দেখুন, লিখে রাতারাতি কিছু পরিবর্তন করা যায় না। এটা একটা নিরবিচ্ছিন্ন প্রচেষ্টা। লেখালেখি খুব যৌক্তিক একটা বিষয়। যা মন চায়, তা লেখার সুযোগ নেই, সবকিছুকে রোমান্টিক যুগের সাহিত্য বানিয়ে ফেলা আধুনিক যুগের বৈশিষ্ট্য হতে পারে না।
আপনাকে ভেবে দেখতে হবে— আপনি যা লিখছেন তার যৌক্তিকতা কী? আপনি কিন্তু নিজে পড়ার জন্য লিখছেন না, আপনি লিখছেন অন্যের পড়ার জন্য, অন্যে পড়বে বলেই আপনাকে অন্যের কথা ভাবতে হবে।
ধর্ম দীর্ঘদিনের অনূশীলীত একটা বিষয়, হাজার বছর ধরে মানুষ কিছু রীতিনীতি লালন করছে বিশ্বাসের আলোকে, যেগুলো সামষ্টিকভাবে ধর্ম হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। ধর্ম নিয়ে অনেক কথা বলা যায়, প্রাসঙ্গিকভাবে অনেক কিছু বলার দরকারও, সেক্ষেত্রে কেউ আপনাকে মারতে আসবে না বলেই আপাতভাবে ধরে নেওয়া যায়।
যদিও দৃষ্টান্ত তা বলে না, ভুল বুঝে, নিজেদের ইচ্ছেমত ব্যাখ্যা দাড় করিয়ে, গায় পড়ে অপমানিত হয়ে শারীরিকভাবে আক্রমণ করে ধর্মান্ধরা, আক্রমণ করায় ধর্ম ব্যবসায়ীরা। সেই সুযোগটি যথাসম্ভব দেওয়া যাবে না ওদের।
কিন্তু এসব জেনেও আপনি গালাগালি করার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়েন কেন? পৃথিবীর কয়েক শো কোটি লোকে যা মেনে চলছে, এক ঝটকায় তা উড়িয়ে দিতে চাওয়াটা কিন্তু বোকামি ছাড়া আর কিছু নয়। বোকামী এই অর্থে যে, সরাসরি এভাবে বলে কিছু পরিবর্তন করার আগেই জীবনটা দিয়ে দিতে হবে?
বিজ্ঞান এবং ধর্ম মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেওয়ার দায়িত্ব কিন্তু আপনার-আমার নয়। প্রয়োজনে তারা নিজেরাই মুখোমুখি দাঁড়িয়ে যাবে এবং একটি টিকে থাকবে, অথবা সাম্যবস্থায় চলবে, কৌশলে সে অবস্থাটা তৈরি করে দিতে হবে। এটা সত্য যে, এভাবে পরিস্থিতি তৈরি করা খুব সহজ কথা না। তাছাড়া একজন লেখক এত কৌশল করবেই বা কেন?
মনে রাখতে হবে— একজন লেখক হয়ত কৌশল করবে না, কিন্তু সমাজ সংস্কার করতে গেলে কৌশলী হতে হয়। আর সমাজের পরিবর্তনের জন্য কাজ করাটা সমাজ সংস্কারেরই অংশ বা সরাসরি সমাজ সংস্কার।
অনাবিষ্কৃত অংশটুকু সবসময়ই ধর্ম হিসেবে স্বীকৃত হয়ে থাকবে, পৃথিবী ধ্বংসের আগ পর্যন্ত মানুষের ধরা ছোঁয়ার বাইরে অনেক কিছু থাকবে, তাই আপনি আমি বললেই ঈশ্বর বিনাশ হয়ে যাবে –এমনটি ভাবার কোনো কারণ নেই। ঈশ্বর থাক, থাকলে সমস্যা কী? নাস্তিকেরও তো ঈশ্বর আছে, নেই? আপনার অদেখা-অজানা-কল্পনায় ভেসেবেড়ানো বিষয়গুলোকে আপনি কী বলবেন?
যুক্তিতে আপনি মানতে চান ঈশ্বর নেই, কিন্তু তাতে মুক্তি কি হয়? মাঝে মাঝে ‘মূর্খের’ ঈশ্বর এসে আপনাকেও কি নাড়া দিয়ে যায় না? এটাই বাস্তবতা, এখানেই মানুষের অসহায়ত্ব। আপনি যতটা অসহায়, পৃথিবীর কোটি কোটি মানুষ তার চেয়ে অনেক বেশি অসহায়। ধূর্ত অসভ্য দূর্নীতিবাজ লম্পট বাটপাড়দের কথা বাদ দেন— অসহায় মানুষদের কথাই ধরুণ না, তারা যাবে কোথায়?
আমার দিদিমা, শেষ বয়সেও যার একটি সন্তান মারা গিয়েছে, সে যাবে কোথায়? তার তো একমাত্র ঈশ্বরেই আশ্রয়। আমার মা, সারাক্ষণ তার একটাই কথা, কী আর করা, ঈশ্বর যা চেয়েছে তাই হয়েছে, তার মতো একজন অতি ভালো মানুষকে কি আমি বলব– “মা, এসব বাদ দাও তো, ঈশ্বর বলে কিছু নেই”? বলব না। বলার প্রয়োজন নেই।
প্রচলিত ধর্মগুলোকে বিশ্বাস না করার যথেষ্ট কারণ আছে—এই ধর্মগুলোকে খারিজ করতে হবে, মানুষের অন্তরের ঈশ্বরকে না। এ অর্থে আপনি নাস্তিক হতে পারেন, কিন্তু তাই বলে সে নাস্তিকতার চর্চা আপনি কেন সব জায়গায় করতে যাবেন, ঢোল পিটাবেন কেন মতলববাজ অথবা সাইকোপ্যাথ আস্তিকদের মতো?
তাছাড়া আরেকটা বিষয় খুব গুরুত্বপূর্ণ, নাস্তিকতাকে আস্তিকতার বিপরীত তত্ত্ব হিসেবে ভাবার কোনো দরকার নেই। কারণ, আসলে নাস্তিকতা তেমন কিছু নয়। নাস্তিকতা মানে বিষফোঁড়া কেটে ফেলা, নতুন কোনো কিছু সংযোজন করা নয়। মানবজাতির কাঁধে সেই বিষফোঁড়া হচ্ছে এখন শাস্ত্রীয় ধর্মগুলো। একইসাথে এটাও মনে রাখতে হবে যে, এইসব ধর্মের বিরোধিতা করতে গিয়ে আমরা যেন মানব জাতির জন্য প্রয়োজনীয় কাল্পনিক সে আধ্যাত্মিক ঈশ্বরকে বধ করার দায়িত্ব কাঁধে তুলে না নিই।