সম্পদের হিসেব মানুষ সবসময় করে এসেছে বস্তুগতভাবে। এক সময় যে শক্ত সমর্থ ছিল সে বেশি সম্পদশালী ছিল, কারণ, সে বেশি শিকার করতে পারত। এরপর কৃষিভিত্তিক সমাজে যে বেশি জমি চাষাবাদ করতে পারত সে ছিল বেশি সম্পদশালী। সামান্ত সমাজে যে বেশি জমির মালিক ছিল সে ছিল বেশি সম্পদশালী।
আধুনিক সমাজে মানদণ্ডের একটু পরিবর্তন হলেও বিষয় প্রায় একই থাকছে। যার একটি ভালো চাকরি বা ভালো ব্যবসা আছে সে সম্পদশালী, বেশি জমির মালিক এখনো সম্পদশালী এবং এটা সম্ভবত ভবিষ্যতেও থাকবে।
এখানে একটি প্রশ্ন আছে, আমরা সম্পদের ওপর ভর করি, ঠিক বিপরীতক্রমে সম্পদ আমাদের চাপাও কি দেয় না? চাকরি দিয়ে আমরা চলি, চাকরিও কি আমাদের চালায় না? বেশিরভাগ ক্ষেত্রে বর্তমান অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় জীবিকার প্রয়োজন মানুষকে পরিচালিত করছে।
মানুষ নিজের জীবনযাপন করছে না, সে আসলে জীবকা নির্বাহ করছে, বিপরীতে তার সামনে তুলে ধরা হয়েছে কিছু প্রয়োজন অতিরিক্ত পণ্য, যেগুলোকে প্রেস্টিজ এবং একান্ত ভোগের উপকরণ হিসেবে মানুষকে ভাবতে শেখানো হয়েছে। আসলে সেগুলো তা নয়।
ব্যক্তি কখনো তার অন্তরের দিকে তাকিয়ে দেখার সুযোগ পায় না এ ব্যবস্থায়— আসলে তার চাহিদা কী বা সে কে? “আমি কে?” এই প্রশ্নের মধ্যেই রয়েছে মানব মুক্তি, কিন্তু প্রশ্নটি হারিয়ে ফেলেছে আধুনিক সমাজ।
কখনো কি এভাবে হিসেব করে দেখেছি— ঠিক কতটা সময় আমরা বাধ্য হয়ে পরিচালিত হই? অভাব বাধ্য করে, অভ্যাস বাধ্য করে, সম্পদও কিন্তু বাধ্য করে, এবং সবচেয়ে বেশি বাধ্য করে আসলে সম্পদ।
তাহলে বাধ্য করে না কে? বাধ্য করে না আপন প্রকৃতি বা আপন খেয়াল। অর্থাৎ আপনার যে প্রকৃতি বা স্বভাব সেটিই আপনি, সেখানে কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। আবার এই প্রকৃতি কিন্তু জন্মগ্রহণ করে আপনাআপনি হয়নি। একটা প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে মানুষ তৈরি হয়, সেই তৈরি মানুষটাকেই হয়ত ভুল পথে বাধ্য করে আধুনিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা! নিশ্চিতভাবে বলা যায় যে, আধুনিক এ অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় কোথাও না কোথাও বড় গলদ রয়েছে। যে গলদের কারণে শুধু বস চাকরকে পরিচালিত করছে নয়, চাকরও বসকে পরিচালিত করছে, কারণ, ধাওয়া করতে গেলে আপনাকে নিজেকেও দৌঁড়াতে হবে। সবচেয়ে ভয়ঙ্কর বিষয় হচ্ছে, আধুনিক সমাজ “আপন খেয়াল” বলতে নেতিবাচক একটি বিষয় হিসেবে আখ্যা দিয়ে রেখেছে!
যার প্রকৃতি গাছে ওঠা (যেমন, বানর) তাকে আপনি পানিতে রাখলে সে বাঁচবে না; এটা দৃশ্যমান, তাই বোঝা সহজ। মনের ব্যাপারটাও তাই, যে মন গান গাইবে তাকে আপনি খেলোয়াড় বানাতে চাইলে বুড়িগঙ্গা নদীর মতো তার অবস্থা হবে। হবে না, হচ্ছে না?
যে মানুষ জন্মেছে সৃষ্টির জন্য তাকে আপনি সারাক্ষণ স্রষ্টা চেনালে সে আপনার স্রষ্টাকে হত্যা করতে চাইবেই। স্রষ্টা কাউকে বলেনি— “আমাকে ডাকো, আমাকে রাত বেরাত খুশি করো।” বলেছে?
সম্পদশালী তাহলে কে? উত্তর খুব সহজ— যে নিজের প্রকৃতি এবং স্বভাব অনুযায়ী কাজ করতে সমর্থ হয় সেই শুধু সম্পদশালী। তাহলে যে স্বভাবগতভাবে চোর সে কি চুরি করবে? এখানে পাল্টা প্রশ্ন আছে, স্বভাবগতভাবে কেউ কেন চোর হবে? জন্মের পর থেকে কোনো পরিবার, সমাজ বা প্রতিষ্ঠান তাকে চোর হতে শেখায়নি, তারপরেও যদি কেউ চোর হয়, সেটি তার অর্জিত বৈশিষ্ট্য হতে পারে না, এটাও এই সিস্টেমেরই গলদ।
আসলে মানুষ জন্মায় একটি উন্নত মস্তিষ্ক নিয়ে— মস্তিষ্কগুলো বিভিন্ন ধরনের হতে পারে, কিন্তু কোনোটিই অকার্যকর নয়, এবং কোনোটিতে কিছু সে নিয়ে জন্মায়নি, এটি শুধু উৎপাদনের একটি কারখানা। কী উৎপাদিত হবে সেটি ব্যক্তিই ঠিক করবে একদিন, তবে তার আগে একটা প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে সেই ব্যক্তিত্বটা তৈরি হবার সুযোগ থাকতে হবে। সেই সুযোগটা কি আমাদের সমাজে আছে?
তাই বলে আপনি প্লেনের ইঞ্জিন দিয়ে জাহাজ চালাতে গেলে তো হবে না, হবে? সেটি (মস্তিষ্ক) কি কাজে ব্যবহৃত হবে প্রাথমিকভাবে তা ঠিক করে দেয় পরিবার, প্রতিষ্ঠান এবং সমাজ। এর মধ্যে সুযোগ থাকতে হবে— ব্যক্তি যেন নিজেকে চিনে নিজের পছন্দ ঠিক করতে পারে। সবাই পারবে না, যারা পারবে তাদের জন্য সুযোগ থাকতে হবে।
যে সমাজে মানুষ যত বেশি মুক্ত, সে তার মস্তিষ্ক তত বেশি তার স্বভাব অনুযায়ী ব্যবহার করতে পারে। এজন্যই শিক্ষাজীবনে মানুষকে মুক্ত রাখা খুব জরুরী, এবং কর্মজীবনেও। স্কুল পর্যায়ে সব ধরনের সুযোগ শিক্ষার্থীর সামনে উপস্থাপন করা জরুরী। তাহলে সে তার মস্তিষ্কের গড়ন অনুযায়ী কাঙিক্ষত সুযোগটি গ্রহণ করতে পারবে। এখানেই একমুখী শিক্ষার প্রয়োজনিয়তা, অন্তত দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত একমুখী শিক্ষা থাকা উচিৎ, যাতে ব্যক্তি বুঝতে পারে কোনদিকে তার মতি।
এখন তো আসলে জীবনটা নষ্ট হচ্ছে। যার সাহিত্যে মতি নেই, সে সাহিত্যে পড়ছে, যার বিজ্ঞানে মতি-গতি নেই, সে বিজ্ঞানে পড়ছে। ভয়ঙ্কর বিষয় হচ্ছে, এক সময় জীবিকার তাগিদে এরাই আবার এসব পড়াচ্ছে!
চাকরির ব্যাপারটা তো আরো মারাত্মক। যে যেদিকে পারে ছুটছে, উদ্দেশ্য যেভাবেই হোক একটা চাকরি বাগানো। যে চাকরির জন্য পড়ছে সে-ও এ কারণে তীব্র অনিচ্ছা সত্ত্বেও পড়ছে শুধু একথা ভেবে যে, একটি চাকরি পেয়ে তাকে পরিবারের ভরণপোষণ করতে হবে, সমাজে মর্যাদা নিয়ে বাঁচতে হবে।
অথচ বাহ্যিক মর্যাদার চেয়ে নিজের স্বস্তি অনেক বেশি জরুরী। “পরের হাতের ধন” বলতে আমরা শুধু টাকা পয়শা বুঝি, কিন্তু “সম্মান-খ্যাতি” এগুলোও আসলে পরের হাতের ধন, তাই এসবের পিছনে ছুটে কখনো প্রকৃত সুখ হয় না। অন্যের দিকে তাকিয়ে থাকতে হয় সারাক্ষণ।
কিন্তু বৈশিষ্ট্যগুলো নিজের, দক্ষতা-যোগ্যতা একান্ত নিজের, দৃষ্টিভঙ্গিটা নিজের। একজন পাঁচ কিলোমিটার বেগে দৌঁড়াতে শিখেছে, কিন্তু আমি শিখেছি দশ কিলোমিটার বেগে দৌঁড়াতে, ফলে আমার জীবন সহজ হয়েছে। এটা অন্যকে দেখিয়ে হাত তালি নেওয়ার চেয়ে নিজের কাজে লাগানো বেশি জরুরী। কারণ, যারা হাততালি দিবে তারা বিভিন্ন প্রশ্নও তুলবে, বিভ্রান্ত করে দিবে।
জাত চেনাতে হবে, কিন্তু তার আগে তো জাত অর্জন করতে হবে। নিজের জায়গাটা খুঁজে নিতে হবে। যে ধাতুর যে বৈশিষ্ট্য— বিষয়টা অনেকটা এরকম। আগে তো সোনা হতে হবে। সোনাকে কোনোভাবেই কেউ লোহা বলে ডাকতে পারবে না তখন, যদি সে একান্ত নির্বোধ না হয়।
অর্থাৎ জীবনের উদ্দেশ্য হচ্ছে, নিজের প্রকৃতি-বৈশিষ্ট্যটা ঠিক করে দেওয়া, দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি করা এবং মানুষের সামনে সেটি তুলে ধরতে পারা। বস্তুগত সম্পদ, সম্মান, জনপ্রিয়তা— এগুলো সব প্রায় একই বিষয়, সবই চেপে বসে এক সময়, কিন্তু স্বস্তি দেয় না।
প্রকৃতপক্ষে একজন ‘আমি’ হয়ে ওটাটাই জীবন, জীবনের অমূল্য সম্পদ। ঐ ‘আমি’ টা থেকে যায়। খুব দ্রুত নিঃশ্বেষ হয় না তা, সম্পদ যত দ্রুত নিঃশ্বেষ হয়। এই ‘আমিত্ব’ অহংকার নয়, বড়ামী নয়, এটা হচ্ছে— একটি উন্নত সমাজের বিল্ডিং ব্লক।
একটি সমাজের বেশিরভাগ মানুষের কোনো প্রকৃতি না থাকা, এবং তাদের প্রকৃতি চেনানোর মানসিকতা না থাকাটাই সবচেয়ে ভয়ঙ্কর, কারণ, এরা দলে ভেড়ে— কেউ হিন্দুর দলে, কেউ মুসলমানের দলে, কেউ বাউলের দলে, কেউ ফাউলের দলে, কেউ আবার রবীন্দ্রনাথকেও একজন দলনেতা বানিয়ে নিয়ে মঞ্চ সাজায়।
মানুষকে মুক্ত করতে হলে প্রতিটি মানুষকে একজন ‘আমি’ হয়ে ওঠা শেখাতে হবে। প্রতিটি ‘আমি’ স্বতন্ত্র, এবং বিশেষ বৈশিষ্ট্যের অধিকারী হবে। কাজ করবে, আড্ডা দিবে, প্রেম করবে, সঙ্গম করবে, কিন্তু দিনশেষে মানুষ নিজের কাছেই ফিরবে। নিজের মাঝে সুন্দর এবং শক্তিশালী একটা ‘আমি’ না থাকলে মানুষ ফিরবে কার কাছে তখন?