বাট্রান্ড রাসেল যুক্তি দিয়েছিলেন যে— আমরা আমাদের ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে যে জগতকে দেখি তা অনিবার্যভাবে বাস্তব জগত নয়, বরং একটি ‘ইন্দিয়-তথ্য’ জগৎ, যা আমাদের উপলব্ধির ওপর নির্ভরশীল।
আপনাকে বুঝতে হবে— আপনি যা দেখছেন, আপনি যা বুঝতে পারছেন, সেটি একমাত্র সত্য নয়, হয়ত সেটি কোনো সত্যই নয়। এই পরিবর্তনশীল জাগতিক সত্তায় আমাদের উপলুব্ধ ভাবনাকে আমরা ততটুকুই প্রাধান্য দিতে পারি একটি চকলেটকে একটি শিশু যেভাবে প্রাধান্য দেয়, এটি শেষ হয়ে যাবার আগ পর্যন্ত শিশুটি এটি চুষতে থাকবে, এবং মজা পেতে থাকবে। এটি ফুরিয়ে গেলে সে অন্য কোনো চকলেট পেতে চাইবে। একটু বুঝমান শিশু হলে দেখবেন এবার সে ভিন্ন কোনো চকলেট নিতে চাইবে। অর্থাৎ, কোনো একটি আদর্শবাদ নিশ্চিতভাবে শেষ হয়ে যাওয়া পর্যন্ত অনেকের এটা বুঝতে অপেক্ষা করতে হয় যে, এটাই শেষ কথা নয়। কারণ, তারা এটি দ্বারা শিশুর ঐ চকলেট চোষার মতো মজা পেতে থাকে।
পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশিদিন ধরে টিকে থাকা আদর্শবাদ হচ্ছে ধর্ম। এর কারণ কী? কারণ, এটি সামনে এমন এক অদৃশ্য এবং অপ্রমাণযোগ্য সত্তা সামনে এনেছে, যা মানুষকে শুধু মোহবিষ্ট করে না, অনেকক্ষেত্রে মুক্তিও দেয়। মানবমুক্তির প্রয়োজনে ধর্ম বেশি ব্যবহৃত হয়েছে, নাকি মোহবিষ্ট করতে বেশি ব্যবহৃত হয়েছে সেটি নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। যেমন, ডেসমন্ড টুটু, যিনি দক্ষিণ আফ্রিকান অ্যাংলিকান বিশপ এবং ধর্মতাত্ত্বিক, যিনি বর্ণবাদ বিরোধী এবং মানবাধিকার কর্মী হিসাবে তার কাজের জন্য পরিচিত, তার একটি বক্তব্য ফেসবুকে ঘুরে বেড়ায়, ধর্ম কীভাবে সম্রাজ্যবাদের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে সে বিষয়ে তিনি বলেছেন, “যখন মিশনারিরা আফ্রিকায় এসেছিলো তখন তাদের কাছে বাইবেল ছিলো এবং আমাদের কাছে ছিলো জমি। তারা বলল, ‘আসুন প্রার্থণা করি।’ আমরা চোখ বন্ধ করলাম। আমরা যখন চোখ খুলে তাদের দেখতে পেলাম, তখন দেখি আমাদের কাছে বাইবেল ছিলো এবং তাদের কাছে ছিলো জমি।
অনেকে মনে করে— বেদ-বাইবেল-কোরআন বোধহয় ঈশ্বরকে টিকিয়ে রেখেছে। আসলে কি তাই? মোটেও নয়। ঈশ্বর টিকে আছে মানুষের অসহায়ত্বে, ঈশ্বর টিকে আছে সৌভাগ্যে এবং দুর্ভাগ্যে, ঈশ্বর টিকে আছে অজানায়, ঈশ্বর টিকে আছে অসিমের ঠিকানাই, যা কিছু মানুষের জানা নাই।
ধরুণ, বাংলাদেশের সংবিধানে মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে কিছু লেখা নেই, তাকে কি মুক্তিযুদ্ধের মাহাত্ম বিলিন হয়ে যাবার কথা? যে কতিপয় শব্দ দিয়ে আপনি মুক্তিযুদ্ধের চেতনা দাঁড় করিয়েছেন, তার বিপরীতে কি কোনো অদৃশ্য সত্তা দাঁড় করাতে পেরেছেন, যেটি প্রকৃতপক্ষেই মানুষকে আশ্রয় দেয়? এক্ষেত্রে তো মানুষ পরলৌকিক আশ্রয় চাচ্ছে না, ইহজাগতিক আশির্বাদও একটি রাষ্ট্রের কাছ থেকে মানুষের চাওয়া নয়, এটা মানুষের খেয়ে-পরে-চলে-ফিরে ভালো থাকা বা না-থাকার বিষয়। কেন সামাজিকভাবে আমাদের মুক্তিযুদ্ধ এমন একটি অবস্থান পেল না, যার পক্ষে বয়ান না দিলেও স্বয়ংক্রিয়ভাবে তা একটি সত্তা হয়ে ওঠে, সংবিধান ছুড়ে ফেলে দিলেও মানুষের ইহজাগতিক মুক্তির সাময়িক সনদ হয়ে তা থেকে যায়, ঠিক যেমন ‘বাইবেল’ বা এরকম অন্য কোনো গ্রন্থ ছুড়ে ফেলে দিলেও একজন স্ব স্ব ঈশ্বর থেকে যায় মানুষের মনে।
এটা হয়নি, কারণ, আপনারা ‘বাইবেল’ দেখিয়ে জমি কেড়ে নেওয়ার মতো করে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ব্যবহার করতে চেয়েছেন, বিষয়টি মানুষের মনে গেঁথে দেওয়ার চেয়ে বইয়ের পাতায় গেঁথে দিতে বেশি মনোযোগী হয়েছেন। একটি ইহজাগতিক বোঝাপোড়ার বিষয়কে অতিজাগতিক বিষয়ের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিয়েছেন। না হলে বলুন তো কোন যুক্তিতে মুক্তিযুদ্ধের বয়ান এবং ধর্ম মুখোমুখি দাঁড়িয়ে যেতে পারে? ধর্ম মানে যদি ঈশ্বর হয়, তাহলে কি এমনটি হওয়ার কথা? গলদ আসলে কোথায়? এটাও কি তাহলে সত্য যে, ’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ ধর্মীয় সম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধেও দাঁড়িয়েছিলো? সেই সত্যের ফলেই কি মুক্তিযুদ্ধ এবং ইসলাম মুখোমুখি দাঁড়িয়ে যায়, নাকি এটা শুধুই একটা রাজনৈতিক খেলা, যার মধ্যে সবসময়ই শাসকগোষ্ঠীর স্বার্থ নিহীত থাকে?
সংবিধানের মাথার উপর ‘বিসমিল্লাহির রহমানির রাহিম’ লেখার আগ পর্যন্ত জনগণ জানতো না যে, এটা সংবিধানের মাথার উপর থাকা দরকার। এতে করে কি জনগণের ক্ষুধানিবৃতি হয়েছিলো, দেশ দুর্নীতিমুক্ত হয়েছিলো, দেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলো, নাকি জনগণকে শুধুই মোহবিষ্ট করা হয়েছিলো এবং একটা অন্ধ অহংকারের মধ্যে ঠেলে দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছিলো? ’৭২-এর মূল সংবিধানে তা ছিলো না। জিয়াউর রহমানের সময় সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমেই ‘বিসমিল্লাহির রহমানির রাহিম’ যুক্ত করা হয়। বিষয়টি শাসক জিয়াউর রহমান কেন করেছিলেন? কারণ, তিনি বা তার উপদেষ্টারা বুঝতে পেরেছিলেন— “জমি কেড়ে নিতে হলে জনগণের হাতে বাইবেল ধরিয়ে দিয়ে চোখ বন্ধ করতে বলতে হবে”। একইভাবে আপনারাও কি মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ধরিয়ে দিতে চাননি? দেখুন, ধর্ম ধরিয়ে দেওয়া সহজ, কারণ, ধর্মের পিছনে মহাপরাক্রমশালী এক অপ্রমাণযোগ্য অতিজাগতিক সত্তা আছে— ঈশ্বর আছে, কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ধরিয়ে দেওয়া সহজ নয়, কারণ, এটি শুধুই একটি সনদ, যেটির সফলতা নির্ভর করে মানুষের ইহজাগতিক মুক্তি— ক্ষুধা-দারিদ্য-দুর্নীতি-নৈরাজ্য থেকে মুক্তির মধ্য দিয়ে। আপনারা কি মানুষকে শাসকের শৃঙ্খল হতে মুক্ত করতে পেরেছেন, নাকি মানুষকে পদে পদে আরো শৃঙ্খলিত করেছেন? তাহলে মানুষ কেন শুধু একটি কাগজের সনদ মেনে নেবে? মানুষ তো সংবিধান পড়তে চায় না, মানুষ আপনারা যেটা বলেন, তার বাস্তবায়ন দেখতে চায়। আপনারা যখন বলেছিলেন, আমাদের মুক্তিযুদ্ধ মানে অর্থনৈতিক সমাজতন্ত্র, মানুষ বিশ্বাস করেছিলো; আপনারা যখন বলেছিলেন, আমাদের মুক্তিযুদ্ধ মানে ভোটাধিকার, মানুষ তা বিশ্বাস করেছিলো। ইহজাগতিক প্রয়োজনে এই দু’টি তারা বিশ্বাস করেছিলো, কিন্তু তারা অতিজাগতিক কোনো বিষয় লিখিতভাবে মানতে চায়নি। কেন আপনারা সংবিধানকে বাইবেল বানাতে গেলেন? ‘বাঙালি’ জাতিয়তাবাদ, নাকি ‘বাংলাদেশী’ জাতিয়তাবাদ; ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’, নাকি ‘ধর্মান্ধতা’ —এগুলো কি সংবিধানে লিখে দেওয়ার খুব দরকার ছিলো? সামাজিক বিতর্ক হিসেবে এগুলো সবসময়ই ছিলো, আছে, থাকবে। সংবিধানে এন্টি থিসিস ঢুকানোর ফলাফল হয়েছে, দুবৃত্তরা বস্তাপঁচা থিসিস আরো জোরালোভাবে ঢুকিয়ে দেওয়ার সুযোগ পেয়েছে।
ধর্ম মানা না-মানা এবং ঈশ্বর মানা না-মানার প্রশ্নটি জোরালোভাবে সামনে আসে অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষের দিকে। যদিও ধর্ম মানা না-মানার বিষয়টি ঈশ্বর মানা না-মানার বিষয়টির সাথে সমার্থক নয়। তারপরও যেহেতু এখানে আলোচ্য বিষয় সেটি নয়, তাই একইঅর্থে ধরে নিয়ে এটা বলা যায়— অধিকারের এ লড়াইটি এখনো বহমান এবং অমিমাংসীত। অর্থাৎ, “তোমার ধর্ম মানার অধিকার যেমন রয়েছে, তেমনি আমার ধর্ম না মানার অধিকারও রয়েছে”। উল্লেখ্য, ধর্ম আর ঈশ্বর এক নয়, এবং পৃথিবীতে অনেক মানুষ রয়েছে, যারা ধর্ম না মানলেও ঈশ্বররূপ কোনো একটি সত্তায় তারা বিশ্বাস করে।
কিন্তু একটি দেশের সংবিধান মানতেই হয়, কারণ, এটি আইন, এটি একটি দেশের নির্দিষ্ট সময়ের জন্য ইহজাগতিক নির্দেশনা। এটি পরিবর্তনশীল, সময়ের বিবর্তনে সে পরিবর্তন প্রয়োজনীয়। কিন্তু যখন চেতনার প্রশ্ন আসে, তখন তো আপনাকে মানুষকে না-মানার অধিকারও দিতে হবে। যেমন ধর্ম বা ঈশ্বর না-মানার অধিকার রয়েছে। থাকা উচিৎ। তা না হলে ধর্মজীবী এবং উগ্রবাদীদের সাথে আপনার-আমার পার্থক্য থাকে কোথায়? কেউ যদি বলে আমি মুক্তিযুদ্ধের চেতনা পছন্দ করি না, মানি না, সেটি বলার অধিকার তাকে দিতে হবে। আবার একইসাতে এটাও সত্য যে দেশের সংবিধান তাকে মেনে চলতে হবে। এই সংবিধান মেনে চলার অর্থ কিন্তু এটা নয় যে, ‘বাইবেল’-এ মাথা ঠোকার মতো কেউ সংবিধানে মাথা ঠুকবে, এটা মানুষের আইনি বাধ্যবাধকতা। আইনি বাধ্যবাধকতাকে ভালোবাসায় পরিণত করতে চাওয়া বোকামী।
মুক্তিযুদ্ধের চেতনার মতো কোনো চেতনা ছাড়াই আইসের শাসন এবং মানবিক মূল্যবোধ এবং জ্ঞান-বিজ্ঞান দিয়ে অনেক দেশ ভালো চলছে, চলছে না? এই চেতনার বাড়াবাড়ি বেশি প্রয়োজন, নাকি আইনের শাসন, দুর্নীতিমুক্ত বাংলাদেশ এবং ঐতিহাসিক দায়মুক্তি বেশি প্রয়োজন। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে রাজনীতি যতটা হয়েছে, মুক্তিযুদ্ধের ক্ষয়ক্ষতির নিরূপণ কি কখনো ততটা হয়েছে? সকল ধরনের হত্যাকাণ্ডের বিচার হয়েছে, গণহত্যার বিচার হয়েছে? অর্থাৎ, ইতিহাসের দায়মুক্তি এবং মানুষের প্রাপ্য বিচারিক অধিকারের দিকে নজর দেওয়া হয়নি। মুক্তিযুদ্ধকে প্রধানত ক্ষমতায় থাকার হাতিয়ারে পরিণত করা হয়েছে, এবং সেটি করা হয়েছে ধর্মের সাথে জগাখিচুড়ি পাকিয়ে, সব দলই কম বেশি তাই-ই করেছে। কোনো দল মুক্তিযুদ্ধ বেশি ব্যবহার করেছে, ধর্ম ব্যবহার করেছে সমানতালে, কোনো দল ধর্ম ব্যবহার করেছে, মুক্তিযুদ্ধ ব্যবহার করেছে প্রয়োজনমতো। এই বাস্তবতায় জনগণের আস্থা রাখার জায়গাটা ঠিক কোথায় অবশিষ্ট থাকে?
জনগণ কখন স্বৈরাচার হয়ে ওঠে? যখন সবদিক থেকে অন্ধকার ধেয়ে আসে, যখন দেয়ালে পিঠ ঠেকে যায়, তখন অন্ধ মানুষটাও বিদ্রোহ করতে বাধ্য হয়। শুধু ষড়যন্ত্র তত্ত্ব খুঁজলে এ সমস্যার সমাধান হবে? ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনকে বলা হয়েছিলো ভারত এবং হিন্দুদের চাপিয়ে দেওয়া আন্দোলন। ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধকেও তাই বলা হয়েছিলো। শাসকগোষ্ঠী মানুষের অধিকারের আন্দোলনের মধ্যে সবসময়ই ষড়যন্ত্রের গন্ধ পায়। কিছু ইন্ধন থাকতে পারে, তাই বলে আপনি মানুষের স্বতস্ফুর্ততাকে অস্বীকার করবেন কীভাবে? মানুষের চাপা ক্রন্দন আপনি উপলব্ধি করবেন না? না করলে সোনার বাংলাদেশ আপনি কার জন্য গড়বেন, কীভাবে গড়বেন? এত এত দুর্নীতির খবর সামনে আসার পরও আপনি কেন নিজ দলের রাজনৈতিককর্মী এবং আমলাদের দুর্নীতির বিরুদ্ধে একটি কঠোর বক্তব্য দিলেন না? কোনো দুর্নীতিবাজকে ছুড়ে ফেলে দিতে আপনার অসুবিধা কোথায়? বলবেন, কতজনকে ছুড়ে ফেলবো? এটা সত্য যে, কম্বলের পশম বাছতে গেলে কম্বল থাকবে না, কিন্তু কিছু দৃষ্টান্ত তো জনগণের সামনে আপনি উপস্থাপন করবেন, নাকি? তা না করে পিএসসি-এর প্রশ্ন ফাঁস প্রশ্নে আপনি বললেন, সাংবাদিকেরা খুঁজে বের করুক আমি ব্যবস্থা নেব। সাংবাদিকেরাই যদি সব খুঁজে বের করবে, তাহলে রাষ্ট্রযন্ত্রের কাজ কী?
রাষ্ট্রীয় স্বার্থ আছে, সরকার সংশ্লিষ্ট আছে —এমন কোন রায়টা বাংলাদেশে নির্বাহী বিভাগের বাইরে গিয়ে বিচার বিভাগ দিতে পারে? তাহলে দেশে যখন দুর্নীতির প্রশ্নটি খুব বড়সড়ভাবে সামনে এসেছে, তখন কেন কোটার পক্ষে হাইকোর্টের এমন একটি রায় দিতে হলো? নির্বাহী বিভাগ চাইলে কি এটি থামিয়ে রাখতে পারতো না? বা এটি বিশ্বাস করার কি কারণ আছে যে, নির্বাহী বিভাগের হস্তক্ষেপের বাইরে গিয়ে এই রায়টি হয়েছিলো?
১৬ জুলাই (২০২৪) প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির সরকারি চাকরিতে কোটা পদ্ধতি বাতিলের পরিপত্র অবৈধ ঘোষণা করে হাইকোর্টের দেওয়া রায়ের বিরুদ্ধে লিভ টু আপিল (আপিলের অনুমতি চেয়ে আবেদন) দায়ের করেছে রাষ্ট্রপক্ষ। লিভ টু আপিলে হাইকোর্টের রায় বাতিল চাওয়া হয়েছে। হাইকোর্ট রায় দেয় ৫ জুন, ‘লিভ টু আপিল’ কেন ১৬ জুলাই হলো? একটি অজুহাত হচ্ছে হাইকোর্টের পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশিত হয় ১৪ জুলাই। তবে এ অজুহাত যথেষ্ট নয়, ‘লিভ-টু-আপিল’-এর জন্য পূর্ণাঙ্গ রায় অপরিহার্য নয়। সরকার কি তাহলে আন্দোলনের গতিপ্রকৃতির দিকে তাকিয়ে ছিলো? সরকার কি তাহলে শিক্ষার্থী এবং কোর্টের ঘাড়ে বন্দুক রেখে কোটা সংস্কার চেয়েছিলো? সরকার কি তাহলে এই মুহূর্তে নিয়ন্ত্রিত একটি আন্দোলন চেয়েছিলো? খুব জানতে ইচ্ছে করে— যদি সত্য হয়ে থাকে, তাহলে আত্মাঘাতী এই বুদ্ধিটা সরকারকে কে বা কারা দিয়েছিলো?
নির্বাহী বিভাগের যেকোনো আদেশ বা প্রজ্ঞাপনের বিরুদ্ধে কোর্ট রায় দিতে পারে, সেটি অনেকক্ষেত্রেই প্রয়োজনীয়, কিন্তু বাংলাদেশে বিরল। সেক্ষেত্রে বর্তমান বাস্তবতায় কোটা রক্ষার পক্ষ নিয়ে হাইকোর্ট যে রায়টি দিয়েছিলো, সেটি ছিলো একেবারেই সময় অনুপযোগী এবং অনভিপ্রেত। যে কেউ এর মধ্যে সরকারের ষড়যন্ত্র ছিলো বলে গন্ধ খুঁজতেই পারে। তবে ভয়নক হয়েছে— কোটাবিরোধী আন্দোলনে সরকার যতটুকু চাল চালতে চেয়েছিলো, তার চেয়ে অনেক বেশি চাল চেলে দিয়েছে বিএনপি-জামায়াত। তাই বলে কি এটি বিএনপি-জামায়াতের আন্দোলন? মোটেও তা নয়। সেটি হলে এই মৃত্যু নিয়ে এত কথা উঠতো না, যদিও কোনো মৃত্যুই কোনো অবস্থাতে কাম্য নয়। এটি আসলে সাধারণ শিক্ষার্থীদের আন্দোলন, পরবর্তীতে ধাপে ধাপে গণমানুষের আন্দোলন। কীভাবে এটি হলো? আসলে সরকারের নিয়ন্ত্রিত আন্দোলন (যদি সত্য হয়) দেখতে চাওয়ার অভিপ্রায় থেকেই এটি হলো।
জনগণ ফুঁসে ছিলো, বিভিন্ন কারণে। কেন সেটি আপনারা বুঝতে পারেননি? পুলিশের সাবেক আইজিপি বেনজির আহমেদ সব সময় বড় বড় কথা বলেছেন, মানুষকে নৈতিকতার বয়ান শুনিয়েছেন। তার মধ্য থেকে কী বেরিয়েছে অবশেষে? পিএসসি-এর প্রশ্নফাঁস কোনো সাধারণ বিষয়? সরকারি অফিসে পদে পদে দুর্নীতি এবং হেনস্থার বিষয়টি অস্বীকার করার কোনো সুযোগ আছে? বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে, হলে হলে, শহরে গ্রামে, পাড়ায় মহল্লায় রাজনীতির নামে পাণ্ডাদের উৎপাত কি অসহনীয় নয়? টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি কি অসত্য? খাদ্যদ্রব্যমূল্য আসলেই কি আকাশছোঁয়া নয়? আশি টাকায় কাকরোল কিনে খেতে মানুষের অসুবিধা নেই, যদি টাকাটা কৃষকের পকেটে যায়। কিন্তু দাম তো বাড়ছে পথে পথে, দাম তো বাড়ছে বাজারে এসে। কয়গুণ বাড়ছে? কেন বাড়ছে? ‘কারণ’ খুঁজে বের করা কি খুব কঠিন? খুলনার ট্রাকস্টান্ডে পাইকাড়িতে বিক্রি হওয়া ১২ টাকা কেজির মিষ্টি কুমড়ো দুই কিলোমিটার দূরে সন্ধ্যাবাজারে এসে বিক্রি হয় ৪০ টাকায়! এটা কি স্বাভাবিক? কৃষক পেয়েছে কত, আর খুচরা ক্রেতা কিনছে কত দিয়ে। সকল হাট-বাজার, রাস্তা-ঘাট, স্থাপনা পাণ্ডাদের দখলে! এটা কি একটা দেশের জন্য স্বাভাবিক অবস্থা? সবকিছু মিলিয়েই তো জনগণ ফুঁসে উঠেছে, কোটা আন্দোলন তো একটি উপলক্ষ্য মাত্র।
তবে আন্দোলনকারীদের ব্যর্থতা হচ্ছে— একটি আন্দালনকে জাতীয় রূপ দিতে হলে সেখানে জাতীয় স্বার্থ রক্ষার কথা থাকতে হয়, সে ধরনের ইস্যুগুলোকে তারা সামনে আনতে পারেনি। তারা সুযোগসন্ধানী রাজনৈতিক দল এবং জঙ্গিদের দূরে রাখতে পারেনি। সেসব ব্যর্থতা মেনে নিয়েও বলতে হবে— সরকার এবং সরকারি বাহিনী যেভাবে আন্দোলন দমন করতে চেয়েছে সেটি ভুল, এবং অপরাধ। এর বিপরীতে কী হতে পারতো সেটিও সহজেই অনুমেয়— আন্দোলনকারীরা গণভবন, বঙ্গভবন সহ সবখানে ঢুকে পড়তো এবং হত্যাকাণ্ড চালাতো, দেশ পুরোপুরি একটি অরাজগ অবস্থার মধ্যে চলে যেত। গণহত্যার উত্তরসুরীরা এখনো ওৎ পেতে আছে সেরকম একটি অবস্থার জন্য। সে ধরনের একটি পরিস্থিতি প্রায় তারা সৃষ্টি করে ফেলেছিলো। ফলে সরকারের সামনে বিকল্প আসলে কী ছিলো, সেটি বলাটাও খুব কঠিন।
কিন্তু যেখান থেকে ভুলের শুরু সেটি তো উল্লখ করতেই হবে। ভুলের শুরুটা কোর্টের রায় থেকেই। আরেকটু এগিয়ে যদি আসি, তাহলে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য থেকে। প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য বিকৃত করা হয়েছে, এটা সত্য, কিন্তু এটাও সত্য যে, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শিক্ষার্থীদের প্রতি যথাযথ সম্মান রেখে বক্তব্যটি দিতে ব্যর্থতা হয়েছেন। তিনি কূটনৈতিক না হয়ে তার প্রচলিত ঢং-এ আবেগতাড়িত হয়ে দেশটাকে একটা পরিবার ভেবে বক্তব্য দিয়েছেন। কিন্তু একটি দেশ তো আসলে একটি পরিবার নয়, এটি বরং নানান মত পথের মানুষের একটি চড়াই-উতরাই। বাংলাদেশের ঐকিহাসিক বাস্তবতায় সেটি আরো অনেক বেশি বন্দুর। এরকম একটি বাস্তবতায় ওপর দাঁড়িয়ে রাষ্ট্র পরিচালনতার মূলনীতি হওয়া দরকার ছিলো সততা, নিষ্ঠা এবং আইনের শাসন; শুধু কঠোরতা এবং কৌশল নয়। আমরা দেখতে পাই— আওয়ামী লীগ সরকার দেশ পরিচালনার ক্ষেত্রে কঠোরতা এবং কৌশলের (অনেকক্ষেত্রে অপকৌশল) নীতিতেই বেশি আগ্রহ দেখিয়েছে।
একটু পিছন ফিরে তাকানো দরকার। তথ্যগুলো একটু জেনে নেওয়া দরকার। ২০২৪-এর কোটা সংস্কার আন্দোলনটিকে বলা হচ্ছে সকল ধরনের সরকারি চাকরিতে প্রচলিত কোটাভিত্তিক নিয়োগ ব্যবস্থার সংস্কারের দাবিতে সংগঠিত একটি আন্দোলন। ২০২৪ সালের ৫ জুন বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগ কর্তৃক ২০১৮ সালের ৪ অক্টোবর বাংলাদেশ সরকারের জারি করা পরিপত্রকে অবৈধ ঘোষণার পর কোটা পদ্ধতির সংস্কার আন্দোলন আবার নতুনভাবে আলোচনায় আসে। ২০১৮ সালের কোটা সংস্কার আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে উক্ত পরিপত্র জারি করা হয়েছিল। ঐ পরিপত্রের মাধ্যমে সরকারি চাকরিতে নবম গ্রেড (পূর্বতন প্রথম শ্রেণি) এবং ১০ম-১৩তম গ্রেডের (পূর্বতন দ্বিতীয় শ্রেণি) পদে নিয়োগের ক্ষেত্রে বিদ্যমান সকল কোটা বাতিল করা হয়েছিলো।
শুরুতে আন্দোলন সভা-সমাবেশের মধ্যে স্থির থাকলেও ১৪ জুলাই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার এক বক্তব্যে বলেন, “মুক্তিযোদ্ধার নাতিপুতিরা কোটা পাবে না, রাজাকারের নাতিপুতিরা কোটা পাবে?” প্রধানমন্ত্রীর মন্তব্যের প্রতিক্রিয়া হিসেবে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা “তুমি কে? আমি কে? রাজাকার, রাজাকার” স্লোগান দেয়। পরবর্তীতে স্লোগানটিকে পরিবর্তন করে বলা হয়, “তুমি কে? আমি কে? রাজাকার, রাজাকার। কে বলেছে? কে বলেছে? স্বৈরাচার, স্বৈরাচার” এবং “চাইতে গেলাম অধিকার, হয়ে গেলাম রাজাকার” স্লোগান দেওয়া হয়। এর পরেরদিন ১৫ জুলাই আওয়ামী লীগ ও সরকারের বিভিন্ন কর্মকর্তা, মন্ত্রী আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা’ নষ্ট করার অভিযোগ আনেন। একই দিন দেশের বিভিন্ন স্থানে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগের নেতৃত্বে শিক্ষার্থী ও আন্দোলনকারীদের ওপর হামলার অভিযোগ আসে। একই সাথে পুলিশও লাঠি, রাবার বুলেট দিয়ে হামলা করে। প্রতিবাদে আন্দোলনকারীরাও পিকেটিং শুরু করে। পুলিশ এবং আন্দোলকারীদের মধ্যে সংঘর্ষ বাধে। ১৬ জুলাই থেকে আন্দোলন তীব্র থেকে তীব্রতর হয়। ১৬ জুলাই বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে আবু সাইয়িদ পুলিশের গুলিতে নিহত হলে আন্দোলন স্ফুলিঙ্গের মতো পুরো দেশের আনাচে কানাচে ছড়িয়ে পড়ে। উল্লেখ্য, আবু সাইয়িদ একটি লাঠি হাতে নিয়ে রাবেট বুলেট নিক্ষেপরত পুলিশকে মোকাবেলা করছিলেন, এবং অবশেষে বুকে রাবার বুলেটবিদ্ধ হয়ে মৃত্যুবরণ করেন। ঘটনাটির ভিডিও দ্রুতই ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়ে।
এরপরে যা ঘটেছে সেটি নজিরবিহীন। জনগণ এবং পুলিশ মুখোমুখি দাঁড়িয়ে যায়, এবং প্রচুর মানুষ হতাহত হয়। বিটিভি, মেট্রোরেল, সেতুভবন সহ বহু গুরুত্বপূর্ণ সরকারি স্থাপনা পুড়িয়ে দেওয়া হয়, এবং ভাঙচুর করা হয়। জঙ্গিরা নরসিংদি জেলে আগুন লাগিয়ে দেয়, এবং জেল ভেঙ্গে ৮২১ জন বন্দীকে পালিয়ে যাবার সুযোগ করে দেয়, যাদের মধ্যে ১৪ জন জঙ্গিও ছিলো। প্রকৃতপক্ষে ১৬ জুলাই থেকে ১৯ জুলাই পর্যন্ত দেশের, বিশেষ করে ঢাকায় কোথায় কী ঘটেছে তার পুরোটা এখনো অজানা। তবে এখন পর্যন্ত পাওয়া তথ্য মতে দুই শতাধিক মানুষ নিহত হয়েছে, এটা নিশ্চিত। ২০০১ সালের নির্বাচনের পর বিএনপি-জামায়াত কয়েক হাজার লোক হতাহত করলেও আনইশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে স্বাধীন বাংলাদেশে এত বেশি লোক একসঙ্গে নিহত হওয়ার ঘটনা নজিরবিহীন।
বিদ্যমান এ আন্দোলন এবং আন্দোলন দমন করার প্রক্রিয়াটি অনেক ধরনের প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। আন্দোলনকারীরা কী চেয়েছে এবং সরকারইবা কী চেয়েছে? আন্দোলনকারীরা শুধু কোটা সংস্কারের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকেনি, কিন্তু সেটি তারা আন্দোলনের দাবী দাওয়ার মধ্যে আনতেও পারেনি। বিপরীতে সরকার যেকোনো মূল্যে ক্ষমতায় থাকতে চেয়েছে। এভাবে কি শেষ রক্ষা হবে? সরকার ক্ষমতায় থাকতে পারবে? নাকি একটি অন্তবর্তীকালীন সরকারের প্রয়োজন পড়বে? শান্তি বজায় রেখে সেটি কি সম্ভব?
আমরা ধরে নিতে পারি— জনগণের চাওয়া এখন সরকার পতন। শেখ হাসিনার সরকারের পতন হলে দেশে যে একটি দাঙ্গা বাধবে সেটি সহেজেই অনুমেয়। যে যার মতো করে প্রতিশোধ নেবে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার এবং ২০১৩ সালে সংগঠিত গণজাগরণ মঞ্চের বিষয়টি সামনে চলে আসবে। এরকম আরো অনেক বিষয় রয়েছে। যেটা মনে হয়— এমনকি কোনো সেনা সরকারও সেটি ঠেকাতে পারবে না। আমরা কি দেশে তেমনই একটি অরাজগ পরিস্থিতি দেখার অপেক্ষায় আছি, নাকি সম্ভাব্য শান্তিপূর্ণভাবে সরকার পরিবর্তন হবে, অথবা বর্তমান সরকার সবকিছু সামাল দিতে সমর্থ হবে? কী দেখতে যাচ্ছি আমরা? কী দেখতে চাচ্ছি আমরা? কোটাবিরোধী আন্দোলনের মতো একটি শ্রেণিস্বার্থসংশ্লিষ্ট আন্দোলনে এত মৃত্যু কীভাবে সহনীয় হবে, এত মৃত্যুর দায় কে নেবে?