১৪০০ বছর আগের গ্রন্থ নিয়ে আপত্তি থাকলে, একই কারণে কম আপত্তি থাকলেও ২০০ বছর আগের গ্রন্থ নিয়েও আপত্তি থাকার কথা

foggy

কোনো নির্দিষ্ট ব্যবসায়ীর তো একটা ব্যবসা। কিন্তু এইসব রাজনীতিক, আমলা, পুলিশের অনেক ব্যবসা। সবখানেই তারা ভাগ বসায়। শুধু ঢাকার ফুটপথের অর্থনীতি নিয়েই কেউ গবেষণা করে দেখেন না।

দূরে যাওয়ার দরকার নেই, ছোট ছোট ‘নীচ’ ধরে গণমাধ্যম আপনারা প্রতিবেদন প্রকাশ করেন। সদরঘাটের ফলের ব্যবসা নিয়ে এক মাস অনুসন্ধান চালালে কেউটে কুমির সব বেরিয়ে আসবে, কিন্তু প্রভাবশালী মিডিয়া থাকলেও সত্যানুসন্ধানী সেরকম কোনো মিডিয়া আমাদের দেশে নেই!

কত আওয়াজ হয় যে গাইড ব্যবসা বন্ধ হয়ে যাবে, আসলে হবে না। এটা কি আসলে বন্ধ করার জন্য এত আওয়াজ? নতুন করে এ ব্যবসায় আর কেউ ঢুকবে না এ আওয়াজের কারণে, যারা আছে তারা কয়েকেজনে সিন্ডিকেট করে ব্যবসা চালায়।

লাভের ভাগ পায় কেন্দ্রীয় এবং স্থানীয় প্রশাসন এবং রাজনীতিক সবাই। ফাঁকে শুধু শুধু বইয়ের দামটা বাড়ে। গ্রামের কৃষকের সন্তানটা ফাইভের “একের ভেতরে পাঁচ বা দশ” নামক বইটা এই আওয়াজ না থাকলে কিনতে পারত হয়ত তিনশো টাকায়, সেটি এখন তাদের কিনতে হয় ছয়শো টাকায়।

বইমেলায় অন্তত দুইশো স্টল হয় বলে আন্দাজ করি। প্রতিটি স্টল নিয়ম মেনে প্রতিবছর ২০টি করে নতুন লেখকের বই করলে ২০০০ বই হওয়ার কথা, নিজের টাকায় লেখকদের বই বের করা লাগার কথা না। টাকার দিক দিয়ে অনেক প্রভাবশালী প্রকাশক আছে, কজন লেখক তৈরি করেছেন তারা, নাম বলতে পারবেন?

হূমায়ুন আহমেদও নিজে তৈরি হয়েছে, বই বের করার জন্য সংগ্রাম করেছেন প্রথমে। যদ্দুর জানি ‘অন্যপ্রকাশ’ তারই ব্রেনচাইল্ড। বিশটি নতুন সৃজনশীল বই প্রতিবছর প্রকাশনীগুলো বের করছে কিনা এ ব্যাপারে বাংলা একাডেমির নিরপক্ষে কোনো তদন্ত আছে? দেশে কপিরাইট আইন বলে কিছু নেই, যার যা ইচ্ছে করছে। লেখক যাবে কোথায়? লেখক তৈরি হবে কীভাবে? নর্দমায় ইলিশ ফলবে আশা করেন?

সবখানেই এই অবস্থা, ব্যবসায়ীরা জনগণের ওপর দিয়ে পুশিয়ে নেয়। ভাগ দিয়ে প্রশাসন থেকে নিরাপত্তাটাও পায়, জনরোষের ভয় তাদের পেতে হয় না। রোষ যে দেখাবে সে ছিঁটকে পড়বে, তাকে ‘ব্যর্থ’ দেখিয়ে এমন একটি মেটাফোর সমাজের তৈরি করে দিবে যে কেউ আর রোষ দেখাতে যাবে না, এবং রোষ দেখানোটাই হয়ে যাবে অগ্রহণযোগ্য। মেনে নেওয়ার ট্রেন্ড তৈরি হয়ে যাবে সবখানে, গিয়েছেও তাই।

দেশে এখন জনসাধারণ বলে কিছু নেই, জনসাধারণ কোনো কালেই থাকে না, যদি তাদের মধ্য থেকে কেউ প্রতিনিধিত্ব না করে। ‘তেল-গ্যাসের’ আন্দোলনকে জনগণের প্রতিনিধিত্বকারী আন্দোলন বলে অনেকের ভ্রম হতে পারে, আসলে ওগুলোও শতভাগ জনবিচ্ছিন্ন, জনগণের দৈনন্দিন দুঃখ-কষ্টের কথা ওসব রাজনীতিতেও নেই। তাদের বেশিরভাগ ভাড়াটিয়াও। প্রকৃতপক্ষে যাতে আন্দোলন দানা বাঁধতে না পারে সেজন্য ক’জন ভাড়াটিয়া দিয়ে মাঠ দখল করিয়ে রাখাই তো ভালো।

শতবৎসর পরের সৌকর্যের খোয়াব দেখিয়ে আপনি বর্তমানে ভালো থাকছেন, টকশো করে বেড়াচ্ছেন, এটা তো পরকাল দেখানোর মতোই হলো। জনগণের সমস্যার ধারপাশ দিয়ে না গেলে ওসব বড় বড় কথায় কেউ ভুলবে কেন? বারো থেকে চৌদ্দ ঘণ্টা শ্রম দিয়েও মানুষ বাঁচতে পারছে না, কে শুনবে আপনাদের ওসব তত্ত্ব কথা?

ব্যবসায়ী-রাজনীতিক-আমলা-বুদ্ধিজীবি সিন্ডিকেট ভাঙ্গতে না পারলে কিছুই হবে না। রাষ্ট্রযন্ত্র ঠিক হলে সব ঠিক হয়ে যেত। এক সদরঘাট ঠিক রাখার জন্য একশো পুলিশের একটি টিমই যথেষ্ট, কিন্তু ইচ্ছেটা থাকতে হবে। ভাগ বসাতে আসলে ঠিক হবে কী করে?

শুধু জামাতরে দোষ দিয়ে ভালো কিছুই অর্জিত হবে না। টিভিতে জামাতের চৌদ্দ গুষ্টি উদ্ধার করে জামাতের ঘরে সন্দেশ খাওয়া বুদ্ধিজীবীর খুব অভাব আছে মনে করেন? ‘এন্টিপাওয়ার’ পরিমিতভাবে শো করে সুবিধা নেওয়া তো অনেক পুরনো তত্ত্ব।

মুক্তিযোদ্ধা এবং রাজাকারের মধ্যে যুদ্ধটা বর্তমানে অনেকটা আইসিসি আয়োজিত ক্রিকেট ম্যাচের মতো। দুইদল মাঠে খেলবে, দর্শক নাচবে, কিন্তু এতে লাভ শুধু দুই দলের আয়োজকদের। শফিও (রাজাকারদের প্রতিনিধি, ধরলাম) হেলিকপ্টারে চলে, শফির শত্রুও (মুক্তিযুদ্ধের প্রতিনিধি) হেলিকপ্টারে চলে। গণমানুষ সুয়ারেজের পানিতে হাবুডুবু খাচ্ছে!

ভারত পাকিস্তানের খেলায় ভারত হারলে তাতে ‘ফগি’ বা ‘লেয়ার’ বডিস্প্রে কোম্পানির কোনো লস আছে? খেয়াল করে দেখেছেন, শুধু এরকম প্রতিদ্বন্দীতাপূর্ণ আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলা দিয়ে এ পর্যন্ত কতগুলো ব্রান্ড দাঁড়িয়েছে?

এই খেলাগুলোর হারজিত নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ আছে। নিশ্চয়ই আন্তর্জাতিক পুঁজিবাজার চায় বাংলাদেশও ভালো ক্রিকেট খেলুক, ভারতও চাইবে বাংলাদেশ ভালো ক্রিকেট খেলুক এবং জিতুক, তাহলে তারা আপনাকে আমাকে টিভির সামনে বসাতে পারবে। ফগি না কিনে পারবেন একদিন?

চারশো টাকা দিয়ে একটি ফগি কিনলে যদি কোম্পানির দুইশো টাকা লাভ হয়, তাহলে এক কোটি ফগি এক মাসে সারা পৃথিবীতে বিক্রি করতে পারলে লাভ হয় কত? পৃথিবীতে ফগি, লেয়ার বডি স্প্রে বা এরকম পণ্যগুলো না থাকলে কোনো সমস্যা আছে?

এগুলো পন্যজট তৈরি করছে, ট্রনজ্যাকশন অন্যদিকে চলে যাচ্ছে। এইসব ব্যবসার প্রয়োজনেই মিডিয়াতে দু’একজন নেইমার মেসি তৈরি হচ্ছে। নেইমারের প্রতিদিনের বেতন দৈনিক ৮২ লক্ষ টাকা। নেইমার আসলে কে? দিনেশেষে সে শুধু ভালো খেলেয়াড় নয়, পুঁজিপতিদের শোকেজও বটে।

পুঁজিপতিরা সংখ্যা বাড়াতে চায় না, সংখ্যা বাড়ালেই ধীরে ধীরে সাম্যবাদের কথা এসে পড়ে, বৈষম্যহীনতার কথা এসে পড়ে। পৃথিবীতে ভালো খেলোয়াড় শুধু নেইমার আর মেসি নয়, সমমানের খেলোয়াড় আরো অনেক থাকার কথা, কিন্তু মিডিয়াতে এই দু’জনেরই শুধু নাম দেখবেন, প্রতি দশকে দু’একজন তারা সামনে আনে, এটাই ট্রেন্ড, সবক্ষেত্রেই এরকম।

সেরা সাহিত্যিক হতে হলে আপনাকে পৃথিবীতে প্রথম পাঁচজনের মধ্যে থাকতে হবে, এটা শুধু ভালো লেখার বিষয় নয়, সুযোগ পাওয়ার বিষয়, মিডিয়ার নজরে পড়ার বিষয়, আপনাকে ঘিরে হুজুগ শুরু হওয়ার বিষয়।

১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে লক্ষ লক্ষ লোক গণহত্যার শিকার হয়েছে, আমাদের বুদ্ধিজীবীরাও গণহত্যারাই শিকার। বেশিরভাগ বুদ্ধিজীবী সন্মুখযুদ্ধ করতে গিয়ে মারা যাননি, সেটির দরকারও নেই, কারণ তারা পিছন থেকেই অনেক কিছু করেছেন।

আমি ফ্যাক্ট বলছি। তাদের সবার অবদান একবাক্যে অনস্বীকার্য, এখনও তাঁদের প্রতি পর্যাপ্ত সম্মান দেখানো সম্ভব হয়নি বলে মনে করি, তাঁদের পরিবারগুলোও মানসিক এবং আর্থিক ক্ষতি পুশিয়ে উঠতে পারেননি কখনো, কারণ, এ ক্ষতি পূরণ হবার নয়।

কিন্তু বাকীদের কী হবে? অনেক পরিবার আছে যে পরিবারের সকল পুরুষ সদস্যদের মেরে ফেলা হয়েছিলো। সেইসব লক্ষ লক্ষ লোক যারা ’৭১ সালে গণহত্যার শিকার হয়েছিল তাদের নাম পরিচয় কি রাষ্ট্র জানে? কোনো ক্ষতিপূরণ বা স্বীকৃতির তো প্রশ্নই ওঠে না, কারণ, রাষ্ট্র জানেই না। এখানেও সেই একই তত্ত্ব, কয়েকজনকে নিয়ে মাতামাতি, এভাবে জনগণের কাছে প্রমাণ করতে চাওয়া যে দেখ আমরা করলাম সবই।

৫ লক্ষ লোককে ১০ হাজার টাকা করে দেওয়া অনেক কঠিন, কিন্তু ৫ জন লোককে ৫ লক্ষ টাকা করে দিয়ে মিডিয়ায় প্রচার করলে প্রমাণিত হয়, দেখ আমরা ৫ লক্ষ টাকা করে তাঁদের দিলাম। এটাই পুঁজিবাদী ট্রেন্ড।

তথাকথিত সমাজতন্ত্র এ ট্রেন্ড ভাঙতে পারবে বলে মনে হয় না, সেখানেও গলদ আছে। ১৪০০ বছর আগের গ্রন্থ নিয়ে আপত্তি থাকলে, একই কারণে কম আপত্তি থাকলেও ২০০ বছর আগের গ্রন্থ নিয়েও আপত্তি থাকার কথা যেহেতু সেটিও কোনো প্রমাণিত বিজ্ঞান গ্রন্থ নয়।

রিফর্ম দরকার। একটা সৃষ্টিশীল ভাঙ্গাগড়া দরকার সবখানে। এক জীবনেও অনেক কিছু করা সম্ভব বলে মনে করি, ঘটে পয়শা জমানোর মতো চিন্তা, সংগ্রাম ও কাজ জমাতে থাকলে বিশবছর পরে বিস্ফোরণ সম্ভব, কিন্তু সেরকম কোনো পরিকল্পনা বিচ্ছিন্নভাবে যাদের আছে তাদেরকে একত্রিত করার মত প্রতিষ্ঠিত কেউ কি রাষ্ট্রযন্ত্রের মধ্যে বা বাইরে আছে?

তবে আশার কথা হচ্ছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এক্ষেত্রে একটি বড় ভূমিকা রাখবে সম্ভবত। এবং আপনাআপনিই এরা একত্রিত হয়ে যাবে।


সম্পাদকের কলাম