প্রেসিডেন্সি কলেজ, বর্তমানে প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার স্বপ্ন দেখেননি বা দেখেন না পশ্চিম বাংলায় এমন ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা সম্ভবত কমই আছে। আমার ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম ঘটেনি— হিন্দু স্কুলে পড়াকালীন যখনই সময় পেয়েছি চতুর্থতলার প্রসিডেন্সির দিকে জানালায় বসে স্বপ্ন দেখছি প্রেসিডেন্সিয়ান হওয়ার। তার একটি প্রধান কারণ হয়তো প্রেসিডেন্সি কলেজের ইতিহাস। ভারতবর্ষের একমাত্র শিক্ষা প্রতিষ্ঠান যার শিক্ষার্থীদের মুকুটে আছে নোবেল প্রাইজ এবং অস্কার। তবে প্রেসিডেন্সি কলেজের প্রাপ্তির লিস্টটি আরো অনেক বড়ো। হিন্দু স্কুলের মূল ফটক দিয়ে ঢুকেই বিরাট একটা কৃতীদের নাম ফলক বরাবরই আমায় উদ্বুদ্ধ করতো, তবে সেভাবে প্রেসিডেন্সির ইতিহাস নিয়ে খুব একটা ঘাটাঘাটির সুযোগ হয়নি। এখন বাংলাদেশ নিয়ে গবেষণার সুবাদে আমি বেশ কিছু নামের সঙ্গে পরিচিত হই যারা একসময় প্রেসিডেন্সি কলেজের শিক্ষার্থী ছিলেন। সেখান থেকেই ভাবনায় আসে এই লেখার বিষয়টি। এই লেখার মধ্যে প্রধানত আমি বেশ কিছু প্রখ্যাত মানুষের কথা তুলে ধরতে চাই যারা প্রেসিডেন্সি কলেজের শিক্ষার্থী ছিলেন এবং পরবর্তীতে পূর্ব বাংলা, মুক্তিযুদ্ধপরবর্তী স্বাধীন বাংলাদেশে গুরুত্বপূর্ন পদে বহাল ছিলেন। আমি এই বিষয়ে একটি ধারাবাহিক লিখতে চাই। পরবর্তীকালে যদি সুযোগ ঘটে তাহলে গবেষণাধর্মী একটি পুস্তক রচনারও ইচ্ছে আছে।
আজকের এই লেখায় আমি দীপক বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথা বলবো। উদারপন্থী স্বাধীনচেতা দীপক ছিলেন প্রেসিডেন্সি কলেজের ইংরেজি বিভাগের ছাত্র। কলকাতা প্রেস থেকে প্রকাশিত “বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ : কলকাতার সাংবাদিকতা ও প্রেসক্লাব কলকাতা” শীর্ষক গ্রন্থ থেকে জানা যায় দীপক বন্দ্যোপাধ্যায় এবং সুরজিৎ ঘোষাল পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের ওপর অত্যাচারের প্রকৃত বিবরণ সংগ্রহ করার জন্য সম্পূর্ণ নিজেরদের প্রচেষ্টায় বনগাঁ সীমান্ত দিয়ে খুলনা এবং যশোর হয়ে ঢাকার উদ্যেশে বেরিয়ে পড়েন ১৯৭০ সালে ২৩ মার্চ। বাংলাদেশে ঢোকার পর বিভিন্ন জেলা হয়ে তারা ঢাকায় পৌঁছান এবং সেখান থেকে কুমিল্লা হয়ে আগরতলা। তখনকার আগরতলার যুগান্তর প্রতিনিধি এবং হিন্দুস্তান সমাচারের প্রতিনিধি অনিল ভট্টাচার্য্য এবং কেশব চন্দ্র সুরের বয়ান থেকে জানা যায়— তারা আবার কলকাতায় ফেরার উদ্যেশে কুমিল্লা থেকে ঢাকা হয়ে ফেরার চেষ্টা করেন, কিন্তু ততদিনে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর হামলা অনেক জোরদার হয়েছে। পরবর্তীতে তাদের আর খোঁজ পাওয়া যায়নি।
এর পরবর্তী ঘটনার একটা রূপরেখা পাওয়া যায় কলকাতার প্রেসক্লাব থেকে প্রকাশিত “বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে কলকাতার দুই শহীদ সাংবাদিক : শ্রদ্ধা এবং স্মরণ” নামক একটি ছোট্ট পুস্তিকায়। জানা যায়— লোকসভায় এবং রাজ্যসভায় এই নিখোঁজ সাংবাদিকদের সম্পর্কে আলোচনা হয়েছিলো, কিন্তু বেশিকিছু জানা যায়নি। তবে এই পুস্তকে মইনুল হুদা নামক জনৈক ব্যক্তির বয়ান থেকে জানা যায়— দীপক এবং সুরজিতের সঙ্গে মইনুল হুদার পরিচয় হয়েছিলো সোনামুড়া পেরিয়ে এসে কুটেশ্বর গ্রামে। ১৯৭১ সালে ৩০ মার্চ দীপক-সুরজিৎ তার বাড়িতে আশ্রয় নেয় এবং পরের দিন তারা কুমিল্লা শহরে প্রবেশ করে। ওই সময় পূর্ব পাকিস্তানে কার্ফু চলছিলো এবং তারা তার মধ্যে ঘুরছিলো। সেখান থেকে তারা একটি বেকারির দোকান থেকে দুপুরের আহার করে একটি রিকশায় তিনজন ওঠে। তাদের গন্তব্য ছিলো ঢাকার চকবাজার। কিন্তু রাস্তায় তারা পাকিস্তানি আর্মির হাতে ধরা পড়ে। তাদের তিনজনকে দাঁড় করিয়ে জানতে চাওয়া হয় তারা মুসলমান কিনা। তারপর তাদের কলমা পড়ার নির্দেশ দেওয়া হয়। স্বাভাবিকভাবেই মইনুল পড়তে পারলেও দীপক এবং সুরজিৎ তা পারেনি। তখন মঈনুলকে ছেড়ে দিলেও দীপক এবং সুরজিৎকে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী আটক করে রাখে। পরের ঘটনা সম্পর্কে মঈনুল হুদা জানান— সেদিন রায়গঞ্জ ট্রাফিক মোড়ে ১৭জনকে লাইন দিয়ে দাঁড় করিয়েছিলো। এরমধ্যে দীপক এবং সুরজিৎ ছিলো একেবারে শেষে। এক এক করে পাকিস্তান আর্মি মাথা লক্ষ্য করে গুলি করতে থাকে। অন্য সবার মতো একই পরিণতি হয় দীপক এবং সুরজিতের। প্রথমে গুলি করা হয় দীপককে এবং তারপর সুরজিৎ। এভাবেই বাংলাদেশের প্রথম শহীদ সাংবাদিক হয়েছিলো দীপক ও সুরজিৎ। এভাবেই বাংলাদেশের মুক্তির সংগ্রামের সঙ্গে নাম জড়িয়ে গিয়েছিলো প্রেসিডেন্সি কলেজের। ইতোমধ্যে কলকাতা প্রেসক্লাব এই দুই সাহসী সাংবাদিকদের নামে স্মৃতিফলক বসিয়েছে।
চলবে …
লেখকঃ গবেষক, প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ