বাংলাদেশের সংখ্যালঘুদের বিপদটা শুরু হয়েছে ১৯৪৭ সাল থেকে, ২০২৪ থেকে শুধু নয়। প্রথমত, এই বিষয়টি উপলব্ধি করতে হবে। দ্বিতীয়ত, সংখ্যালঘুদের পরিচয় সঠিকভাবে নির্ধারণ করতে হবে।
ব্রিটিশ উপনিবেশ থেকে স্বাধীনতা লাভের সময় ভারতবর্ষ ভাগের পটভূমি এবং ঘটনাবলী নিয়ে নানান আলোচনা এ যাবৎকাল রয়েছে। অনেকে মনে করেন, একজাতি বা দ্বিজাতি তত্ত্বের মীমাংসা না হওয়ায় এই ভূখণ্ডটি ভারত এবং পাকিস্তান নামে বিভাজন হয়েছিলো ধর্মের ভিত্তিতে।
ব্রিটিশ উপনিবেশ থেকে স্বাধীনতা লাভের প্রাক্বালে উচ্চশিক্ষিত এবং নিধর্মী (যদিও তিনি জন্মসূত্রে মুসলিম) মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ নেতৃত্ব চেয়েছিলেন। কিন্তু হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ ভারত সে নেতৃত্ব মেনে নিতে ছিলো অপারগ। অন্যদিকে হিন্দু-মুসলিম ঘৃণা-বিদ্বেষ পৌঁছে গিয়েছিলো রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে। পরিণতিতে ভারত এবং পাকিস্তানের জন্ম হলেও দুই দেশে সংখ্যালঘু হিসেবে অবশিষ্ট হিন্দু এবং মুসলিম সম্প্রদায়ের লোকেরা পড়ে যায় বিপদে। সে বিপদ থেকে রাষ্ট্র হিসেবে ভারতের লাভই হয়েছিলো। ইসলামের অভিসন্দর্ভ ভারতে সংখ্যালঘু হিসেবে নতুনরূপে আবির্ভুত হয়, কিন্তু পাকিস্তান ধীরে ধীরে ধর্মীয় সংখ্যালঘুমুক্ত হয়ে বৈচিত্র্য হারায়।
পাকিস্তানের আঞ্চলিক এবং উর্দু সংস্কৃতিকে চেপে ধরে আগন্তুক আরবীয় সংস্কৃতি। পাকিস্তান এই অভিসন্দর্ভই মেনে নিতে বাধ্য হয় যে, আরবই ভারতবর্ষে মুসলিম সংস্কৃতির জনক, যদিও সেটি কোনোভাবেই সত্য নয়। ভারতবর্ষে যোদ্ধা আরবরা ক্ষমতা দখলে সহায়ক হলেও এ অঞ্চলে ইসলামের প্রসার ঘটেছে পারস্য এবং তুরস্কের সুফি তাত্ত্বিকদের দ্বারা। ফলে হিন্দু-মুসলিমের ঐতিহ্যগত অহংকারের দ্বন্দ্বে নিশ্চিতভাবে আরেকটি তত্ত্ব চাপা পড়ে আছে, যে তত্ত্বের স্ফুরণ ঘটে লাল শাহবাজ কালান্দার রক্তাক্ত হলে।
উল্লেখ্য, পাকিস্তানের জামশোরো জেলার সেওহানে অবস্থিত লাল শাহবাজ কালান্দারের মাজারে ২০১৭ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারিতে একটি আত্মগাতী বোমা হামলার ঘটনা ঘটে। সন্ধ্যায় মাজারে ভক্তরা আধ্যাত্বিক সুফি সাধনায় লীন থাকা অবস্থায় বোমা হামলাটি করা হয়। স্থানীয় হাসপাতালের সূত্রমতে, নারী ও শিশুসহ প্রায় ৮৩ জন লোক নিহত হন এবং ২৫০ জনের অধিক আহত হন।
একথা তাই অনস্বীকার্য যে, ১৯৪৭-এর পর থেকে ভারত জঙ্গিবাদ এবং উগ্রবাদ মুক্ত থাকতে পেরেছে তার ২০ শতাংশ মুসলিম জনগোষ্ঠীর কারণে, না হলে মাওবাদীদের মতো অনেক আদিবাসী এবং আঞ্চলিক সশস্ত্র জঙ্গিগোষ্ঠী তাদের সামলাতে হতো, যেটি তকদিরে বিশ্বাসী সংখ্যালঘু মুসলিমদের সামলানোর চেয়ে অনেক বেশি কঠিন। অর্থাৎ, ভারত এবং বাংলাদেশ একটি বাফার সম্প্রদায় পেলেও পাকিস্তান সেটি পায়নি।
প্রশ্ন হচ্ছে— বাংলাদেশ কি এই বাস্তবতা বুঝতে ব্যর্থ হচ্ছে? ভারত কি বাংলাদেশকে এই বাস্তবতা বুঝতে দিতে চাচ্ছে না বাংলাদেশকে পাকিস্তানের মতো একটি রাষ্ট্র বানানোর অভিপ্রায় থেকে? তাহলে বাংলাদেশ কি আসলে ভারতের বর্তমান শাসকগোষ্ঠীর পাতা ফাঁদে পা দিচ্ছে? কোন দিকে যাচ্ছে বাংলাদেশ?
এক্ষেত্রে বাংলাদেশের সংখ্যালঘুূদের বিপদটা আসলে কোথায়?
প্রথমেই বুঝতে হবে— বাংলাদেশে সংখ্যালঘু আসলে কারা? বাংলাদেশে অনেকেই সংখ্যালঘু। দু’টি চারটি সন্তান কোলেপিঠে নিয়ে দ্বারে দ্বারে ঘুরে বেড়াচ্ছে যে সকল নারী, তাদের চেয়ে সংখ্যালঘুতো আসলে কেউ নেই, আছে? আবার একা ইলনমাস্কই তো গোটা বাংলাদেশের চেয়ে বেশি সংখ্যাগরিষ্ঠ। ফলে রাজনৈতিক এবং ধর্মীয় পরিচয়ের সাথে অর্থনৈতিক পরিচয়টি যোগ করে সংখ্যালঘুদের সংকট অনুধাবন করতে হবে। রাজনৈতিক সংকটকালে কেউ সম্পদ বা পদ হারায়, কেউ জীবন হারায়। যে বা যারা জীবন হারায়, তারাই মূলত সংখ্যালঘু, বেশি সংখ্যালঘু।
১৯৪৭ থেকে ২০২৫ — ভারত এই জায়গাটিতেই ব্যর্থ হয়েছে। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন করতে গিয়ে যে সংখ্যালঘু নিধন হয়েছে, সে নিধনের চরিত্রটি যেমন ভারত নিরূপণ করেনি, করতে চায়নি। পরবর্তীতেও ভারত বুঝতে চায়নি বাংলাদেশের প্রকৃত সংখ্যালঘুদের কষ্ট। বিপরীতে কয়টি পূজো হলো, কয়জন সংখ্যালঘু মন্ত্রীত্ব পেলো বা সচিব হলো সে পরিসংখ্যানেই আটকে থেকেছে বাংলাদেশের সংখ্যালঘুদের দুঃখকষ্টের সীমানা। মাঝখান দিয়ে সর্বহারা সংখ্যালঘুরা দেশ হারিয়ে হন্তদন্ত হয়ে ভারতে ঢুকে যে দেশ পেয়েছে, এক প্রজন্ম পেরিয়ে গেলেও কি সেটি কখনো তাদের নিজের দেশ হয়েছে? উদ্বাস্তু পরিচয় থেকে বেরিয়ে আসতে পেরেছে? পারেনি।
অন্যদিকে দুই দেশের বাস্তবতাতেই এমন মানুষের সংখ্যা তো অনেক, যারা ধর্ম রক্ষার দায় নাখাভূখাদের ওপর চাপিয়ে দিয়ে ইলন মাস্কের মতো উভয় দেশেই সংখ্যাগরিষ্ট। দুই দেশেই সমান অহংকারী ‘গ্রিন লাইন পরিবহন’ এবং ‘শ্যামলী পরিবহন’, আবার প্রায় ষাট বছর আগে ভারতে এসেও এখনো উদ্বাস্তু বিপুল দাস অথবা তৃপ্তি রাণী দাস। তাদের আধার কার্ড হয় না, পাসপোর্ট হয় না, কিন্তু আলী আব্বাস টাকার জোরে সংখ্যালঘু হয়েও ভারতে এসে প্রভাবশালী, পাসপোর্টধারী। ভেলোরের মুসলিম কলোনিতে প্রায় সবাইই নাগরিক হিসেবে যেমন ভারতীয়, আবার মনস্তত্ত্বে বাংলাদেশীও। একইকথা বাংলাদেশের প্রভাবশালী হিন্দুদের জন্যও সত্য— দু’টো দেশই তাদের, তাহলে দেশ নেই আসলে কাদের?
লেখকঃ পিএইচডি গবেষক, প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়, কোলকাতা।