বললে আমি মনে করিয়ে দিতে পারি বিএনপি জামাতের আমলে শিক্ষকদের এমপিও ভুক্তির দাবী করে অনশন করে শহীদ মিনারে থাকার কথা বা বাতিল হওয়া বিসিএস বহাল রাখার দাবীতে পরিবার নিয়ে বিসিএস চাকুরি প্রার্থীদের অনশনের কথা। আরো মনে করিয়ে দিতে পারি বিএনপি আমলে কানসাটে বিদ্যুত চেয়ে গুলি খেতে হয়েছিল৷ মধুপুরে পীরেন স্লান আর চলেশ রিছিল কে মরতে হয়েছিল ভূমির অধিকার চাইতে গিয়ে৷ পানির দাবীতে জনরোষ থেকে বিএনপির দৌড় সালাউদ্দিন এর জন্ম হয়েছিল৷ গনপিটুনির ভয়ে দৌড় দেয়া সালাউদ্দিন এবার আবার প্রার্থী। সালাউদ্দিন এর না হয় লজ্জা নেই, কিন্ত তাকে দৌড়ানি দেয়া সবাই একই সাথে আলঝেইমারের রোগী হয়ে গেছে তাতো মনে হয় না। ভুলে যাওয়া আমাদের স্বভাব। তাই আমরা ভুলে গেছি।

নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের কথা আসলেই আমার মনে পড়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের হ্যাপির কথা। শাহবাগে সড়ক দুর্ঘটনায় সে মারা যাবার পরের দিন বামদল এর স্টুডেন্ট উইংয়ের ছেলে মেয়েরা শাহবাগ মোড়ে একটা ফুট ওভার ব্রিজ এর জন্য মানব বন্ধন করতে যেয়ে ছাত্রদলের যে নির্মম হামলার শিকার হয়েছিল সে কাহিনী বাম’রা ভুলে গেলেও তখনো বিশ্ববিদ্যালয়ে না আসা আমার মনে আছে এখনো।

এরকম বিএনপি আমলের অজস্র দুঃসহ অভিজ্ঞতার স্মৃতি আমি মনে করতে পারি কোনো গবেষনার কষ্ট না করেই৷ আমার মূল বক্তব্য শুধু এই যে, যে ঘটনাগুলো দিয়ে আওয়ামীলীগের বিরুদ্ধে নেতিবাচক ক্যাম্পেইন করা হচ্ছে সে বিষয়গুলোতে বিএনপি জামায়াতের আচরণ একই হতো৷ কোটা আন্দোলন বা সড়ক আন্দোলনের অভিজ্ঞতা বিএনপি আমলে ঘটলে ভিন্ন ধরনের মধুর স্মৃতি হতো এ দাবী কেউ করতে পারবে না। তাই এ ঘটনাগুলোর ভিত্তিতে আমি দুই দলের পার্থক্য করা যায় বলে মনে করি না।

মজার ব্যাপার হলো, ভিডিও তে কোথাও কোনো দলের হয়ে ভোট চাওয়া হয়নি। স্রেফ তারুণ্য কে জাগাতে চাওয়া হয়েছে। এবং অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি তারুণ্যের অর্জনের সবচেয়ে বড় উদাহরণ গণজাগরণ আন্দোলনের কথা এই ভিডিওতে নেই৷ তারুণ্যের আন্দোলনের উদাহরণ দিতে গেলে যাদের কোটা আন্দোলন আর সড়ক আন্দোলনের কথা মনে পড়ে কিন্ত গণজাগরণ আন্দোলনের কথা বলে না, দেশটা আসলেই তাদের বাপের না।

আরো মজা হল, যে ভিডিও তে এই সরকারের ব্যর্থতা হিসেবে কিন্ত পাহাড়ে আর্মির নিপীড়নের তীব্রতা নিয়ে কোনো প্রতিবাদ আসে না। রামু বা নাসিরনগরের সাম্প্রদায়িক হামলার কথা আসে না। গাইবান্ধা পুড়ে যাওয়া সাঁওতাল পল্লীর কথা আসে না। সরকারের এই বৃহত্তর ব্যর্থতার কথাগুলো যখন তারা ভিডিওতে এড়িয়ে যায় তখন আমি বুঝতে পারি এই ইস্যুগুলো তাদের কাছে ও কোনো ব্যাপার না এবং যথারীতি তারা মনে করে যে দেশটা হিন্দু বৌদ্ধ বা আদিবাসীদের বাপের না।

কিন্ত না। দেশ টা আমার। এবং অবশ্যই আমার বাপের।

আমার ও আমার বাপের পক্ষ থেকে সবাইকে বড়দিনের শুভেচ্ছা৷


সোনম সাহা   ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

সহকারি অধ্যাপক

উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়