বিশিষ্ট লেখক ও শিক্ষাবিদ অধ্যাপক মুহম্মদ জাফর ইকবাল বলেছেন, হেফাজতের কথায় পাঠ্যবইয়ে পরিবর্তন আনা ঠিক হয়নি। এতে আমি খুব কষ্ট পেয়েছি। সকলকে এর প্রতিবাদ করারও আহ্বান জানান তিনি।
বৃহস্পতিবার (৫ জানুয়ারি) বিকেলে সিলেট নগরীতে শিক্ষার্থীদের নিয়ে একটি অনুষ্ঠান শেষে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে জাফর ইকবাল এসব কথা বলেন।
গত বছরের ৮ এপ্রিল সন্ধ্যায় হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ-এর কেন্দ্রিয় নেতাদের এক যৌথ বিবৃতি গণমাধ্যমে পাঠানো হয়। ওই বিবৃতিতে পাঠ্যপুস্তকের বাংলা বই থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে বলে ১৭টি গল্প, কবিতা ও প্রবন্ধের তালিকা প্রকাশ করা হয়। যার সবই ২০১৭ সালের বইয়ে ফিরিয়ে আনা হয়েছে। একইভাবে যে ১২টি গল্প, কবিতা ও প্রবন্ধ-নিবন্ধকে নাস্তিক্যবাদী ও হিন্দুত্ববাদী হিসেবে অভিযুক্ত করা হয়, তার সব কটিই বাদ দেওয়া হয়েছে।
বৃহস্পতিবার বিকেলে নগরীর পুলিশ লাইন উচ্চ বিদ্যালয়ে ‘শিক্ষাঙ্গনে শান্তি ও মূল্যবোধ : আমাদের করণীয়’ শীর্ষক বেসরকারি উন্নয়ন সহযোগী সংস্থা আইডিয়া ও গণস্বাক্ষরতা অভিযান আয়োজিত মতবিনিময় সভায় অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন জাফর ইকবাল।
অনুষ্ঠান শেষে পাঠ্য পুস্তকে পরিবর্তন সম্পর্কে দৃষ্টি আকর্ষন করা হলে অধ্যাপক মুহম্মদ জাফর ইকবাল বলেন, “আমি এখনো বইগুলো দেখিনি। কিন্তু এক ধরণের অভিযোগ উঠেছে। এই বিষয়টি বিবেচনার সময় এসেছে। হেফাজত কিংবা তারা এক ধরণের অভিযোগ করেছিলো, সেই অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে আমাদের বইয়ের যে সমস্ত বিষয় পরিবর্তন করা হয়েছে, যদি সেটা হয়ে থাকে তবে তা একেবারেই ঠিক হয়নি।”
জাফর ইকবাল বলেন, “আমাদের মূল্যবোধের ভেতরে আসলে হেফাজত কিংবা ইসলাম কিংবা হিন্দু এই ধরণের বিষয় থাকার কথা না। আমরা একটি নির্দিষ্ট বয়সের ছেলেমেয়েদের যে জিনিসটা শেখাতে চাই, সেই জিনিসটা আমরা সঠিকভাবে শেখাতে পারছি কি না- সেটাই মূল আলোচ্য বিষয়।”
“আমি বইগুলো এখনো দেখিনি। কিন্তু যদি এই ধরণের পরিবর্তন হয়ে থাকে, তাহলে বলতে হবে আমি মনে খুব কষ্ট পেয়েছি।’- বলেন জাফর ইকবাল।
সকল সচেতন মানুষকে এই পরিবর্তনের প্রতিবাদ করা উচিত জানিয়ে এই শিক্ষাবিদ বলেন, শিক্ষার্থীদের অসাম্প্রদায়িক শিক্ষায় শিক্ষিত করে গড়ে তুলতে হবে। এই ক্যারিকুলাম ঠিক করতে হবে। এ ব্যাপারে শিক্ষাবিদদের মতামত নেওয়া প্রয়োজন বলে মনে করেন তিনি।
গত ১ জানুয়ারি দেশের প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষার্থীদের হাতে বিনামূল্যে বই তুলে দেয় সরকার। এনসিসিসি এসব বইয়ের নানা ভুল অসঙ্গতি নিয়ে কয়েকদিন ধরেই চলছে ব্যাপক আলোচনা।
এ ব্যাপারে জাফর ইকবাল বলেন, পাঠ্যবইয়ে অনেক ভুল রয়েছে বলে শুনেছি, যা মোটেই কাম্য নয়। এমন ভুল থাকা প্রমাণ করে, যারা বইগুলো ছাপার সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন তারা মোটেই আন্তরিক নন। তারা বিন্দুমাত্র গুরুত্ব দেন না। তারা আন্তরিক হলে ভুল থাকতো না। ভুল থাকা মোটেই উচিত নয়।
তিনি বলেন, এই বিষয়টি নিয়ে হৈ-চৈ হলে হয়তো তদন্ত কমিটি হবে। কিন্তু পরে সবাই ভুলে যাবে। কিছুই হবে না। এই বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে দেখা উচিত জানিয়ে তিনি বলেন, এর সাথে জড়িতদের শাস্তির আওতায় আনতে হবে। কারণ শিশুদের যখন বিনামূল্যে বই দেওয়া হয়, তখন তারা আনন্দের সঙ্গে সেগুলো গ্রহণ করে। কিন্তু যখন বইয়ে অনেক ভুল দেখতে পায়, তখন শিশুরা খুব কষ্ট পায়। তাদের মন ভেঙ্গে যায়।
জাফর ইকবাল বলেন, এই ভুলগুলো দ্রুত ঠিক করতে হবে। শিশুদের ভুল শিখানো যাবে না। এবং আগামীতে যাতে এ ধরণের ভুল কখনোই, কখনোই না হয় এ ব্যাপারে সর্বোচ্চ সতর্ক থাকতে হবে।
গণস্বাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক রাশেদা কে চৌধুরীর সঞ্চালনায় এ অনুষ্ঠানে অতিথিরা শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দেন। এতে নগরীর বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শতাধিক শিক্ষার্থী অংশ নেয়।
জানা যায়, ২০১৭ শিক্ষাবর্ষের প্রাথমিক স্তরের দ্বিতীয় থেকে পঞ্চম শ্রেণির পাঠ্যপুস্তকের ‘আমার বাংলা বই’য়ে পরিমার্জন করা হয়েছে। দ্বিতীয় শ্রেণির বাংলা বইয়ে ‘সবাই মিলে করি কাজ’, তৃতীয় শ্রেণির বাংলা বইয়ে ‘খলিফা হযরত আবু বকর (রা.)’, চতুর্থ শ্রেণির বাংলা বইয়ে ‘খলিফা হযরত ওমর (রা.), পঞ্চম শ্রেণির বাংলা বইয়ে ‘বিদায় হজ’ ও ‘শহিদ তিতুমীর’ অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এ ছাড়া পঞ্চম শ্রেণির বাংলা বইয়ে কবি গোলাম মোস্তফা রচিত ‘প্রার্থনা’ কবিতার পরিবর্তে কবি কাদের নওয়াজ রচিত ‘শিক্ষাগুরুর মর্যাদা’ কবিতাটি অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। বাদ দেওয়া হয়েছে হুমায়ুন আজাদ রচিত ‘বই’ কবিতা।
ষষ্ঠ শ্রেণির বাংলা পাঠ্যপুস্তক চারুপাঠ থেকে এস ওয়াজেদ আলীর ‘রাঁচি ভ্রমণ’ বাদ পড়েছে। যুক্ত হয়েছে সৈয়দ মুজতবা আলীর ‘নীল নদ আর পিরামিডের দেশ’। সানাউল হকের কবিতা ‘সভা’ বাদ পড়েছে, যুক্ত হয়েছে জসীমউদ্দীনের ‘আসমানী’। আনন্দপাঠ থেকে বাদ পড়েছে সত্যেন সেনের গল্প ‘লাল গরুটা’, যুক্ত হয়েছে মুহম্মদ শহীদুল্লাহ’র ‘সততার পুরস্কার’। ন্যাশনাল কারিকুলাম কো-অর্ডিনেশন কমিটি (এনসিসিসি) সভার সিদ্ধান্তে ভ্রমণ কাহিনী ও গল্পের পরিবর্তন হয়েছে বলে জানা গেছে। তবে কবিতার পরিবর্তন হয়েছে ট্রাই-আউট রিপোর্ট ও বিশেষজ্ঞ কমিটির সুপারিশের ভিত্তিতে।
সপ্তম শ্রেণির বাংলা বই সপ্তবর্ণার গদ্যে হাবীবুল্লাহ বাহারের ‘মরু ভাস্কর’ যুক্ত হয়েছে এবং দ্রুতপঠন আনন্দপাঠ বই থেকে শরত্চন্দ্রের ‘লালু’ বাদ পড়েছে এনসিসিসি সভার সিদ্ধান্তে।
অষ্টম শ্রেণির বাংলা সাহিত্য কণিকা থেকে কাজী নজরুল ইসলামের একটি গদ্য বাদ নিয়ে নতুন একটি যুক্ত হয়েছে ট্রাই-আউট রিপোর্ট ও বিশেষজ্ঞ কমিটির সুপারিশে। ট্রাই-আউট রিপোর্টের ভিত্তিতে তিনটি পদ্য বাদ পড়েছে। তার জায়গায় একটি পদ্য যুক্ত করা হয়েছে বিশেষজ্ঞ কমিটির রিপোর্টের ভিত্তিতে, কিন্তু দুটি পদ্য কায়কোবাদের ‘প্রার্থনা’ ও কালিদাশ রায়ের ‘বাবুরের মহত্ত্ব’ যুক্ত করা হয়েছে ২০১৬ সালের ২০ আগস্ট অনুষ্ঠিত এনসিসিসি সভার সিদ্ধান্তে। বাংলা দ্রুতপঠন আনন্দপাঠ থেকে উপেন্দ্রকিশোর রায় চৌধুরীর ‘রামায়ণ-কাহিনী’ (আদিকাণ্ড) বাদ পড়েছে।
নবম শ্রেণির বাংলা বই মাধ্যমিক বাংলা সাহিত্য থেকে একটি গদ্য ও পাঁচটি কবিতা বাদ পড়েছে এবং পাঁচটি কবিতা যুক্ত হয়েছে এনসিসিসি সভার সিদ্ধান্তে। বাদ পড়া ভ্রমণ কাহিনীটি হচ্ছে সজীবচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ‘পালামৌ’ এবং কবিতা হচ্ছে জ্ঞানদাসের ‘সুখের লাগিয়া’, ভারতচন্দ্রের ‘আমার সন্তান’, লালন শাহর ‘সময় গেলে সাধন হবে না’, রঙ্গলাল বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘স্বাধীনতা’ ও সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘সাঁকোটা দুলছে’। যুক্ত হয়েছে শাহ মোহাম্মদ সগীরের ‘বন্দনা’, আলাওলের ‘হামদ’, আব্দুল হাকিমের ‘বঙ্গবাণী’, গোলাম মোস্তফার ‘জীবন বিনিময়’ ও কাজী নজরুল ইসলামের ‘উমর-ফারুক’।
নবম শ্রেণির বইয়ে মোতাহার হোসেন চৌধুরীর প্রবন্ধ ‘লাইব্রেরি’ ও সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের ‘মে দিবসের কবিতা’ যুক্ত হয়েছে বিশেষজ্ঞ কমিটির সুপারিশে। এই দুটি লেখা আগে সপ্তম শ্রেণির বইয়ে ছিল। এ ছাড়া রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহর ‘খতিয়ান’ কবিতার পরিবর্তে ‘মিছিল’ যুক্ত হয়েছে।
সূত্র : অনলাইন