মানুষের অপরিপূর্ণতা এবং ধনীর কান্না

দিব্যেন্দু দ্বীপ


আমার ছোটবেলা খুব বেশি আগে নয়। তবু তখনো আমি কিছু পরিপূর্ণ মানুষ দেখেছি। পূর্ণতা মানে খ্যাতির চূড়া নয়, ধনাড্যতা নয়, এটা একটা অনুভূতি, সেই অনুভূতির মানুষ তখন ছিল।
গ্রামের সেরা হাডুডু খেলোয়াড় তখন নিজেকে পরিপূর্ণ মনে করত, যে ঐ গ্রামে ভালো গাইত সে নিজেকে পরিপূর্ণ মনে করত, সবাইকে টেক্কা দিয়ে বাজারের বড় মাছটি কেনার সামার্থ যার ছিল, সে নিজেকে পরিপূর্ণ মনে করত। তখন তুলনা ছিল মূলত ঐ গ্রামের মধ্যে, বড়জোর পাশের গ্রামের কারো সাথে। রাস্তাঘাট ছিল না, বিদ্যুৎ ছিল না, কোনো গণমাধ্যমের অস্তিত্ব ছিল না। মানুষের আনন্দ-বেদনার সবটুকু তখন ছিল স্থানীয়। গ্রাম্য শত্রুতা ছিল, দলাদলি ছিল, তবে সবচেয়ে বেশি ছিল সার্বজনীনতা। সুখ-দুঃখ সবই ছিল তখন সার্বজনীন। মানুষ পাশে দাঁড়াত। পরিপূর্ণ ঐ মানুষগুলো তখন মানুষের জন্য সময় ব্যয় করত।
এখন চিত্র পুরোপুরি বদলে গেছে। রাস্তাঘাট হয়েছে, বিদ্যুৎ পৌঁচেছে। টেলিভিশনে সবাই এখন বিশ্ব দেখছে। গ্রামের সেরা খেলোয়াড় জানছে যে সেরা নয় সে, যে গান গাইয়ে তৃপ্ত ছিল সে জানছে যে সে তারকা নয়। গ্রামের ধনী ব্যক্তি, কাউকে দুই পয়শা দিয়ে যে শ্লাঘা অনুভব করত, সে জানছে যে তার ভোগ করার বাকী আছে আরো অনেক কিছু। বিশ্বায়ন পৌঁছে গিয়েছে, বিশ্বায়নের ধামাকা মানুষকে অস্থির করে তুলছে, কিন্তু মানুষকে শান্ত করার মতো কোনো উপকরণ থাকছে না।
দুই ধরনের মানুষ মানুষের পাশে দাঁড়াতে পারে—
১. সর্বহারা (মানসিকভাবে);
২. পরিপূর্ণ মানুষ (মানসিকভাবে)।
ভালো খেয়েপরে কিছু টাকা বাঁচলে একসময় মানুষ নিজের বাড়িতে কোনো অনুষ্ঠান করে পাড়ার মানুষ ডেকে খাওয়াত, নিজের টাকায় টুর্নামেন্ট আয়োজন করত। অথবা নির্বাচন করে নেতা হতে চাইত, টাকা উপার্জনের জন্য নয়, খরচ করার জন্য, একটু নাম চ্যাতানোর জন্য।
কিন্তু সব মানুষই এখন ‘চাই’ গ্রুপের অন্তর্ভুক্ত। কারো হয়ত ভালো থাকার জায়গা আছে, কিন্তু ঢাকায় বাড়ি নেই। কারো হয়ত ঢাকায় বাড়ি আছে, কিন্তু লন্ডনে গেলে কষ্ট করে হোটেলে থাকতে হচ্ছে। সুন্দর বউ আছে, কিন্তু সে শারাপোভার মতো সুন্দরী এবং চ্যাম্পিয়ন নয়। স্বামী ধনী, কিন্তু বিলগেটসের মতো ধনী নয়। গাড়ী আছে, কিন্তু সেটি পোরশে নয়। ঘুরতে গেছি, কিন্তু সমস্ত পৃথিবীর সব ভালো ভালো জায়গায় এখনো যাওয়া হয়নি।
অর্থাৎ দেখা যাচ্ছে, কেউই এখন ধনী নয়, পরিপূর্ণ নয়। যেহেতু সে জেনে গেছে পৃথিবীটা তার হাতের মুঠোয় এবং টাকা হলে সব মেলে, তাই মানুষের তৃপ্ত হওয়ার কোনো সুযোগ এখন আর নেই, যদি সেরকম কোনো শিক্ষা সে নিজের মধ্যে জাগ্রত করতে না পারে।
এরকম একটা কথা এখন খুব শোনা যায়— এত টাকা আছে কিন্তু একটা টাকা কারো পিছনে খরচ করতে চায় না লোকটা। ঠিকই আছে, টাকা অনেক আছে বটে, কিন্তু তাতে তো তার হচ্ছে না। তাই আরো দশ টাকা হলেও তা তার দরকার। সেও তো অভাবে পড়ছে— কেউ অভাবে পড়ছে বাজারে গিয়ে এক আঁটি পুঁইশাক কিনতে না পেরে, কেউ অভাবে পড়ছে পিয়ইয়ং ঘুরতে গিয়ে ভালো হোটেলে আরো দুইরাত বেশি থেকে সবকিছু দেখে-চেখে আসতে না পেরে। কেউ দুঃখে আছে ঘরের চাল ঠিক করতে না পেরে, কেউ দুঃখে আছে পুরান ঢাকার বাড়ি বেঁচে গুলশানে একটি বাড়ি করতে না পেরে।
দুঃখের অনুভূতি এবং তীব্রতা তো একই, চাপা কান্না তাই ধনীর এখন গরীবের চেয়ে কম নয়। আক্রোশও তার বেশি। আক্রোশ তার চারপাশের মানুষের প্রতিই বেশি। আরো দুপয়শা বাগাতে না পারার কষ্ট তার কিছুতেই যায় না, এবং এজন্য সে দায়ী করে চারপাশের মানুষকে, সিস্টেমকে। সিস্টেমকে এখন সবাই দোষে, ধনীও দোষে, গরীবও দোষে!
কোনো না কোনো বিবেচনায় সব মানুষ এখন বিক্রেতা, এবং চারপাশের মানুষ তার ক্রেতা, সবার কাছে বেঁচতে না পেরে, কৌশল করে না উঠতে পেরে, আরো বেশি ঠকাতে না পেরে, সে ক্লান্ত-ক্ষুব্ধ। চারপাশের মানুষকে তাই সে শত্রু জ্ঞান করে, এমনকি বন্ধুকেও। তাহলে শত্রুর পাশে সে দাঁড়াবে কেন?