স. ম আলাউদ্দীন
এমপি হয়েও অস্ত্র হাতে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেওয়া বঙ্গবন্ধুর এক অকুতোভয় সৈনিক
— শেখ কামরুজ্জামান টুকু
সম্ভবত ১৯৬৪ সালের কথা— পাটকেলঘাটাতে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান এসেছিলেন ব্রিজ উদ্বোধন করতে। ওখানে অনেক লোক সমাগম হয়েছিলো। তখন সাধারণ মানুষ আইয়ুববিরোধী স্লোগান দিয়েছিলো। ওখানে গুলি ছোড়া হয়েছিলো, দু’জন লোক মারা গিয়েছিলো। এই ঘটনায় পাটকেলঘাটা ও সাতক্ষীরায় একটি আন্দোলন সংগঠিত হয়েছিলো। তখন আমরা খুলনা থেকে ভাবলাম— যেহেতু ওখানে আন্দোলন চলছে তাই ছাত্রলীগের কমিটি গঠন করার এটাই উত্তম সময়। সাতক্ষীরা ডাকবাংলোয় আমি একজনের খোঁজ পাই। এরপর আমি ওখানে গিয়ে ডাকবাংলোয় উঠলাম এবং ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠনে তৎপর হলাম। স. ম আলাউদ্দিন ছিলেন সেই ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের অন্যতম নেতা। সংগ্রাম পরিষদের সাথে আমাদের একটা বৈঠক হয়েছিলো সাতক্ষীরা পি. এন হাইস্কুলে। পি. এন হাইস্কুলে তখন গোলপাতার ছাউনি আর টিনের বেড়ার একটি স্কুল। সেই মিটিংয়ের মাধ্যমে স. ম আলাউদ্দীনের সাথে আমার পরিচয় হয়। শুধু স. ম আলাউদ্দীন নয়, কাজী কামাল ছট্টুসহ আরো অনেকে ছিলেন। কাজী কামাল ছট্টুকে আমরা সেদিন ছাত্রলীগের কনভেনর (আহ্বায়ক) করেছিলাম। এছাড়া আরো অনেকেই ছিলেন। সবার নাম স্মরণে আনতে পারছি না।
এরপর ঢাকা থেকে সিরাজুল আলম খান আমাকে বললেন, তুকি কি সাতক্ষীরার এন্তাজ সাহেবকে চেনো? আমি বললাম, না, চিনি না। তিনি বললেন, এন্তাজ সাহেব ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র রাজনীতি করতেন। তিনি এখন সাতক্ষীরায় আছেন। খুব ইফেকটিভ লোক। তুমি তাকে খুঁজে বের করো। আমি এন্তাজ সাহেবের বাড়ি কোথায় জানতে চাইলে তিনি (সিরাজুল আলম খান) বললেন, সাতক্ষীরায়। এর বেশি আর কিছু বলতে পারলেন না।
তখন আমি সাতক্ষীরায় গিয়ে আবার ডাকবাংলোয় উঠলাম এবং খোঁজখবর নিলাম। খুঁজতে খুঁজতে পেয়ে গেলাম। তখন এন্তাজ ভাই দেবহাটায় তাঁর গ্রামে থাকেন এবং বাইসাইকেল চালিয়ে সাতক্ষীরা শহরে আসেন। শহরে এসে আড্ডা দিয়ে সন্ধ্যায় আবার সাইকেল চালিয়ে গ্রামে ফিরে যান। আমি এন্তাজ ভাইয়ের সঙ্গে দেখা করে বললাম, ঢাকা থেকে সিরাজ ভাই আপনাকে খোঁজ করছেন, আপনি তার সঙ্গে দেখা করেন। আন্দোলনের সময় এসেছে। আবার আন্দোলন করতে হবে। এরপর এন্তাজ ভাই ঢাকায় গেলেন এবং সিরাজ ভাইয়ের সঙ্গে দেখা করে আসলেন। এরপর এন্তাজ ভাই আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে আবার জড়িত হলেন। আওয়ামী লীগের সাতক্ষীরা মহকুমা কমিটি যেদিন গঠন করা হয়, সেদিন আমিও উপস্থিত ছিলাম। সেখানে একজন উর্দু শিক্ষককে আহ্বায়ক করে সাতক্ষীরা মহাকুমা কমিটি গঠন করা হয়। উর্দু ভাষার টিচার হলেও তিনি বাংলায় সুন্দর কথা বলতে পারতেন। তার নাম এই মুহূর্তে স্মরণ করতে পারছি না।
এভাবেই বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন কাজের মধ্যদিয়ে স. ম আলাউদ্দিনের সাথে আমার পরিচয় ঘটেছিলো। এরপর বিভিন্ন আন্দোলন সংগ্রামে আমরা একসাথে কাজ করেছি। অনেকবার সম্মেলন হয়েছে, সম্মেলনে আমরা একসাথে কাজ করেছি। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে আমরা ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করেছি। বিশেষ করে তার নমিনেশন পাওয়ার ক্ষেত্রে আমার ভূমিকা ছিলো বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
তৎকালীন খুলনা জেলা আওয়ামী লীগের প্রেসিডেন্ট আজিজ সাহেব (শেখ আব্দুল আজীজ) আমাকে ১৯৭০-এর নির্বাচনে সাতক্ষীরায় প্রার্থী নির্বাচনের দায়িত্ব দেন। দায়িত্ব নিয়ে আমি প্রথমে কলারোয়ায় মমতাজ আহমেদের বাড়ি যাই। উনি তখন হাইস্কুলে শিক্ষকতা করতেন। আমি কলারোয়ায় নেমে অনেক পথ হেঁটে ওনার বাড়িতে গিয়ে দেখি একচালা একখানা টিনের ঘর, তার উপর লাউ গাছ ওঠানো। বেলা তখন তিন-চারটা বাজে। উনি বাড়িতে নেই, স্কুলে ছিলেন।
বাড়ির সবাই বললো, উনি এখনই চলে আসবেন, আপনি বসেন। আসলে বসার মতো জায়গাও ছিলো না। যাইহোক, বসলাম। উনি আসলেন। ওনাকে বললাম, আপনাকে ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলিতে মনোনয়ন দেবে। আপনি খুলনায় আসেন। উনি এদিক-সেদিক তাকিয়ে বললেন, বুড়ো বয়সে আর নির্বাচন করতে ইচ্ছে করে না। আমি বললাম, লোক পাওয়া যাচ্ছে না, আপনাকে নির্বাচন করতে হবে। আপনি খুলনায় আওয়ামী লীগ অফিসে চলে আসেন। উনি বললেন, ঠিক আছে, আমি কাল যাবো। এরপর তিনি আমাকে কিছু খেতে দিলেন। খাওয়া-দাওয়ার পর খুলনায় ফিরে আসলাম।
খুলনায় এসে আবার কপিলমুনি গেলাম। খুলনা থেকে পাইকগাছা হয়ে লঞ্চে কপিলমুনি যেতে তখন ১২ ঘন্টা সময় লাগতো। কপিলমুনিতে লঞ্চ পৌঁছালো রাত বারোটায়। সেই লঞ্চ আবার ছেড়ে আসবে ভোর ছয়টায়। রাত বারোটায় কোথায় যাবো? তাই লঞ্চে শুয়ে থাকলাম। ভোর ছয়টায় লঞ্চ ছাড়ার সময় উঠলাম। ওখান থেকে চলে আসলাম তালার জালালপুরে। জালালপুরে করিম ভাইয়ের বাড়ি গেলাম। করিম ভাই তখন বারান্দায় বসা। আমাকে দেখে জালাল ভাই বললেন, ‘মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের দালাল চলে আইছো?’ আমি ভাবলাম— সর্বনাশ করেছে! করিম ভাই ইতোমধ্যে নকশাল হয়ে গেছে! আমি বললাম, যার দালাল হই, আর যাই হই, আমি তো আপনার শিষ্য। আগে একটু বসতে দেন। উনি বললেন, না না, মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের দালালের বসার জায়গা নেই। বললাম, আমি আসছি আপনারে আমরা এমপি বানাতে চাই বলে। উনি বললেন, আমাকে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের দালাল বানাবা? তিনি আমাকে বসতেই দিলেন না। হতবাক হয়ে দুই গ্লাস পানি খেয়ে ফিরে আসলাম।
রাস্তায় এসে চিন্তা করছি— কোথায় যাবো? তখান মনে পড়লো পাটকেলঘাটায় তো স. ম আলাউদ্দীন আছে। স. ম আলাউদ্দীন যে ওখানে মাস্টারি করে, তা আমার খেয়াল ছিলো না। ভাবলাম— পাটকেলঘাটায়ইতো আলাউদ্দীনের বাড়ি, তাহলে পাটকেলঘাটায় যাই। এখন তো খুলনায় ফেরার কোনো রাস্তা নেই। স. ম আলাউদ্দীনকে যদি খুঁজে পাই, তাহলে রাত্রিযাপনের একটা ব্যবস্থা হবে, অথবা ওখান থেকে সাতক্ষীরায় চলে যাবো। এমন চিন্তা করতে করতে রওয়ানা করেছি। জালালপুর স্কুলের সামনে গিয়ে দেখি— স্কুল ছুটি হয়ে গেছে। মাঠের মধ্যে দিয়ে আলাউদ্দীন আমাকে দেখে ডাকছে, ওই টুকু! কোথায় যাও? আমি বললাম, তোমারে খুঁজতে আইছি। বললাম, আমারে আগে কিছু খাওয়াও। তারপর দোকান থেকে সে খাবার এনে আমাকে খাওয়ালো।
তারপর বললাম, করিম ভাইয়ের কাছে আইছিলাম তাকে এমপি বানাবো বলে, কিন্তু তিনি আমাকে মার্কিন সম্রাজ্যবাদের দালাল বলে তাড়াইয়া দিলো। এখন আমি কোথায় যাবো, তাই তোমার উদ্যেশ্যে রওনা করেছিলাম পাটকেলঘাটায়। ও বলল, ঠিক আছে, ভালো করেছো, চলো।
ওর কাছে বাই সাইকেল ছিলো। আমি ওর সাইকেলের পিছনে ক্যারিয়ারে বসে পাটকেলঘাটায় চলে আসলাম। ওর বাড়িতে পৌঁছে খেয়ে-দেয়ে বললাম, আলাউদ্দীন এমপি হওয়ার সুযোগ আছে, নিতে পারো। ও বললো, কী সুযোগ? তারপর সব শুনে ও বললো, কও কি? ভোটার হইছি কেবল, আমারে কি নমিনেশন দেবে?
আমি বললাম, লোক নেই, লোক খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। হবে কেডা কও? ও বললো, তাও তো ঠিক। আমি বললাম, চলো, তোমারে এমপি বানানো যায় কিনা দেখি। করিম ভাইতো রাজি হলেন না। ওরে নিয়ে পরের দিন ভেতরের পথ দিয়ে খুলনায় চলে আসলাম। তখন বেবি ট্যাক্সি চলতো। বেবি ট্যাক্সিতে আসলাম চুকনগরে। তারপর নদী পার হয়ে ওখান থেকে আবার বেবি ট্যাক্সি নিয়ে দৌলতপুর আসলাম। দৌলতপুর থেকে খুলনায় আসলাম। আলাউদ্দীনকে নিয়ে পার্টি অফিসে এসে আজিজ ভাইয়ের সামনে হাজির হলাম। বললাম, করিম ভাই তো নকশাল হয়ে গেছেন, আমারে তো গলা কেটে দিচ্ছিলেন প্রায়! আলাউদ্দীন আমাদের সাতক্ষীরা ছাত্রলীগের ভাইস প্রেসিডেন্ট ছিলো, এখন হাইস্কুলের হেড মাস্টার। খুব সুনাম। ওকে মনোনয়ন দেওয়া যায়। আজিজ ভাই আমাকে বললেন, তুমি বলতেছো? আমি বললাম, বলতেছি মানে … আজিজ সাহেব বললেন, তাহলে ঠিক আছে। এরপর নির্বচন হলো। খুলনা-১৩ আসন থেকে মমতাজ আহমেদ এবং খুলনা-১৪ আসন থেকে স. ম আলাউদ্দীন আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থী হিসেবে বিপুল ভোটে প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হলো।
আমার প্রস্তাবনায় একজনের মনোনয়ন হলো, অথচ আমি মনোনয়ন চাইলাম, আমাকে মনোনয়ন দিলো না। আমাকে মনোনয়ন দেয়নি তার কারণ— আমি যদি খুলনার এমপি হয়ে যাই তাহলে ওনাদের মাতব্বরি খাটো হয়ে যায়। তখন তরুণ সমাজ আমার সাথে ছিলো। পাওয়ার পলিটিক্সে আমি হেরে গেলাম। পার্লামেন্টারি বোর্ডের মধ্যে বঙ্গবন্ধু আমাকে বললেন, তুই কেমন আছিস? (উল্লেখ্য, বঙ্গবন্ধুর সাথে আমি একসাথে জেল খেটেছি প্রায় দেড় বছর)। আমি বললাম, আমি ভালো আছি, আপনি কেমন আছেন? বঙ্গবন্ধু বললেন, এবার তোকে মনোনয়ন দিতে পারছি না। তুই যা, পরে আমি তোর ব্যবস্থা করবো। আমি বললাম, দেবেন না তা ডাকলেন কেন? দেবেন না ভালো কথা, আমার কথা একটু শোনেন। বঙ্গবন্ধু বললেন, তোর কথা কী শুনবো? তোকে তো চিনি এবং জানি। আমার শোনা লাগবে না। আমি এবার তোকে মনোনয়ন দিতে পারছি না। এরকমভাবে ওনার সঙ্গে কথা কাটাকাটি হচ্ছে, এমন সময় তাজউদ্দিন সাহেব উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, আপনি একাই যদি সব করবেন তাহলে আমরা চলে যাই। এরপর বঙ্গবন্ধু বললেন, আচ্ছা ঠিক আছে, তোমরা সবাই বসো। আমার কাছে ফাইল ছিলো। আমি ১৯৬২ থেকে ১৯৭০ সাল পর্যন্ত ৬৬৯টি সভায় উপস্থিত থেকে বক্তব্য দিয়েছিলাম, তার পেপার কাটিংসহ আমার জীবনবৃত্তান্তের ফাইল। কিন্তু ‘পাওয়ার পলিটিক্সের’ কারণে শেষ পর্যন্ত আমার নমিনেশন হয়নি।
পরবর্তীকালে যুদ্ধের সময় স. ম আলাউদ্দীনের সাথে আমাদের সম্পর্ক আরো ঘনিষ্ঠ হয়। যদিও আমি প্রস্তুতি পর্বে সাতক্ষীরা এলাকায় খুব বেশি যেতে পারিনি। যুদ্ধের সময় ট্রেনিং নিতে ভারতে গেলে আলাউদ্দীনের সঙ্গে দেখা হয়। আমি ট্রেনিং নিয়ে ফিরলাম, ও পরের ট্রিপে ট্রেনিং নিয়েছিলো। ট্রেনিং নিয়ে ও আবার ফিরে এসে গ্রামে ট্রেনিং দিতে থাকে। এরপর আমরা একত্রিত হয়ে মুজিব বাহিনীর পরিকল্পনা মতো কাজ করি। এভাবে আমরা মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করি। স. ম আলাউদ্দীন অন্যতম এমপি যিনি সরাসরি মহান মুক্তিযুদ্ধে অস্ত্রহাতে অংশগ্রহণ করেছিলেন। স. ম আলাউদ্দীন ছিলেন তখন সর্বকনিষ্ঠ এমপি।
১৯৬৪ থেকে ১৯৭১ পর্যন্ত আমি দশ-বারো বার জেলে গিয়েছি। একবার বঙ্গবন্ধুর সাথে ষোলো মাস জেলখানায় কাটিয়েছি। এটা ঢাকায়। আমি ধরা পড়েছিলাম ঢাকায়। তাই সেখানে জেলখাটতে হয়েছিলো। আমি খুলনার ছাত্রলীগের কনভেনর হই ১৯৬৪ সালে। পূর্বের কমিটিটা এখানে ভালো চলছিলো না। পুরনো কমিটি ভেঙে দিয়ে আমাকে কনভেনর করার পর ১৯৬৫ সালে আমি সম্মেলন করি। সম্মেলনে শাহ্ মুয়াজ্জেম, শেখ ফজলুল হক মনি, ফেরদৌসের আহমেদ কোরাইশী, আব্দুর রাজ্জাক, সিরাজুল আলম খানসহ প্রায় সকল কেন্দ্রীয় নেতা উপস্থিত ছিলেন। এই সম্মেলনের আগে সাতক্ষীরা ও বাগেরহাটের কমিটি গঠন করা হয়। স্কুলগুলোতে কমিটি গঠন করা হয়।
ওই সম্মেলন থেকে আমাকে খুলনা মহানগর ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক করার চেষ্টা করা হয়। তখন মহানগর ছাত্রলীগ ও জেলা ছাত্রলীগের সমান মর্যাদা ছিলো। আমি মহানগর ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক হতে রাজি না হয়ে চুপচাপ দাঁড়িয়ে গেলাম। এটা নিয়ে আবার ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দ অসন্তুষ্ট হলেন। তারপরও আমি বললাম, দায়িত্ব নেব না। যাইহোক, তারপরে দায়িত্ব ভাগ হয়ে গেলো। মাস খানেক পরে ছাত্রলীগের সেন্ট্রাল কমিটির সম্মেলন ছিলো। সেন্ট্রাল কমিটির সম্মেলনে এই অঞ্চলের প্রতিনিধি হিসেবে আমি ভাইস প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলাম। ১৯৬৬ সালে ডিগ্রি পরীক্ষা দিলাম। পরীক্ষা দিয়ে ব্যাগপত্র নিয়ে ঢাকায় চলে গেলাম। লক্ষ্য ছিলো— রাজনীতি। পড়ালেখা মূল লক্ষ্য ছিলো না। রেজাল্ট খারাপ হলে ‘ল’ পড়ব বলে আগে থেকেই মন স্থির করে রেখেছিলাম। ঢাকায় গিয়ে ইকবাল হলে উঠলাম। তখন গণঅভ্যুত্থানের প্রস্তুতি পর্ব চলছে।
আমাকে শ্রমিকদের সংগঠিত করার জন্য তেজগাঁও এলাকার দায়িত্ব দেওয়া হয়। নূরে আলম সিদ্দিকী, আমি ও খালেদ মোহাম্মদ এই তিনজন তেজগাঁও এলাকায় শ্রমিকদের সংগঠিত করার দায়িত্ব পালন করি। রোজ বিকেল বেলায় বেবি ট্যাক্সিতে তেজগাঁও এলাকায় যেতাম, সারারাত তেজগাঁও এলাকায় মিটিং করে ভোর হলে আবার ফিরে আসতাম। এরপর খেয়েদেয়ে ঘুম পড়তাম। দুপুরে উঠে ক্যাফেটেরিয়ায় আড্ডা দিয়ে আবার বিকেলে তেজগাঁও চলে যেতাম। এখানে মাস দেড়েক কাজ করার পর আগস্ট মাসের ১ তারিখে অ্যারেস্ট হই। সাথে দুইজন শ্রমিক নেতাও অ্যারেস্ট হয়। আমরা চলে গেলাম জেলখানায়। জেলে থাকা অবস্থায় সেপ্টেম্বর-অক্টোবর মাসে পরীক্ষার রেজাল্ট বের হয়। জেলে থাকার কারণে ভর্তি হতে পারলাম না। পরের ভর্তি পরীক্ষায়ও জেলখানায় ছিলাম। ফলে পড়তে পারলাম না। টেস্ট পরীক্ষাও দিতে পারলাম না। ১৯৬৯ সালে আওয়ামী লীগের সম্মেলন হলো। আমি বৃহত্তর খুলনার আওয়ামী লীগের প্রচার সম্পাদক নির্বাচিত হলাম এবং সেচ্ছাসেবক বাহিনীর প্রধান হলাম।
এরপর যুদ্ধের প্রস্তুতি পর্ব চলে আসলো। ২৫ মার্চ কালরাতের পর ২৬ মার্চ স্বাধীনতা ঘোষণা আসলো। ২৭ মার্চ খুলনায় আমরা আর্মি ক্যাম্প আক্রমণ করলাম। এটাই ছিলো পাকিস্তানি বাহিনীর ওপর মুক্তিবাহিনীর প্রথম আক্রমণ। ২ এপ্রিল গল্লামারি বেতার কেন্দ্র আক্রমণ করলাম। খুলনায় আর্মি ঢোকার সময় দুইবার প্রতিহত করলাম। এরপর বাগেরহাটের দিকে চলে গেলাম। বাগেরহাটে আর্মি প্রতিহত করতে গিয়ে আমাদের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হলো পঁচা দিঘীর পাড়ে।
এরপরে ট্রেনিং হবে শুনে আমি ভারতে গেলাম। ওখানে গিয়ে রাজ্জাক ভাইয়ের সাথে দেখা করলাম। উনি আমাকে বিএসএফ-এর ক্যাম্পে নিয়ে গেলেন। ওখান থেকে রাজ্জাক ভাইকে সাথে নিয়ে ফেরার পথে বিএসএফ আমাদের কিছু অস্ত্র দিলেন। সম্ভবত আমাকে ছোট মানুষ মনে করে আমার কাছে কোনো অস্ত্রপাতি দিলেন না। আমি নেমে গেলাম পিরোজপুরে। আমার সাথে যারা ছিলো তাদের বললাম— তোমরা সুন্দরবনের দিকে চলে যাও। এভাবে হবে না। আমাকে ট্রেনিং নিতে হবে। আমি ট্রেনিং নেওয়ার জন্য আশাশুনি হয়ে হিঙ্গলগঞ্জ পার হয়ে আবার ভারতে যাই। তখন কড়াকড়ি শুরু হয়ে গেছে। আমার কাছে যা ছিলো সব কেড়ে নিলো। হিঙ্গলগঞ্জ পার হলাম। ওপারে গিয়ে একদিন পরে ট্রেনিং-এ যোগ দিলাম। ট্রেনিং শেষে আবার হাকিমপুর হয়ে ভেতরে (দেশে) প্রবেশ করলাম। ভেতরে প্রবেশ করার সময় স. ম আলাউদ্দীনের সাথে আমার দেখা হয়। আমি ঠিক জানতাম না যে, ওখানে আলাউদ্দীন আছে। সালাম ভাইকে (খুলনার শেখ আব্দুস সালাম, আওয়ামী লীগ করতেন) রেখে গিয়েছিলাম কোলকাতার বসিরহাটে। সালাম ভাইয়ের সাথে আলাউদ্দীনের যোগাযোগ হয়। যোগাযোগ হওয়ার পরে আলাউদ্দীন আমাকে বললো, তোমাকে ভেতরে যাওয়ার ব্যবস্থা করে দিচ্ছি। এ সময় স. ম আলাউদ্দীন, সুজাত আলী মাস্টারের সাথে মুড়াগাছার একটা গ্রুপ প্রস্তুত রেখেছিলো। ওদের সাথে আমারা হাকিমপুর বর্ডার পার হই। আমরা ওখানে দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে যাই। এখানে উল্লেখ্য, আলাউদ্দীন সহ আমরা ফেরার পথে ইঞ্জিনিয়ার শেখ মুজিবুর রহমানের দেখা পেলাম। তিনি ছাত্র থাকাকালীন ইঞ্জিনিয়ার বিশ্ববিদ্যালয় (এখন বুয়েট) ছাত্রলীগের নেতা ছিলেন। এছাড়াও আরো কয়েকজন আমাদের সাথে ছিলো।
আমরা এক গ্রুপ মুড়াগাছার নিচে বিলে অবস্থান নিলাম। আর এক গ্রুপ ডাঙায় অবস্থান নিলো। এখান থেকে আমাদের সাংগঠনিক অবস্থা ধীরে ধীরে শক্তিশালী হলো। এলাকার রাজাকার, আলবদরদের খেদায়ে দিয়ে মুক্তাঞ্চল গঠন করা হলো। মুক্তাঞ্চল গঠন করার একটা কায়দা ছিলো এরকম— আমরা একটা দু’টো মেরে দিতাম। মেরে দিলে রাজাকারপন্থীরা সব ভেগে যেত। আর ইয়ং পোলাপান সব যুদ্ধের ট্রেনিং নিতে শুরু করে দিতো। সাধারণ মানুষদের নিয়ে সিভিল ডিফেন্স শুরু করে দিতাম। এভাবে মুজিব বাহিনীর ৮০টি ক্যাম্প শেষ পর্যন্ত যুদ্ধ করেছিলো। অনেকগুলো বড় যুদ্ধ করেছি। তার মধ্যে কপিলমুনির যুদ্ধ অন্যতম। কপিলমুনির যুদ্ধে স. ম. আলীউদ্দীনও অংশ নিয়েছিলো।
পূর্বেই বলেছি— মহান মুক্তিযুদ্ধে ক্যাম্প করতে করতে শেষ পর্যন্ত ৮০টিতে দাঁড়িয়েছিলো। আমরা আশাশুনি, শ্যামনগর, দেবহাটা, কালিগঞ্জ, কয়রা, পাইকগাছা, ডুমুরিয়া, বটিয়াঘাটা, দাকোপ, রামপাল, মোংলা, মোড়েলগঞ্জ, শরণখোলা এবং বাগেরহাটে মোটামুটিভাবে আমাদের ক্যাম্প দাঁড় করিয়ে ফেললাম। এভাবে যুদ্ধের শেষের দিকে আমরা গল্লামারির নিচের দিকে চকরাখালিতে সবাই একত্রিত হলাম যুদ্ধের পরে। সেখান থেকে আমরা খুলনায় উঠলাম। খুলনার পর আমার ওপর দায়িত্ব পড়ে মোংলা সংগঠিত করার।
দেশ স্বাধীনের পর স. ম আলাউদ্দীনসহ আমরা আবার একসাথে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল— জাসদ করেছি। পরে আবার আলাউদ্দীন জাসদ ছেড়ে আওয়ামী লীগে ফিরে যায়। আমিও ফিরে আসি। রাশিয়া ও চীনে সমাজতন্ত্রের যে জাগরণ সৃষ্টি হয়েছিলো, তার ঢেউ লেগেছিলো সারা বিশ্বে। পরবর্তীতে তা আবার শিথিল হয়ে পড়ে। আমরা বাস্তবতা বুঝতে পেরেছিলাম।
স. ম আলাউদ্দীন ছিলেন একজন সরল সোজা মানুষ। কূটচালের রাজনীতি সে পছন্দ করতো না। সে সামনা-সামনি কথা বলতে পছন্দ করতো। কারো সমালোচনা করলেও সামনা-সামনি করতো, আবার কারো প্রশংসা করলেও সামনা-সামনি করতো। পিছনে সমালোচনা করতো না। স. ম. আলাউদ্দীনের একটা বড় গুণ ছিলো— সেটা হলো রাজনীতির পিছনে যে খরচ হতো তা নিজের পকেট থেকেই করতো। কারো কাছ থেকে চাঁদা তুলে সে রাজনীতি করতো না। নিজের ব্যবসা-বাণিজ্যের টাকা থেকেই দলীয় কাজে খরচ করতো। নানান ধরনের ব্যবসা-বাণিজ্যের মধ্য দিয়ে সে একজন স্বনামধন্য ব্যবসায়ী হয়ে উঠেছিলো। আমিও তার মতো একই কায়দার মানুষ। আমি কখনো চাঁদা নিয়ে রাজনীতি করিনি, করতেও চাই না।
তিনি জনগণ এবং সাতক্ষীরার উন্নয়ন নিয়ে ভাবতেন। আমি একবার কোলকাতায় গিয়েছিলাম চিকিৎসার জন্য। সেখানে আলাউদ্দীনের সঙ্গে দেখা হলো। দেখলাম ওর কাছে বড় একটা ফাইল। জিজ্ঞেস করলাম— কোথায় যাবা? ও বললো, দিল্লি যাবো। আমি বললাম, কেন? ও বললো, ভোমরাকে আন্তর্জাতিক বন্দরে রূপান্তরিত করতে হবে। এটা না করলে সাতক্ষীরার উন্নয়ন হবে না। তার মধ্যে এমনই বদ্ধমূল ধারণা ছিলো যে, ভোমরার যদি উন্নতি হয়, তাহলে সাতক্ষীরার উন্নতি হবে। আমরা কোলকাতার একই হোটেলে ছিলাম। এরপর সে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার ও শিল্পমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করার উদ্দেশ্যে দিল্লি যায়। আমি তাকে বলেছিলাম— এসব না করে রাজনীতি করতে। ও খুব জেদি ছিলো। দুরন্ত সাহস ছিলো স. ম আলাউদ্দীনের। আমিও পরে বুঝেছি— ভোমরা বন্দরের সাথে সাতক্ষীরার উন্নয়নের যোগ সূত্র রয়েছে।
স. ম আলাউদ্দীন ছিলো বন্ধু বৎসল একজন সরল মনের মানুষ। কর্ম চঞ্চল ছিলো। মানুষের বিপদে আপদে ঝাঁপিয়ে পড়তো। কোনো কাজকে সে ফেলে রাখতো না। একটু জেদিও ছিলো। সাহসী তো বটেই। কাজ আদায় না করে সে ঘরে ফিরতো না। তার খোলামেলা স্বভাব ও প্রকাশ্যে কথা বলাটা অনেকেই ভালোভাবে নিতে পারেনি। রাজনীতিতে একটু কৌশলী হওয়ার যে বিষয়টি আছে, সেটি তার মধ্যে ছিলো না। দুর্নীতির সাথে আমি তাকে কখনো জড়িত হতে দেখিনি। সাধারণ মানুষের সাথে তার সম্পর্ক ছিলো খুব নিবিড়। আমরা একটি সম্ভাবনাময় রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব অল্প বয়সে হারিয়েছি। যারা তাকে হত্যা করেছিলো তারা সাতক্ষীরার জন্য কোনো উপকার করেনি। ঘাতকরা সাতক্ষীরার গণমানুষের চরম ক্ষতি করেছে। সবার সামনে সত্য কথাটা বলতো বলেই এক সময় তার জীবনে অশনি সংকেত নেমে আসে। ব্যবসায় তার দ্রুত সফলতাও অনেকের হিংসার কারণ হয়ে দাঁড়ায়েছিলো। সে কারণে তাকে জীবন দিতে হয়েছে। তার হত্যার প্রতিবাদে সকল আন্দোলন সংগ্রামে অংশ নিতে আমি আমার সাধ্যমত চেষ্টা করেছি। সেই ১৯৬৪ সালের সম্পর্ক সূত্র ধরে আমি চেষ্টা করেছি তার হত্যার প্রতিবাদ করার। কিন্তু আসলে আমাদের দেশের আইন-কানুন এবং বিচার ব্যবস্থার দীর্ঘসূত্রিতায় বিচার হওয়া খুব কঠিন। এখনো বীর মুক্তিযোদ্ধা, ’৭০-এর সর্বকনিষ্ঠ এমপি স. ম. আলাউদ্দীন হত্যার বিচার হয়নি, এজন্য আমার গভীর দুঃখবোধ রয়েছে।
লেখক: মুক্তিযুদ্ধকালীন আঞ্চলিক প্রধান, বৃহত্তর খুলনাঞ্চল, মুজিবাহিনী। চেয়ারম্যান, জেলা পরিষদ, বাগেরহাট ও সভাপতি, বাগেরহাট জেলা আওয়ামী লীগ।
স. ম. আলাউদ্দীনের জীবন ও কর্ম
জননেতা ও সমাজসেবী, সর্বকনিষ্ঠ এমপি হিসেবে মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী স. ম. আলাউদ্দীন ছিলেন সাতক্ষীরা জেলা চেম্বারের সভাপতি এবং দৈনিক পত্রদূত পত্রিকার সম্পাদক। জনাব আলাউদ্দীন ১৩৫২ সালের ১৫ ভাদ্র, ১৯৪৫ সালের ২৯ আগস্ট জন্মগ্রহণ করেন। জন্মস্থানঃ গ্রাম-মিঠাবাড়ী, ইউনিয়ন-নগরঘাটা, উপজেলা- তালা, জেলা- সাতক্ষীরা।
ছাত্রজীবনঃ তিনি গ্রামের স্কুল থেকে ৫ম শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়া শেষ করে স্থানীয় সরুলিয়া স্কুলে ৮ম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশুনা করেন। ১৯৬২ সালে কলারোয়া হাইস্কুল থেকে ২য় বিভাগে মেট্রিক, ১৯৬৪ সালে সাতক্ষীরা কলেজ থেকে ২য় বিভাগে এইচএসসি, ১৯৬৭ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে দৌলতপুর বিএল কলেজ থেকে বিএ পাশ করেন। মেধা তালিকায় ২য় শ্রেণিতে ৭ম স্থান অধিকার করেন। ১৯৭৫ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন বাংলা সাহিত্য এমএ পরীক্ষায় ২য় শ্রেণিতে উত্তীর্ণ হন।
কারাজীবনঃ ১৯৭৫ সালের ১৬ ডিসেম্বর হতে ১৯৭৬ সালের জুন মাস পর্যন্ত খুলনা, ঢাকা, যশোর কারাগারে থাকেন। পুনরায় ঐ বছর (১৯৭৬ সালের আগস্ট মাসে) দুই দিন সাতক্ষীরা থানায় আটক ছিলেন। খুলনা জেলখানায় নিম্নমানের খাদ্য সরবরাহসহ বেশ কিছু অনিয়মের কারনে জাসদ, ইউনাইটেড পিপলস পার্টি, কমিউনিস্ট পার্টির নেতাকর্মীদের সাথে স. ম. আলাউদ্দীন অনশন ধর্মঘটে অংশগ্রহণ করেন। ধর্মঘটের পর জেলখানা কর্তৃপক্ষ ধর্মঘটকারিদের বিভিন্ন ভয়ভীতি দেখানো সত্ত্বেও যখন কোনো কাজ হয়নি তখন ধর্মঘটকারিদের বিভিন্ন জেলখানায় স্থানান্তরিত করা হয়। স. ম. আলাউদ্দীনের সাথে যে সমস্ত নেতাকে যশোর কেন্দ্রীয় কারাগারে স্থানান্তরিত করা হয় তাদের মধ্যে হাফিজুর রহমান, প্রায়ত মানস ঘোষ, মরহুম বাচ্চু, শেখ হাসনে জাহিদ জজ, রফিকুজ্জামান খোকন, আব্দুস ছাত্তার, প্রায়ত কার্তিক চন্দ্র মন্ডলসহ আরও অনেক রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গ ছিলেন।
রাজনৈতিক জীবন: স. ম আলাউদ্দীন ছাত্র অবস্থায় রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত হন। কলেজ কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে অধিকার আদায়ের লক্ষে আন্দোলন করেছেন এবং দেশের প্রতিটি ক্রান্তিকাল উত্তরণের সংগ্রামে অংশগ্রহণ করেছেন। একজন রাজনৈতিক নেতা হিসেবে তিনি ছিলেন নির্ভিক সাহসী, তার সুদীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে তিনি বহু প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেছেন। তিনি ছিলেন নিরহংকারী, ব্যক্তিত্বশালী ও সহানুভূতি প্রবন। সাংগঠনিক ক্ষমতাবলেই তিনি দলের নেতা হয়েছিলেন। তিনি ছিলেন সুবক্তা। তার সুমধুর তেজস্বী কণ্ঠের বক্তব্য মানুষের হৃদয়কে নাড়া দিত। তার আবেগময় বক্তৃতা জনগণকে সহজেই আকৃষ্ট করতো। যুক্তিবাদী বলিষ্ঠ করে একজন বক্তা হিসাবে রাজনীতিতে তার যথেষ্ট সুনাম ছিল। ১৯৬২ সালে হামিদুর রহমান শিক্ষা কমিশন রিপোর্টের বিরুদ্ধে আন্দোলনে অংশগ্রহণের মাধ্যমে রাজনৈতিক জীবনের হাতেখড়ি। ১৯৬৫ হতে ১৯৬৭ সাল পর্যন্ত ছাত্রলীগ নেতা ছিলেন। ১৯৬৮ সালে আওয়ামী লীগে যোগ দেন। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে তিনি তালা-কলারোয়া (সাতক্ষীরা-১) আসনে আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী হিসাবে নির্বাচিত হয়ে প্রাদেশিক পরিষদের সদস্যপদ লাভ করেছিলেন। তৎকালীন পূর্ব পাকিন্তানে তিনিই ছিলেন সর্বকনিষ্ঠ এমপিএ (প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য)।
স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশগ্রহণঃ জীবনের বিভিন্ন পর্যয়ে স. ম. আলাউদ্দীনের রয়েছে সুদীর্ঘ ইতিহাস। তিনি ১৯৭১ সালে সরাসরি মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের কারণে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর লে. ক. তাহের যশোর সংক্ষিপ্ত সামরিক আদালতের বিচারে তার অনুপস্থিতিতে ১৪ বছর সশ্রম কারাদন্ড, সমস্ত সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করেন এবং তাকে ধরিয়ে দেওয়ার জন্য নগদ ৪০ হাজার টাকা পুরস্কার ঘোষণা করা হয়। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধে তার আবদান চীর স্মরণীয়। তিনি ভারতের বিহার প্রদেশের চাকুলিয়া জেলায় ছয় সপ্তাহ সিএনসি বিশেষ টিমে যুদ্ধের ট্রেনিং নেন। এই বিশেষ টিমে তিনিসহ ১৪ জন এমএনএ এবং এমপিএ এবং ৩জন ইঞ্জিনিয়িার ছিলেন। তিনি বাগুন্ডিয়া এবং ইটিন্ডা ক্যাম্পে নিয়মিত বাহিনীর সাথে যুদ্ধে নিয়োজিত ছিলেন। পরে একটি শক্তিশালী গেরিলা বাহিনীসহ দেশে প্রবেশ করেন। তিনি তালা উপজেলার মাগুরা গ্রামে পাকিস্তানি মিলিটারি এবং কপিলমুনি গ্রামে (বিনোদগঞ্জে) রাজাকার বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেন। যুদ্ধের মধ্য দিয়ে একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা হিসাবে ইতিহাসে তার নাম স্বর্ণাক্ষরে লিপিবন্ধ থাকবে। উল্লেখ্য, ১৯৭০ সালে জাতীয় এবং প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের পক্ষ হতে জাতীয় পরিষদে ১৬৭ জন এবং প্রাদেশিক পরিষদে ২৯৮ জন সদস্য নির্বাচিত হন। যাদের প্রায় সকলেই ভারতে চলে যান। (গ্রেপ্তার হওয়া এবং আত্মসমর্পন করা ছাড়া) মাত্র ৯জন অস্ত্র হাতে দেশের মধ্যে সরাসরি মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। স. ম. আলাউদ্দীন তাদের মধ্যে অন্যতম ।
২১ মার্চ ১৯৭১ঃ স. ম. আলাউদ্দীন এবং মোঃ মোস্তাফিজুর রহমান (ছাত্রলীগের তৎকালীন সাতক্ষীরার সভাপতি) ভারতে অস্ত্র ও গোলাবারুদ লাভের উদ্দেশ্যে রওনা হন। কয়েকদিন প্রচেষ্টার পর তৎকালীন বিএসএফ ইস্টার্ন কমান্ড-এর জিওসিআরএন চ্যাটার্জীর সাথে ভারতীয় লোকসভার সদস্য আব্দুল গফফারের উপস্থিতিতে তদানিন্তন পশ্চিমবঙ্গের অর্থমন্ত্রী তরুণ কান্তি ঘোষের পিতা যুগান্তর পত্রিকার সম্পাদক তুষার কান্তি ঘোষের বারাসাতের বাসভবনে ৪ এপ্রিল ১৯৭১ সালে চুক্তি হয়। চুক্তিটি ছিলো— ভোমরা ও বেনাপোল দু’টি স্থান দিয়ে অস্ত্র ও গোলাবারুদ সরবরাহ করার। বসিরহাট মহকুমার ঢাউন হল ময়দানে ৫ এপ্রিল ১৯৭১ তারিখে এক মিটিং হয়। মিটিংয়ে প্রধান বক্তা ছিলেন স. ম. আলাউদ্দীন। তিনি ৮ এপ্রিল ১৯৭১ ভারত থেকে চলে আসেন। প্রকাশ থাকে যে, ৯নং সেক্টর কমান্ডার প্রখ্যাত মুক্তিযোদ্ধা মরহুম মেজর জলিল তার “অরক্ষিত স্বাধীনতাই পরাধীনতা” বইটিতে আওয়ামী লীগের সমালোচনা করলেও কয়েকজন আওয়ামী লীগ নেতার সুনাম করেছেন। উক্ত বই এর ৪৮ পৃষ্ঠায় তিনি লিখেছেন যে, সাতক্ষীরার তালা থানার তরুণ এমপি স. ম. আলাউদ্দীন স্বাধীনতা যুদ্ধে তৎপর ছিলেন।
সমাজ কল্যাণমূলক কাজঃ স. ম. আলাউদ্দীন সাতক্ষীরার বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানের মধ্যমনি হিসেবে পরিচিত। তার কথা ও কাজে জীবনমুখি প্রভাব ছিলো সুস্পষ্ট। রাজনৈতিক অঙ্গনে পদাচারণার পাশাপাশি তিনি নানান ধরনের সমাজসেবামূলক কাজ করেছেন। সীমান্ত জেলা শহর সাতক্ষীরা থেকে উত্তর দিকে ৬ কিলোমিটার দূরে সাতক্ষীরা-খুলনা মহাসড়কের পাশে এবং তার বিস্কুট ফ্যাক্টারির কাছে তিনি ১৯৯৪ সালে নগরঘাটা শিশু হাসপাতালের জন্য ১০ কাঠা জমি দান করেন। উক্ত প্রতিষ্ঠানটি সাতক্ষীরা পৌরসভার অধিনস্থ রসুলপুর নিবাসী বিশিষ্ট শিশু চিকিৎসক জাতীয় অধ্যাপক এম. আর. খানের উদ্যোগে ও সহযোগিতায় পরিচালিত হচ্ছে। সেটাই পরবর্তীতে স. ম. আলাউদ্দীন ব্যাপক আকারে তৈরি করার প্রবল বাসনা বুকে পালন করে আসছিলেন। বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নক বুকে লালন করে তার স্বপ্নকে বাস্তবায়ন করার লক্ষে গরিব মানুষের সন্তানদের উৎপাদনে আগ্রহী করতে গড়েছিলেন বঙ্গবন্ধু পেশাভিত্তিক স্কুল এন্ড কলেজ। তিনি ঐ প্রতিষ্ঠানের প্রতিষ্ঠাতা অধ্যক্ষ ছিলেন। ভোমরা স্থলবন্দর প্রতিষ্ঠায় তার গুরুত্বপূর্ণ অবদান ছিলো ।
তিনি ভোমরা স্থল বন্দর ব্যবহারকারি সমিতির প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ছিলেন। স্বাধীনতা যুদ্ধের পর এই প্রথম স্থল বন্দর চালু হয় এবং এটি চালু করার জন্য তিনি দীর্ঘ বারো-তেরো বছর সংগ্রাম করে এসেছেন। সাতক্ষীরা চেম্বার অব কমার্স ইন্ডাস্ট্রিজ-এর সভাপতি এবং বাংলাদেশ ফেডারেশন চেম্বার অব কমার্সের কেন্দ্রীয় সদস্য ছিলেন। তিনি সাতক্ষীরা জেলা ট্রাক মালিক সমিতির প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ছিলেন। তিনি ছিলেন সাতক্ষীরা জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংহতি পরিষদের আহবায়ক ও পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি সাতক্ষীরা-১-এর পরিচালক।
১৯৭১-এ মুক্তিযুদ্ধের সময় প্রশিক্ষণ গ্রহণের সুবাদে এবং পরবর্তীকালে ভারতের বিভিন্ন স্থানে গিয়েছেন তিনি। হংকং, দুবাই, তাইওয়ান ভ্রমন করেন। তিনি ১৯৯৬ সালে পবিত্র হজ্জ্বব্রত পালন করেন। ১৯৯৬ সালের ২৫ জুলাই বাংলাদেশ ফেডারেশন চেম্বার অব কমার্সের কাজে স. ম. আলাউদ্দীনসহ তিন জনের একটি প্রতিনিধিদল হায়দ্রাবাদ যাওয়ার কথা ছিলো। এরপর জাপান যাওয়ার কথা ছিলো স. ম. আলাউদ্দীনের। কিন্তু দুঃখের বিষয় তার আগেই ১৯ জুন ১৯৯৬ বুধবার রাত ১০টা ২৩ মিনিটে আততায়ীর গুলিতে তিনি নিহত হন। আরো দুঃখের বিষয়— এই হত্যাকাণ্ডের কোনো বিচার আজও হয়নি।