প্রিয় প্রজন্ম,
তোমরা আমার ভালোবাসা নিও। তোমরা লেখাপড়া কর, মানুষের মতো মানুষ হও। তোমরা সৎ ও দেশপ্রেমিক হও। মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জন বাঙালি জাতির বিভিন্ন গৌরবময় অর্জনের মধ্যে অন্যতম। তোমরা লেখাপড়ার ফাঁকে ফাঁকে সুযোগ সুবিধামতো মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস পড়বে। তাহলে বাঙালীদের বীরত্বগাঁথা জানতে পারবে।
আমরা ব্রিটিশদের শাসন শোষণের হাত থেকে মুক্ত হয়েছিলাম ১৯৪৭ সালে। ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট পাকিস্তান রাষ্ট্রের সৃষ্টি হয়েছিলো। ইসলাম ধর্ম ছিল দু’টি ভূখণ্ডে অধিকাংশ অধিবাসীর। দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তান মিলে পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্ম হয়েছিলো। পাকিস্তান রাষ্ট্রের দু’টি প্রদেশ ছিল। আমাদের অংশের নাম ছিলো পূর্ব পাকিস্তান। পাকিস্তান রাষ্ট্র সৃষ্টির পর থেকে শাসণ করত পশ্চিম পাকিস্তানি শাসক। তারা শাসনের নামে পূর্ব পাকিস্তানি বাঙালিদের বঞ্চিত, শোষণ, নির্যাতন ও নিপীড়ন করত। পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের অবস্থানগত দূরত্ব ছিল ১২০০ কিলোমিটারের অধিক। তারা আমাদের ন্যায্য অধিকার দিত না। চাকরি ও অন্যান্য সকল ক্ষেত্রে আমাদেরকে বঞ্চিত করত। তদানীন্তন বাঙালি নেতাগণ তাদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন সংগ্রাম ও আন্দোলন করেছেন। পশ্চিম পাকিস্তানি শাসক পূর্ব পাকিস্তানের সম্পদ দিয়ে পশ্চিম পাকিস্তানে কলকারখানা করত। পশ্চিম পাকিস্তানি শাসক ১৯৫২ সালে উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার উদ্যোগ নিয়েছিল। কিন্তু বাঙালিদের আন্দোলনের কারণে পারে নাই। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি বিহারী পাকিস্তানি শাসকের নির্দেশে পুলিশ বাঙালি ছাত্র মিছিলের উপর গুলি চালায়। বাংলা ভাষাকে রক্ষার জন্য সালাম, রফিক, শফিক, বরকত ও জব্বার সহ অনেক বাঙালি শহীদ হয়েছেন। প্রতিবছর ২১ ফেব্রুযারি ভাষা শহীদদের স্মরণে আমরা শহীদ দিবস পালন করতাম। বর্তমানে আমাদের শহীদ দিবস আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে পালন করি। শহীদ মিনার বাঙালিদের ভাষা আন্দোলনের শহীদদের স্মারক। পাকিস্তান রাষ্ট্রের সৃষ্টির পর হতে বিভিন্ন বাঙালি নেতার আন্দোলন সংগ্রামের পর জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে ১৯৪৮ থেকে ১৯৫২ সাল পর্যন্ত ভাষা আন্দোলন, ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্টের সাধারণ নির্বাচন, ১৯৫৮ সালে সামরিক আইন জারির বিরুদ্ধে আন্দোলন, ৫৯-৬১ সালে ছাত্র সমাজের হাত ধরে আইয়ুব বিরোধী আন্দোলন, ১৯৬২ সালে শিক্ষা সংকোচন নীতির বিরুদ্ধে শিক্ষা আন্দোলন ও ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের নিয়ে স্বাধীনতার লক্ষ্যে স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী পরিষদ বা নিউক্লিয়াস গঠন, ৬৪ সালে বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৬ দফা আন্দোলন, ৬৮ সালে আগরতলা মামলা, ৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থান প্রভৃতি আন্দোলন সংগ্রামের পর ১৯৭০ সালের ৭ ডিসেম্বর পশ্চিম পাকিস্তানি শাসক পাকিস্তানের সাধারণ নির্বাচন দিতে বাধ্য হয়। বাঙালিদের অধিকার আদায়ের আন্দোলন সংগ্রামের কারণে জাতির পিতাকে প্রায় ১৩ বছর কারাভোগ সহ বিভিন্ন অত্যাচার নির্যাতন সইতে হয়েছে। ১৯৭০-এর সাধারণ নির্বাচনে পূর্ব পাকিস্তানের ১৬২টি আসনের ১৬০ টিতে গণভোটে বিজয়ী হয় তৎকালীন বাঙালিদের অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ। আওয়ামী লীগ পূর্ব পাকিস্তানের সংরক্ষিত আরো ৭টি মহিলা আসনের অধিকারী হয়। মোট ১৬৭ টি জাতীয় পরিষদের আসনের অধিকারী হয়ে আওয়ামী লীগ পাকিস্তান জাতীয় সংসদে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে।
১৭ ডিসেম্বর ’৭০ প্রাদেশিক পরিষদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ২৯৮ আসনে বিজয়ী হয়েছিলো। যে স্বপ্ন নিয়ে জাতির পিতা বিভিন্ন আন্দোলন সংগ্রাম করছেন, প্রায় দীর্ঘ ১৩টি বছর কারাগারের অন্ধকার প্রকোষ্ঠে কাটিয়েছেন, বিভিন্ন অত্যাচার নিপীড়ণের শিকার হয়েছেন, তার ত্যাগ, আন্দোলন ও সংগ্রামের ফলশ্রুতিতে বিজয় অর্জিত হয়। জনগন স্বতঃস্ফুর্তভাবে জাতির পিতাকে ম্যান্ডেট দিয়েছিলো। তখন দেশের শাসক ছিলেন সামরিক প্রেসিডেন্ট সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল ইয়াহিয়া খান। বাঙালিদের বিজয়ে বিহারী পশ্চিম পাকিস্তানি শাসক সন্তুষ্ট ছিলেন না। তিনি বাঙালিদের হাতে ক্ষমতা দিতে ইচ্ছুক ছিলেন না। তিনি ভূট্টো ও অন্যান্যদের সাথে নিয়ে ষড়যন্ত্র শুরু করেন। সাধারণ নির্বাচনের ফলাফল বাতিলের পরিকল্পনা করেন। ২২ ফেব্রুয়ারি ’৭১ পশ্চিম পাকিস্তানি জেনারেলদের এক বৈঠকে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান গোপন নির্দেশ দেন— তিন মিলিয়ন আওয়ামী লীগ নেতাকর্মী ও তাদের সমর্থকদের হত্যা করুন, তাহলে বাকিরা আমাদের বশ্যতা স্বীকার করবে। তার ধারণা ছিলো— নির্যাতন করে ত্রিশ লাখ বাঙালি হত্যা করলেই আন্দোলন থেমে যাবে।
কালক্ষেপণ করে ষড়যন্ত্র বাস্তবায়নের জন্য ১৩ ফেব্রুয়ারি ’৭১ ইয়াহিয়া খান মিথ্যা আশ্বাস দিলেন ৩ মার্চ ’৭১ ঢাকায় জাতীয় পরিষদের অধিবেশন হবে। ১৬ ফেব্রুয়ারি বঙ্গবন্ধুকে পার্লামেন্টারি নেতা নির্বাচন করা হয়। ১ মার্চ ইয়াহিয়া খান দুপুরে জাতির উদ্দেশে দেওয়া বেতার ভাষণে ৩ মার্চ আহুত জাতীয় পরিষদের অধিবেশন বেআইনীভাবে অনির্দিষ্ট কালের জন্য স্থগিত ঘোষণা করেন।
বেতার ভাষণ শুনে বঙ্গবন্ধু অসহযোগ আন্দোলনের ঘোষণা দিলেন। ২ মার্চ ছাত্রলীগের উদ্যোগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বটমূলে বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা উত্তোলন করা হয়। সারা দেশের মানুষ বাঁশের লাঠি, কাঠের বৈঠা, দেশী ও অন্যান্য অস্ত্র হাতে রাস্তায় নেমে আসে। পাকিস্তানি পতাকা পোড়ানো শুরু হয়। বঙ্গবন্ধু ৩ মার্চ জাতীয় শোক দিবস হিসেবে পালনের নির্দেশ দিলেন। জাতির পিতার নির্দেশে ২ মার্চ ঢাকায় এবং ৩ থেকে ৬ মার্চ সারা দেশব্যাপী ভোর ৬ টা থেকে বেলা ২টা পর্যন্ত স্বতঃস্ফুর্ত হরতাল পালন করা হয়।
৩ মার্চ পল্টন ময়দানে ছাত্রলীগের জনসভায় জাতীয় সংগীত হিসেবে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের “আমার সোনার বাংলা…” গানটি নির্বাচিত হয়। বঙ্গবন্ধুকে বাংলাদেশের সর্বাধিনায়ক ও জাতির পিতা ঘোষণা করা হয়। বঙ্গবন্ধুর উপস্থিতিতে স্বাধীন বাংলাদেশের ইশতেহার পাঠ এবং কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠন করা হয়। স্বাধীনতার ইশতেহার পাঠ অনুষ্ঠানে জাতির পিতা বলেন, “… আজ স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ ঘোষণা করা হয়। ৫৮ হাজার ৫০৬ বর্গমাইল ভৌগলিক এলাকার সাড়ে সাত কোটি মানুষের আবাসভূমির স্বাধীন সার্বভৌম এ রাষ্ট্রের নাম বাংলাদেশ।” বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা উড়ানো হয়। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের ষড়যন্ত্র জাতির পিতা বুঝতে পারলেন। ৭ মার্চ ’৭১ সোহরাওয়ার্দী উদ্যান (তদানীন্তন রেসকোর্স ময়দানে)-এ ১৯ মিনিটের এক ঐতিহাসিক ভাষণে জাতির পিতা বললেন, “… এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।
জাতির পিতা বুঝতে পেরেছিলেন যে, যেকোনো সময় সামরিক জান্তা তাকে গ্রেফতার করতে পারে। তাই তিনি পরর্বতী করণীয় সর্ম্পকেও দিক নিদের্শনা দিলেন। ৭ মার্চ সরাসরি স্বাধীনতা ঘোষণা দিলে বঙ্গবন্ধুকে বিছিন্নতাবাদী হিসেবে চিহ্নিত করত। উক্ত সভায় দশ লক্ষাধিক জন সমাবেশ ঘটেছিল। স্বাধীনতা ঘোষণা দিলে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী একযোগে সবাইকে হত্যা করতে পারতো। তাই তিনি সরাসরি স্বাধীনতা ঘোষণা দিলেন না। পরোক্ষভাবে স্বাধীনতা ঘোষণা দিলেন। সকল বাঙালি জাতির পিতার স্বাধীনতা ঘোষণার কথা বুঝতে পারলেন।
১৫ মার্চ নতুন কুট-কর্ম-কৌশল নিয়ে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ঢাকায় আসেন। ১৬ মার্চ থেকে কালক্ষেপণ ও ষড়যন্ত্র বাস্তবায়নের প্রস্তুতিমূলক কার্যাদি করার জন্য সামরিক প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান প্রহসনমূলক আলোচনা শুরু করেন। গোপনে গোপনে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে সৈন্য ও গোলাবারুদ আনতে থাকেন। পূর্ব পাকিস্তানের সামরিক প্রশাসক লেঃ জেনারেল টিক্কা খান ও অন্যদের দিয়ে বাঙালি নিধনযজ্ঞ চালানোর জন্য “অপারেশন সার্চলাইট” পরিকল্পনা চূড়ান্ত করেন। ২৫ মার্চ বিকাল পৌনে ৬টায় আলোচনা শেষ না করে “অপারেশন সার্চ লাইট” নামক বাঙালি নিধনযজ্ঞ চালানোর নির্দেশ দিয়ে প্রেসিডেন্ট বিশেষ বিমানযোগে গোপনে পশ্চিম পাকিস্তানে চলে যান।
পাকিস্তানি বাহিনী বাঙালি সৈনিক, ইপিআর ও অন্যান্যদের নিরস্ত্র করে আটক করতে থাকলো। অবস্থা বুঝে বাঙালি সৈনিক ও ইপিআর— অনেকে অস্ত্র নিয়ে, কেউ কেউ জীবন বাঁচানোর জন্য খালি হাতে পালিয়ে এলেন। ২৫ মার্চ ’৭১ রাত সাড়ে ১১টার পর টিক্কা খান মর্টার শেল, কামান ও অন্যান্য ভারী অস্ত্র নিয়ে “অপারেশন সার্চ লাইট” শুরু করে। তারা একযোগে পিলখানা ইপিআর হেড কোয়ার্টার, রাজারবাগ পুলিশ লাইন, জগন্নাথ হল, ইকবাল হল (বর্তমানে সাজেন্ট জহরুল হক হল), ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যান্য হল ও ঢাকার অন্যান্য স্থানে আক্রমণ করে। ঢাকা সহ অন্যান্য শহরে গণহত্যা শুরু করে। নিরীহ, ঘুমন্ত বাঙালিদের ওপর নির্বিচারে গুলি চালায়। পাখির মতো মানুষ হত্যা করে। বস্তি ও অন্যান্য স্থানে আগুন ধরিয়ে দেয়। পাকিস্তানি সামরিক শাসক বাঙালিদের ওপর মুক্তিযুদ্ধ চাপিয়ে দিয়েছিলো।
দেশের সার্বিক অবস্থা দেখে ও বুঝে ২৬ মার্চ ’৭১ প্রথম প্রহরে রাত ১২.২০-এর পর ধানমন্ডিস্থ ৩২ নম্বর নিজ বাড়িতে উপস্থিত নেতা কর্মীদের সম্মুখে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন এবং শেষবাণী প্রদান করেন। জাতির পিতার স্বাধীনতা ঘোষণার বার্তা ই.পি.আর-এর ট্রন্সমিটারে মাধ্যমে মগবাজারস্থ টেলিগ্রাম অফিসের ওয়্যারলেসের মাধ্যমে ও বলধা গার্ডেনে স্থাপিত অস্থায়ী ওয়্যারলেসের মাধ্যমে চট্রগ্রামসহ দেশের সর্বত্র প্রেরণ করা হয়। জাতির পিতার স্বাধীনতা ঘোষণার ওয়্যারলেসের মেসেজ আমাদের সিরাজগঞ্জ জেলার শাহজাদপুর থানার তদানীন্তন ওসি জনাব মো: আব্দুল হামিদ ২৬ মার্চ সকাল ৮.৩০ মিনিটে পেয়েছিলেন।
২৬ মার্চ বিকালে পাকিস্তানের সামরিক প্রেসিডন্ট জাতির পিতা কর্তৃক স্বাধীনতা ঘোষণার কথা জানতে পেরে এক বেতার ভাষণে আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ এবং স্বাধীনতা ঘোষণা করার কারণে জাতির পিতাকে দেশদ্রোহী হিসাবে বিচারের ঘোষণা দিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন, “… Sheik Mujib is a traitor and this time he and his party Awami league shall not go unpunished …” আমাদের সশস্ত্র বাহিনীর বাঙালি সদস্যরা, ইপিআর, আনসার ও ছাত্র জনতা প্রতিরোধ যুদ্ধ শুরু করেছিলো। কসাই টিক্কা খান বলেছিলো, ম্যায়নে শেখ ছাবকা Indepdence করনা এলান আপনাকে কানসে শোনাহুয়া … arrest him, রাত ১.১০টার পর জাতির পিতাকে গ্রেফতার করে পাকিস্তানি দখলদার বাহিনী ঢাকা সেনা নিবাসে নিয়ে যায়। পরের দিন জাতির পিতাকে পশ্চিম পাকিস্তানে নিয়ে যাওয়া হয়। জাতির পিতাকে পশ্চিম পাকিস্তানের কারাগারে রাখা হয়।
৭ সেপ্টম্বর ’৭১ হতে ৩ ডিসেম্বর পর্যন্ত প্রহসনমূলক বিচারের মাধ্যমে পাকিস্তানি জান্তা ৪ ডিসেম্বর ’৭১ জাতির পিতার মৃত্যুদণ্ডের আদেশ দেয়। ৩ ডিসেম্বর ’৭১ বাঙালিদের মুক্তিযুদ্ধকে ভিন্নখাতে নেওয়ার জন্য পাকিস্তান ভারতের বিমান ঘাটিতে আক্রমন করে। তখন ভারত পাকিস্তানের ওপর পাল্টা আক্রমন করে এবং বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে ভারতের সৈন্য যোগ দেয়। সে দিন থেকে মুক্তিযুদ্ধ ভারত পাকিস্তান যুদ্ধেও পরিণত হয়। ৬ ডিসেম্বর ’৭১ প্রথমে ভারত, তারপর ভুটান বাংলাদেশকে স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেয়।
পরাজয় নিশ্চিত জেনেও আমাদের দেশের স্বাধীনতা বিরোধীরা বাঙালিদের মেধাশূন্য করতে বুদ্ধিজীবী হত্যার নীল নকশা তৈরী করে। আলবদর বাহিনী নেতৃত্বে ১০ ডিসেম্বর থেকে ১৪ ডিসেম্বর পর্যন্ত তালিকা ধরে ধরে বাড়ি বাড়ি গিয়ে বুদ্ধিজীবীদের ধরে এনে অমানবীয় নির্যাতন করে হত্যা করে। ১৪ ডিসেম্বর ’৭১, কিছু বুদ্ধিজীবীর লাশ রায়ের বাজার বধ্যভূমি, মিরপুর বধ্যভূমি ও অন্যান্য স্থানে পাওয়া গিয়েছিলো। ২৬ মার্চ ’৭১, চট্টগ্রামের আগ্রাবাদ বেতার কেন্দ্র থেকে দুপুর ১.১০মি.-এর পর জাতির পিতার স্বাধীনতা ঘোষণার বার্তাটি পাঠ করেন চট্টগ্রামের আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক এম.এ হান্নান।
২৭মার্চ সন্ধ্যায় কালুরঘাটস্থ স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে বঙ্গবন্ধুর পক্ষে স্বাধীনতার বার্তা পাঠ করেন তদানীন্তন মেজর জিয়াউর রহমান। তখন সারা দেশে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী সারাদেশকে তাদের নিয়ন্ত্রণে নেওয়ার কার্যক্রম শুরু করে। মো: নুরুল আমিন ও অধ্যাপক গোলাম আযম সহ ইসলামী দলগুলোর ১২ জন নেতা টিক্কা খানের প্রতিনিধির সাথে সাক্ষাত করে। টিক্কা খানের প্রতিনিধি স্বাধীনতা বিরোধীদের এই বলে প্রলোভন দেয় যে, পূর্ব পাকিস্তান সামরিক প্রশাসক জনাব টিক্কা খান বলেছেন, “৭ ডিসেম্বর ’৭০ এর সাধারণ নির্বাচন বাতিল করা হবে। ২৬ মার্চ স্বাধীনতা ঘোষণা করার কারনে প্রেসিডেন্ট আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ ও শেখ মুজিব কে দেশদ্রোহী হিসেবে ঘোষণা করেছেন। প্রেসিডেন্টের সাথে আমার কথা হয়েছে। দেশদ্রোহী হিসেবে শেখ মুজিবরের বিরুদ্ধে মামলা করে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হবে। নির্যাতন, ধর্ষণ ও জ্বালাও পোড়াও করে আওয়ামী লীগ নেতা কর্মী ও ভারতের দালাল হিন্দুদেরকে শেষ করে দেওয়া হবে। আপনারা আমাদের সহযোগিতা করুন। পুনরায় সাধারণ নির্বাচন দিয়ে ইসলামী দলগুলোর হাতে পূর্ব পাকিস্তানের ক্ষমতা দেওয়া হবে।”
টিক্কা খানের পক্ষের কথার প্রলোভনে ইসলামী দলগুলোর অধিকাংশ নেতারা পাকিস্তানি সৈন্যদের সহযোগিতা করার অঙ্গীকার করে। স্বাধীনতা বিরোধীরা পিচ কমিটি, রাজাকার, আলবদর, আলশামস্ ও অন্যান্য বাহিনী করে পাকিস্তানি বাহিনীর সাথে যোগ দেয়। পাকিস্তানি বাহিনী এবং তাদের এদেশীয় দোসরদের নৃশংস গণহত্যার প্রেক্ষিতে জীবনের ভয়ে আওয়ামী লীগ নেতাকর্মী ও এ দেশের অধিকাংশ হিন্দুরা ভারতে আশ্রয় নিতে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ঘর ছাড়ে।
১০ এপ্রিল ’৭১, ভারতে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ৭ ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচনে নির্বাচিত এম. এন .এ. ও. এম.পি.-দের নিয়ে গনপরিষদ করে বাংলাদেশ সরকার গঠন করে। ১৭ এপ্রিল ’৭১, কুষ্টিয়া জেলার মেহেরপুর মহকুমার (বর্তমানে জেলা) বৈদ্যনাথ তলায় বাংলাদেশ সরকার শপথ গ্রহণ করে। বৈদ্যনাথ তলার নামকরণ করা হয় মুজিবনগর।
মহান মুক্তিযুদ্ধ কী, কীভাবে যুদ্ধ করতে হবে, কতদিনে দেশ স্বাধীন হবে, একটি প্রশিক্ষিত ও আধুনিক অস্ত্রসস্ত্রে সজ্জিত পেশাদার হানাদার বাহিনীর সাথে যুদ্ধ করে বিজয় অর্জন সম্ভব কিনা, ভারত বর্হিবিশ্বের চাপে বাংলাদেশকে সহযোগিতা করতে পারবে কী না ইত্যাদি বোঝার বয়স তখন আমার হয় নাই। আমি তখন রতন কান্দি নিম্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের অষ্টম শ্রেণীর ছাত্র। ২৫ মার্চ রাতে “ অপারেশন সার্চ লাইট”-এর নৃশংসতা ও পরবর্তীতে পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর গণহত্যা, লুণ্ঠন, জ্বালাও পোড়াও , নির্যাতন, নিপীড়ন ও ধর্ষণ সহ বিভিন্ন মানবতাবিরোধী কাজের কথা সকলের আলোচনা ও স্থানীয় প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য এ্যাড. জনাব মো: আব্দুর রহমান স্যারের কাছ থেকে জাতির পিতার স্বাধীনতা ঘোষণা, মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের আহ্বান ও অন্যান্য সব কথা শুনে জাতির ক্রান্তিকালে আমি মহান মুক্তিযুদ্ধে জীবনপণ অংশগ্রহণ করেছিলাম।
আমি মুক্তিযুদ্ধে তিনটি ‘হিট এন্ড রান’ কার্যক্রম করেছি। একটি পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও রাজাকারদের বিরুদ্ধে সম্মুখ যুদ্ধ করার জন্য এ্যাম্বুস করেছি। আমরা বেলকুচি থানা আক্রমণ যুদ্ধ, কালিয়া হরিপুর রেলওয়ে ব্রিজ সংলগ্ন রাজাকার ক্যাম্প এ্যাম্বুস, কল্যানপুর ও শাহজাদপুর থানার ধীতপুর নামক স্থানে পাকিস্তানি হানাদার ও রাজাকারদের বিরুদ্ধে ভয়াবহ সম্মুখ যুদ্ধ করে বিজয়ী হয়েছি।
তোমরা লেখাপড়ার ফাঁকে ফাঁকে মহান মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস পড়বে। আমরা চাই তোমরা উচ্চশিক্ষিত এবং মানবীয় গুণসম্পন্ন দেশপ্রেমিক মানুষ হিসেবে গড়ে ওঠো। এ দেশ তোমাদের হাতে দিয়ে গেলাম। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস পড়লে তোমরা সব জানতে পারবে। আমার অনুরোধ— “তোমরা মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাসটি জেনে নিও। নিজের কথা ও কাজে সৎ থেকো। মনে রেখো— আমরা রক্তে পাওয়া দেশ ও দেশের পতাকা তোমাদের কাছে দিয়ে যাচ্ছি। তোমরা দেশকে মায়ের মতো ভালোবাসবে। তোমরাই পারবে দেশটাকে উন্নতির শিখরে নিয়ে যেতে। সবসময় দেশ ও দেশের মানুষের জন্য কিছু করার চেষ্টা করো। মনে রেখ নিজের কাজটা সততার মাধ্যমে সম্পন্ন করাই সবচেয়ে বড় দেশে প্রেম। জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে তোমরা আত্ম বিশ্বাসী ও ধৈর্যশীল থেকো। দেশটা তোমার শেকড়। সেই শেকড়টাকে তোমরা ভূলে যেও না। আমরা যে স্বপ্ন নিয়ে দেশকে হানাদার মুক্ত করেছি তোমরা সেই সোনার বাংলাদেশ গড়ে তুলবে।
ইতি,
তোমাদের দেবেশ চন্দ্র সান্যাল