অন্ধ বিশ্বাস তাদের কিছুই দেয়নি, কিন্তু বাঁচিয়ে দিয়েছে বর্বরদের

মালাকারটোলা গণহত্যা লোহার পুল

এক একটি পরিবারকে পুরোপরি শেষ করে দেওয়া হয়েছে। পরিবার সকল পুরুষ মানুষকে হত্যা করা হয়েছে। কোনো নারী তো সহজে বলবে না যে, সে ধর্ষিত হয়েছিল, তাই সে কথা উল্লেখ করার সুযোগ নেই।

পরিবারগুলো কখনই আর মাথা তুলে দাঁড়াতে পারেনি, শোকে কাতর হয়ে, অসহায় হয়ে দুর্বিসহ জীবন-যাপন করছে, তা করছে তারা গত ৪৯ বছর ধরে। খোঁজ নেয়নি, সরকার থেকে কোনো সাহায্য তারা পায়নি, উপরন্তু তাদের সামান্য মাথা গোজার ঠাঁই সুযোগ বুঝে দখল করে নিয়েছে অনেকে।

মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে গলাবাজি হয়, কিন্তু আসল কাজ হয় না। কিছুই ইতিহাসে সংরক্ষিত হয়নি, মোটা দাগে গৌরবের কিছু বিষয় ছাড়া। মুক্তিযুদ্ধ মানে শুধু বিজয়গাঁথা নয়— রয়েছে বিস্তৃত এক মর্মস্তুদ ইতিহাস, যা নিয়ে খুব কমই কাজ হয়েছে।

মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম শোকগাঁথা হচ্ছে— গণহত্যা, যেটি ইতিহাসের পাতায় সঠিকভাবে লিপিবদ্ধ নেই। এই ঢাকা শহরে অসংখ্যা বদ্ধভূমি এখনো চিহ্নিত হয়নি। অনেক মৃত্যু, হত্যাকাণ্ড এখনো নামহীন!

গণহত্যা নিয়ে কাজ করতে গিয়ে অবাক হলাম! তাদের সামনে দাঁড়িয়ে কথা বলতে রীতিমত লজ্জা পাই। কোনো সরকার কিছু করেনি, আওয়ামী লীগও না। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের মধ্য দিয়ে কিছুই আসলে শেষ হয় না। অনেক অপরাধ অপ্রমাণীত, জানা যাবে না কোনোদিন, তাই বলে সেগুলো অস্বীকার করার তো কোনো সুযোগ নেই।

মুক্তিযুদ্ধের রাষ্ট্র গঠন সুদূর পরাহত, থাকুক তা আরো দূরে, আগে রক্তের ঋণ শোধ করতে হবে। কতভাবে যে তখন হত্যা করা হয়েছে! নারী নির্যাতন করা হয়েছে, লুটপাট করা হয়েছে— সঠিক  ইতিহাস জানলে আপনি অবাক হবেন, মানুষ হলে দুঃখ পাবার কথা।

ভুক্তভোগীদের ইন্টারভিউ নিতে গিয়ে অনেক সময় আমি খেই হারিয়ে ফেলছি, এতটা দুঃখ এবং অপমান বোধ করছি যে কথা বলতেই ইচ্ছে করেনি।

গীরিবালা সাহা, বয়স ৯০ বছর। ’৭১ সালে পাক বাহিনী তাদের এ দেশীয় বর্বরতম দোসরদের সহযোগিতায় ডেকে নিয়ে হত্যা করে তার দুই ভাই এবং স্বামীকে। তার স্বামী শশুর বাড়িতেই থাকতেন। ইলেকট্রিক মিস্ত্রির কাজ করতেন। তিন ভাইকে এবং তার স্বামীকে ধরে নিয়ে গিয়েছিল পাক বাহিনী কিছু জিজ্ঞেস করে ছেড়ে দেয়ার কথা বলে। আর ফিরে আসেননি তারা, পরের দিন সকালে তাদের লাশ পাওয়া যায় সংলগ্ন লোহার পুলের নিচে।

লাশ তারা সৎকার করতে পারেনি, কারণ, তার আগেই তাদের পালাতে হয়েছে। ছেলে-মেয়ে নিয়ে গ্রামে গ্রামে ঘুরে খেয়ে না খেয়ে বেঁচে থাকতে হয়েছে গীরিবালাদের। ভাগ্যক্রমে তার এক ভাই মারাত্মক আহত হয়ে বেঁচে যান সেদিন, পরে তার কাছ থেকে সবাই সবকিছু জানতে পারে। দীর্ঘ পনেরো বছর যন্ত্রণা ভোগ করে মারা যান তিনি।

এই পরিবারটিকে তো রীতিমত ধ্বংস করে দেওয়া হল। তাই না? এরকম অসংখ্যা পরিবার ধ্বংস হয়েছে, কিন্তু সরকারের কাছে কোনো পরিসংখ্যান নেই! আমি কোথাও তেমন কিছু খুঁজে পেলাম না। গণহত্যার শিকার পরিবারগুলোর কোনো তালিকা নেই।

কোনোদিন তারা (এই পরিবারগুলো) আর মনবল ফিরে পায়নি, কিছুই করতে পারেনি, মাথা তুলে দাঁড়াতে পারেনি, দাঁড়াতে দেওয়া হয়নি। যে বাড়িতে তারা তখন যেভাবে ছিল এখনো সে বাড়িতে সেভাবেই আছে, শুধু বেঁচে ছিল যারা তাদের বয়সে বেড়েছে। পরিবারে কিছু নতুন সদস্য যুক্ত হয়েছে প্রাকৃতিক নিয়মে। অনেকে ভারত চলে গিয়েছে বাধ্য হয়ে। সেখানে গিয়ে পড়েছে জীবন এবং জীবীকার নতুন  এক সংগ্রামে।

গীরিবালার বড় ভাইয়ের আট ছেলেমেয়ে এবং ওনার চার মেয়ে এ বাড়ীতে বড় হয়েছে দুর্বিসহ স্মৃতি সাথে নিয়ে। ছোট ছোট ছেলে মেয়েরা সেদিন দেখেছিল তাদের বাবা কাকা সবাইকে মুহূর্তের মধ্যে মেরে ফেলা হলো! মায়েরা অসহায় হয়ে গেল মাত্র কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানে!

কী আশ্চর্য! মায়েরা তাদের শেখাল— “ভগবানকে ডাকো, সাবধানে লুকিয়ে বাঁচো।” শেখাল না— “তোমরা তৈরি হও, হায়েনাদার রুখে দাও, আর যেন তারা এমন করতে না পারে।” ভুক্তভোগী কয়েকজনের সাথে কথা বলে বুঝতে পারলাম, এখনো অজানা আতঙ্ক তাড়া করে ফিরে তাদের। কারণ, সেদিন যারা বিশ্বাস ভঙ্গ করেছিল, তারা চেনাজানা মানুষই ছিল, কেউ কেউ প্রতিবেশী ছিল। তাদের কিছুই হয়নি, বরং বিস্তর ধনসম্পত্তির মালিক হয়েছে তাদেরই অনেকে।

অদৃষ্টকে, ঈশ্বরকে বিশ্বাস না করলে তারা এভাবে বাঁচত না, সম্ভব ছিল না। প্রতিশোধ নিত, ছারখার করে দিত সব। দেওয়ার চেষ্টা করত, লুটেরাদের ডেরায় ডেরায় হানা দিত। ঈশ্বর বিশ্বাস তাদের কিছুই দেয়নি, কিন্তু বাঁচিয়ে দিয়েছে বর্বরদের, যারা দেশটাকে এখনো দখল করে আছে ভয়ানকভাবে। শুধু দেশ নয়, বর্বরেরা এখন দখল নিয়েছে পৃথিবীর এবং মানব সভ্যতারও। নির্যাতিতদের ওপর ঈশ্বর বিশ্বাসের বোঝা চাপিয়ে দিয়ে শাসন, শোষণ আর হত্যাকাণ্ডের কাজটি তারা করে যাচ্ছে এখনও পৃথিবীজুড়ে খুব সহজে।