বঙ্গবন্ধু বেঁচে থাকলে মানুষের দেশ বানিয়ে ছাড়তেন

গণসমাবেশ

আমাদের মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিল পৃথিবীর বুকে একটা মানুষের দেশ বানাবার জন্য। বঙ্গবন্ধু বেঁচে থাকলে সেটি বানিয়েও ছাড়তেন। ধাপে ধাপে তিনি সেটি করছিলেন। বঙ্গবন্ধু যখন বুঝেছিলেন যে, শতভাগ ভারতের সাথে থাকলেও আসলে মানুষের দেশ হবে না, তখন তিনি কিছুটা পাশ কাটিয়ে ছিলেন, বিভিন্ন কৌশলে এগোতে চেয়েছিলেন। কৌশলাবলম্বন একজন রাজনীতিবিদকে করতেই হয়। সবসময় সব কৌশল যে ঠিক হয় তা অবশ্যই নয়।

বঙ্গবন্ধু খুব দ্রুত দেশের মানুষকে আস্থায় নিতে চেয়েছিলেন। মানুষের প্রতি, বিশেষ করে বাঙলার মানুষের প্রতি বঙ্গবন্ধুর অন্ধ বিশ্বাস ছিলো বলেই এই ভুলটি তিনি করেছিলেন। পৃথিবীর বুকে বাংলাদেশকে এমন একটি দেশ হিসেবে গড়তে চেয়েছিলেন যেটি মানব সভ্যতায় একটি মাইলফলক হয়ে থাকত। কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি। একটা সময়ে গিয়ে বিপদের দিনের বন্ধু ভারতকে তিনি কিছুটা দূরত্বে রেখেছিলেন সম্ভবত দেশের ভারতবিরোধী অংশের আস্থা বাড়াতে। কিন্তু উগ্রবাদী, ধর্মদস্যু তথা জঙ্গিবাদীরা সুযোগটা নিয়ে নেয়— হত্যা করা হয় রাজনীতির এই মহানায়ককে বর্বরভাবে, সপরিবারে। বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার ফলে দেশটা শতভাগ চলে গিয়েছিলো অমানুষদের দখলে। স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি, হত্যাকারী, লুটেরা, ধাপ্পাবাজ, শয়তানেরা সব দখল করে নিয়েছিলো।

যতই গত পনেরো বছর আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকুক না কেন দেশটা এখনও প্রধানত তাদেরই দখলে, অমানুষদেরই দখলে। তারা সরকারে এবং সরকারের বাইরে বিভিন্ন চিপায় চাপায় লুকায়ে আছে, ফণা তুলে আছে। ধন সম্পদ হারানোর ভয়ে চুপ করে থাকে শুধু, কিন্তু সুযোগ পেলে ছোবল দেবেই, কারণ, এটাই তাদের বৈশিষ্ট্য, এটাই দুবৃত্তের বৈশিষ্ট্য হয়। দুবৃত্তরাও এখন সব আওয়ামী লীগ হয়ে গেছে, কারণ, দুবৃত্তরা স্বার্থে সবই করতে পারে, সবই হতে পারে। আওয়ামী লীগের এটি একটি সমস্যা— বঙ্গবন্ধুর সময়ও সমস্যাটা কিছুক্ষেত্রে ছিলো বলে বলা হয়– যে কেউ আওয়ামী লীগে ঢুকে অতি আওয়ামী লীগ হয়ে যে কোনো কিছু করতে পারে। এ জায়গাটিতে আওয়ামী লীগকে অনেক কিছু ভাবতে হবে।

সেই যে অন্ধকারের শক্তি সবকিছু দখল করেছিলো সম্ভব হয়নি তাদের হাত থেকে সবকিছু আবার মুক্ত করা– গত পনেরো বছরে আওয়ামী সরকার সে চেষ্টা করতে খুব যে সমর্থ হয়েছে তা কিন্তু নয়। কেন সমর্থ হয়নি? ইতিবাচকভাবে বললে বলতে হবে— দুর্নীতি এবং দুবৃত্তায়নের গণপ্রবনতা রয়েছে যে দেশে সেরকম একটি দেশের সরকারের চাইলেই দেশটাকে রাতারাতি ভালো করে ফেলতে পারে, সে রকমটি মনে করার আসলে কোনো কারণ নেই। আর নেতিবাচকভাবে বললে বলতে হবে— রাজনৈতিক প্রতিহিংসার চেয়ে বেশি জরুরী দুর্নীতি বন্ধ করা, কারণ, দুর্নীতি মানুষকে কষ্ট দেয়, দুর্নীতিতে মানুষের সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়। সেটি না করে অন্য অনেক কিছু— অনেকক্ষেত্রে যেগুলো মানুুষের কাছে অপ্রয়োজনীয় মনে হয়, সেগুলো করলে সরকারের প্রতি মানুষের আস্থা নষ্ট হয়।

তাই আওয়ামী লীগ সরকারের একমাত্র প্রধান কাজ এই কাঠামোগত উন্নয়ন হতে পারে না, প্রধান কাজ মানুষের দেশ বানানো, মুক্তিযুদ্ধের প্রতিশ্রুতি রক্ষা করা। আরো বেশি জনমুখী, সমাজবাদী, ধর্মনিরপেক্ষ হতে না পারলে শুধু গোজামিল দিয়ে বেশিদিন মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ওপর সরকার দাঁড়িয়ে থাকতে পারবে না। ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট প্রয়োজন আছে কিনা সেটি আইনজ্ঞরা বলবে। কিন্তু সাদা চোখে বলা যায়— বাংলাদেশে আইনের অপপ্রয়োগ হয়, খুব বাজেভাবে তা হয়। আইনের অপ্রয়োগে বা ভুল প্রয়োগে যেমন মানুষ ঠকে, নির্যাতিত হয়; আবার আইনের অপপ্রয়োগেও মানুষ ঠকে, ঠকছে, মানুষ নির্যাতিত হচ্ছে।

কোনোমতে একটা নির্বাচন অনুষ্ঠান করে ক্ষমতায় এসে আওয়ামী লীগ সরকার যদি বাংলাদেশটাকে মানুষের দেশ বানানোর কাজে সর্বাংশে হাত দিতে না পারে, সর্বস্তর থেকে যদি অমানুষদের ক্ষমতা থেকে ঝেটিয়ে বিদায় করতে না পারে, যদি আরো শক্ত হতে না পারে, যদি আরো নৈতিক হতে না পারে, তাহলে অবশ্যই নতুন প্রজন্মের মধ্য থেকে একটি শক্তি বা অপশক্তি জেগে উঠবে, যারা প্রকৃতপক্ষেই প্রস্তুত হয়ে আছে। সেটি ভালোর চেয়ে খারাপ হবার সম্ভাবনাই বেশি— মৌলবাদী সাম্প্রদায়ীক অমানুষদের বাচ্চাকাচ্চারাই হয়ত দেশটাকে আবার দখল করে ফেলবে! আখেরে মানুষই চূড়ান্তভাবে ঠকবে। গত পনেরো বছরে সরকারের সকল আয়োজন ভেস্তে যাবে।

নতুন প্রজন্মের মধ্যে অত্যন্ত সচেতন একটি গ্রুপ— মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের একটা শক্তিও আছে, যারা শেখ হাসিনার সরকারকে সুযোগ দিচ্ছে, দিতে চাচ্ছে। এর মানে এই নয় যে, লাগাতার সুযোগ দিয়ে যাবে, আপনারা যদি ভেবে থাকেন ‘গণজাগরণ মঞ্চ’ ব্যর্থ হয়েছে, আপনারা যদি ভেবে থাকেন ব্লগার হিসেবে আমাদের ভাইদের আত্মত্যাগ ব্যর্থ হয়েছে, তাহলে ভুল করবেন।

জাস্ট আরেকটি সুযোগ। আর কিছু না। পদ্মা সেতু বানান, কিন্তু তার চেয়ে বেশি যেটা করবেন— মানুষের দেশ বানান, ধর্ম বর্ণ নারী পুরুষ নির্বিশেষে মানুষের দেশ বানান। লাগামহীন দুর্নীতি বন্ধ করেন, মানুষকে হয়রানি করা বন্ধ করেন, দেশটাকে কাগজে কলমে এবং আচরণে ধর্মনিরেপেক্ষ বানান। ’৭১ এর শহীদের বুকের ওপর দাঁড়িয়ে, এই অঞ্চলের পরিবর্তীত ধর্মীয় সংস্কৃতির বাস্তবতা মেনে নিয়ে, বাঙালি সংস্কৃতি অটুট রাখতে বাধ্য হয়ে কোনো ধর্ম রাষ্ট্র টিকে থাকতে পারবে না, যেকোনো বিবেচনায় কতিপয়ের রাষ্ট্র টিকে থাকতে পারবে না। ‘একটি মানবিক রাষ্ট্রব্যবস্থা’ সেটিই ছিল মুক্তিযুদ্ধের প্রতিশ্রুতি, বৈষয়িক উন্নতি সমান্তরাল ধাপ বা দ্বিতীয় বা তৃতীয় ধাপ।


লিখেছেন দিব্যেন্দু দ্বীপ

https://www.youtube.com/watch?v=Uu967gl03MU