পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী তাদের এ দেশীয় দোসরদের সহায়তায় ১৯৭১ সালে ২৫ মার্চ রাতে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের বিরুদ্ধে অপারেশন সার্চলাইট পরিচালনা করে এবং গণহত্যা শুরু করে, যা অব্যাহত থাকে বিজয় অর্জনের পূর্ব পর্যন্ত, এমনকি ১৭ ডিসেম্বর এবং তারপরও অনেক দিন পর্যন্ত— প্রকৃতপক্ষে ঢাকার মিরপুর মুক্ত হয় ৩১ জানুয়ারি ১৯৭২-এ। গণহত্যার মধ্য দিয়ে পাকিস্তানি বাহিনী এবং তাদের দোসররা বাঙালি জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসী সাধারণ বাঙালি জনগণ, ছাত্র, শিক্ষক, বুদ্ধিজীবী, ধর্মীয় সংখ্যালঘু এবং পুলিশ ও ইপিআর কর্মকর্তাদের হত্যা করে। সেই হত্যাযজ্ঞ বাগেরহাট জেলার চিতলমারী থানার অর্ন্তগত দশমহল নামক স্থানের গরীবপুর ও খলিশাখালী গ্রামদ্বয়ের মানুষ এবং বিভিন্ন এলাকা থেকে এ এলাকায় এসে আশ্রয় নেওয়া মানুষের ওপরও সংগঠিত হয়।
গরীবপুর ও খলিশাখালী গ্রাম দুটির অবস্থান চিতলমারী থানা শহরের পূর্বদিকে বলেশ্বর নদীর কোল ঘেঁষে পিরোজপুর-নাজিরপুর সীমান্তে। চিতলমারী উপজেলার চরবানিয়ারী ইউনিয়ন তথা দশমহল এলাকাটি হিন্দু অধ্যুষিত এলাকা। এলাকাটির ঠিক মধ্যখানে অবস্থিত গরীবপুর ও খলিশাখালী গ্রাম দুটি। যুদ্ধের সময় এলাকাটি ছিল খুবই সুরক্ষিত। তাই বিভিন্ন এলাকা থেকে মানুষ বাঁচার আশায় এই এলাকায় নিরাপদে আশ্রয় নিত।
সেদিন ছিল রবিবার (৫ আষাঢ় ১৩৭৮ বঙ্গাব্দ, বেলা ১১টা। ইংরেজি ২০ জুন ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দ)। ইতোমধ্যে বাংলার গ্রামে-গঞ্জে সর্বত্র পাকিস্তনি সেনারা এবং তাদের দোসর— আলবদর, আলসামস্, রাজাকারেরা মিলে খুন, ধর্ষণ, লুটতরাজ অগ্নিসংযোগসহ নানা অত্যাচার নির্যাতন চালায়। কিছু মানুষ ভয়ে পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্র ভারতে আশ্রয় নিতে শুরু করে। বাগেরহাট জেলা তখন কুখ্যাত রাজাকার রজ্জব আলী ফকির ও তার সহযোগীদের ভয়ে ভীত-সন্ত্রস্ত। সকলেরই অতি পরিচিত, অত্যন্ত সুরক্ষিত অঞ্চল চিতলমারী থানার দশমহল অঞ্চল। তাই বিভিন্ন এলাকা— বিশেষ করে পিরোজপুর, উজিরপুর-নাজিরপুর প্রভৃতি এলাকার জনগণ অধিক নিরাপদ মনে করে আশ্রয় নিতে আসে দশমহলে।
দশমহল তখন ছিল যাতায়াতের অনুপযোগী। অধিকাংশ রাস্তাঘাট ছিল জল কাদায় পূর্ণ। কোথাও কোথাও রাস্তা ছিল বিছিন্ন। ফসলের জমি ছিল ধান আর পাটের সবুজে সবুজ। স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার (গরীবপুর নিবাসী) শান্তি রঞ্জন মণ্ডলের ভাষায়— রবিবার দিন সকালে শুনেছি পাকিস্থানি সেনাবাহিনী তারাবুনিয়া বাজারে বলেশ্বর নদীতে গানবোট নিয়ে প্রস্তুতি নিচ্ছে। বাবুগঞ্জ বাজারেও গানবোট নিয়ে কামান রেডি করেছে এবং কালিগঞ্জ বাজারে বলেশ্বর নদীপথে গানবোট চালিয়ে আসছে। আমরা তখন প্রতিহত করার জন্য যুদ্ধের প্রস্তুতি নিতে শুরু করি। কিছু সময় পর শুনতে পাই কুখ্যাত রাজাকার রজ্জব আলী তার দলবল নিয়ে বাগেরহাট থেকে দেপাড়া হয়ে আগুন জ্বালিয়ে পোড়াতে পোড়াতে স্থলপথে ছুটে আসছে দশমহলের দিকে। তারা সকলেই জানে দশমহল খুবই সুরক্ষিত। তাই তারা পরিকল্পিতভাবে একই দিনে এক যোগে হামলা করবে, যাতে সুরক্ষিত দশমহল আর সুরক্ষিত না থাকে। ওরা পুড়িয়ে ছারখার করে দিতে চেয়েছিল দশমহল, হত্যা করে মৃত্যুপুরী বানাতে চেয়েছিল। তখন আমরা বিচলিত হয়ে যাই। ভয় পেয়ে যায় দশমহলের সমস্ত লোক। ভয়ে সবাই পালাতে শুরু করে— যেখানে-সেখানে, পুকুরে-ডোবায়, খালে-বিলে-ডরে। থালা, ঘটি-বাটি, টাকা-পয়সা মাটির নিচে পুঁতে লুকিয়ে রাখতে চায়।
শুরু হয় তিন দিক থেকে কামানের গুলি। একদিকে রজ্জব আলী ফকির সহ তার অন্য সহযোগীরা অগ্নি সংযোগের মাধ্যমে শ্মশান বানাতে শুরু করে চিতলমারী হয়ে দশমহল পর্যন্ত। গরীবপুর, ডাকাতিয়া, চরবানিয়ারী, খলিশাখালী, খড়মখালী সহ বিভিন্ন গ্রামের লোকজন এবং নাজিরপুর, পিরোজপুর, উজিরপুর থেকে আসা আশ্রিত লোকজন ভয়ে লুকাতে থাকে গরীবপুর মডেল সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পিছনের বিলে। বিলটি তখন হোগলা আর নলবনে পরিপূর্ণ। প্রচুর জল, কোথাও কোথাও ঠাঁই মেলে না। বিলের পূর্ব-দক্ষিণে গরীবপুর, পশ্চিমে খলিশাখালী, খড়মখালী গ্রাম। গ্রামের প্রান্ত ঘেঁষে পাটের ক্ষেত, পাট কেবল একটু বড় হয়েছে। স্থানীয় লোকজন পাকিস্থানি সেনা এবং তাদের দোসরদের অস্ত্রের মুখে পরাজিত হয়ে লুকাতে বাধ্য হয়। রাজাকারদের সহযোগিতায় খুন, ধর্ষণ, লুটপাট এবং অগ্নি সংযোগ শুরু করে ওরা। গরীবপুর, খলিশাখালী গ্রামে আশ্রয় নেওয়া অসংখ্য নিরীহ মানুষকে তারা নির্মমভাবে হত্যা করে। শুরু হয় ভয়াবহ গণহত্যা। বিলের জল রক্তে রঞ্জিত হয়। যেখানে সেখানে পড়ে থাকে অসংখ্য লাশ।
স্থানীয় আরেক মুক্তিযোদ্ধা বাবু বিপুল কান্তি মণ্ডল (খলিশাখালী নিবাসী) বলেন, সেদিনের কথা মনে পড়লে শিউরে উঠি আজও। পাকিস্থানি সেনারা এবং তাদের দোসর, রাজাকারেরা যে কি নিষ্ঠুর ছিল তা আমরা যারা দেখেছি তারা ছাড়া আর কেউই বুঝতে পারবে না। বর্ণনা করতে চোখে জল এসে যায়! সেদিন এতো লোকের মৃত্যু হতো না যদি কিনা কিছু লোক পালিয়ে যেতে বাধা না দিত। অবশ্য এই দোষ তাদের নয়, যারা বাধা দিয়েছিল তারা ভেবেছিল পালাতে গেলে মৃত্যুর মুখে পড়বে হয়তো। কিন্তু পালাতে না পেরে আটকে পড়ে বহু লোক। ফলে তারা মৃত্যুবরণ করে।
সেদিন অল্প সময়ের মধ্যে একযোগে বহু মানুষকে পাকিস্তানি সেনারা হত্যা করে, আগুন দিয়ে পুড়িয়ে ছারখার করে ফেলে। ঘটনার পরে বেঁচে থাকা মানুষ নির্বাক হয়ে যায়! বিলের মধ্য থেকে বেয়ে আসা একটি খাল— খালটি শেষ হয় পূর্ব খলিশাখালী রাস্তা সংলগ্ন পাটক্ষেত পর্যন্ত গিয়ে। সেই খালের শেষ সীমান্তে স্থানীয় লোকজন এসে স্বজনের লাশ সনাক্ত করে। বিভিন্ন জায়গা— পাটক্ষেত, ধানক্ষেত থেকে লাশ উদ্ধার করে গণকবর দেওয়া হয়।
বিলের মধ্যে পড়ে থাকা অসংখ্য রেওয়ারিশ লাশ যা আনা সম্ভব হয়নি কারো পক্ষে। দিনে দিনে পঁচে গলে মিশে যায় মাটির সাথে। আজ স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর পরেও যদি ঐ বিলে মাটি খুঁড়ে সন্ধান করা হয় তবে মিলবে অসংখ্য মৃত মানুষের হাড়-গোড়। মানুষ ঐ বিলে যেতে আজও ভয় পায়। অথচ ওই বিলেই ১৯৭১ সালে সংগঠিত হয়েছিল নির্মম গণহত্যা! যা স্থানীয় মুরব্বীদের মুখে মুখে আজও শোভা পায় গল্প-কথায়।
স্বাধীনতার পর ভারত থেকে ফিরে আসা শহীদদের আত্মীয় স্বজনেরা বধ্যভূমিটি দেখে স্বজন হারানোর শোকে বিলাপ করত বেশ কিছু বছর পর্যন্ত। গরীবপুর থেকে খলিশাখালী গ্রামদুটির সংযোগ সড়কের মধ্যখানে যেখানে গণকবর দেওয়া হয় মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের, সেপথ দিয়ে চলাচল করতে ভয় পেত। সকলের মুখে মুখে ছিল একাত্তরের গণহত্যার গল্প, কিন্তু কোনো পত্রিকায় প্রকাশ পায়নি কোনোদিন।
স্বাধীনতার ছেচল্লিশ বছর পর ২০১৭ সালের ২৭মার্চ ‘দৈনিক সমকাল’ পত্রিকার প্রতিনিধি সাংবাদিক পঙ্কজ মণ্ডল প্রত্যক্ষদর্শীদের কাছ থেকে তথ্য নিয়ে “চিতলমারীর অরক্ষিত বধ্যভূমি” শিরোনামে দৈনিক সমকালে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেন । এর আগের দিন— ২৬মার্চ ২০১৭, ‘দৈনিক জনকণ্ঠ’ পত্রিকায় “চিতলমারীতে বধ্যভূমির সন্ধান” নামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়।
স্থানীয় লোকজন এবং প্রত্যক্ষদর্শীদের মুখ থেকে সেদিন গণহত্যার শিকার কতিপয় শহীদের নাম জানা সম্ভব হয়েছে: ১। গুরুপদ বৈরাগী (খলিশাখালী), ২। প্রমথ রাণা (খলিশাখালী), ৩। নির্মল রায় (খলিশাখালী), ৪। জিতেন মাঝি (খলিশাখালী), ৫। খগেন্দ্রনাথ মণ্ডল খোকা (খলিশাখালী), ৬। কন্টিয়া মাঝি, আদিত্য (খলিশাখালী), ৭। শীতল হীরা (খলিশাখালী), ৮। অনন্ত মাঝি (খলিশাখালী), ৯। ভদ্রকান্ত হীরা (খলিশাখালী), ১০। বাসুদেব হীরা (খলিশাখালী), ১১। নীল কমল হীরা (খলিশাখালী), ১২। ঠাকুর দাস মণ্ডল (খলিশাখালী), ১৩। যোগিন্দির মাঝি (খলিশাখালী), ১৪। সাহেব আলী (খড়মখালী), ১৫। সদাই ঘটক (খলিশাখালী), ১৬। মান্দার মল্লিক (খলিশাখালী), ১৭। কালাচাঁদ রায় (খলিশাখালী), ১৮। মনোহর সর্দার (উমাজুড়ী), ১৯। সুমন্ত মণ্ডল (সামন্তগাতী), ২০। রেণুকা মাঝি (খলিশাখালী), ২১। প্রমালা মণ্ডল (খলিশাখালী), ২২। বিদার সর্দার (খলিশাখালী), ২৩। বিমল কান্তি হীরা (খড়মখালী), ২৪। রাজদেব হীরা (খড়মখালী), ও ২৫। সিদ্দিক সরদার (খলিশাখালী)।
এলাকাবাসীর দাবি— দশমহল গণহত্যায় শহীদদের নাম পূর্ণাঙ্গভাবে প্রকাশ করতে হবে। বধ্যভূমিটি সরকারিভাবে সংরক্ষিত করতে হবে এবং স্থানীয় প্রশাসন এবং জনপ্রতিনিধিদের উদ্যোগে প্রতি বছর ২০ জুন তারিখটি যথাযোগ্য মর্যাদায় পালিত হতে হবে।
লেখক: ব্যাংকার