Headlines

বাঁচার জন্য মুসলিম হওয়ার পরও ১৯৭১ সালে পরিবারটিকে হত্যা করা হয়

১৯৭১

১০ অক্টোব রবিবার, ২২ শে আশ্বিন গভীর রাতে বাগেরহাট রাজাকার বাহিনীর অর্ধশতাধিক সদস্য সিরাজ মাষ্টারের নেতৃত্বে বৈটপুর হিন্দুপাড়ায় আক্রমণ চালায়। এই গ্রামের হরিশ গুহ ওরফে কালু গুহ ছিলেন একজন প্রভাবশালী ব্যক্তি। যুদ্ধের সময়ে আত্মরক্ষার কৌশল হিসেবে বাগেরহাট বাসাবাড়ির মওলানা সাহেবের নিকট গিয়ে আপন জ্ঞাতি গোষ্ঠীসহ কালেমা পড়ে মুসলমান হয়েছিলেন তারা সবাই। রাজাকার বাহিনীর একটি গ্রুপ এই নওমুসলিমদের প্রতি মোটেই খুশি ছিলো না। কেননা হিন্দুরা দেশ ছেড়ে চলে গেলেই তাদের সবচেয়ে বেশি লাভ হতো, তাতে তাদের জায়গা-জমি, সহায় সম্পত্তি সহজে দখল করা যেতো। কিন্তু হিন্দুরা মুসলমান হয়ে গেলে সেই সুযোগের পথ চিরতরে বন্ধ হয়ে যায়। অগত্যা সিরাজ মাষ্টারসহ কয়েকজন রাজাকার ঐ নওমুসলিমদের দুনিয়া থেকেই বিদায় করে দেওয়া কথা ভাবতে শুরু করে। রাত প্রায় তিনটার দিকে রাজাকার বাহিনীর সদস্যরা হরিশ গুহের বাড়িটা চারিদিক থেকে ঘিরে ফেলে নিজেদের মুক্তিযোদ্ধা পরিচয় দিয়ে হরিশ গুহ ও তার পুত্র প্রদীপ গুহ ওরফে নীলু গুহকে ডাকাডাকি করতে থাকে। প্রদীপ গুহ সিরাজ মাষ্টারকে দেখে বাড়ির ছাদের উপরে উঠে একটা গাছ বেয়ে নেমে যখন পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছিলেন, তখন রাজাকার বাহিনীর হাতে ধরা পড়ে যান। কিছুক্ষণের মধ্যেই রাজাকার বাহিনী দরজা ভেঙে বাড়ির মধ্যে ঢুকে হরিশ গুহ এবং তার ছোট ভাই গৌরপদ গুহকে ধরে বাইরে নিয়ে আসে। রাজাকাররা একইভাবে পাশের বাড়ির থেকে বোবা একটি কাজের লোকসহ সুশীল মজুমদারকেও ধরে আনে। এরপর একদল নওমুসলিমদের জবাই করার কাজে ব্যস্ত হয় এবং অন্যদল লুটপাটে মনোনিবেশ করে।
কবি আবুবকর সিদ্দিক এই হত্যাকাণ্ডের পরেরদিন সকাল বেলায় হরিশ গুহের বাড়ি যান। সেই বর্ণনা তার লেখায়- “প্রথম স্পটে গৌরদা অর্থাৎ হরিশ গুহর ছোটো ভাই শুয়ে আছেন রাস্তার উপর আড়াআড়ি। গলা কটা। দু’ফাক। চোখ শাদা ফ্যাকাশে। তার কোমরের কাছে পড়ে আছে হরিশ গুহর যুবক পুত্র নীলুর গলাকাটা লাশ। কিছু দূর গিয়ে গদা মালোর বাড়ির পিছনে রাস্তা জুড়ে সুশীল মজুমদার ও তার বাড়ির বোবা কাজের ছেলেটা যার সঙ্গে আমি প্রায়ই ক্যারাম খেলতাম গ্রামে এলে। দুজনেরই গলা কাটা। সবচেয়ে ভয়াবহ ট্র্যাজেডি অপেক্ষা করছিলো আরো কয়েকশো গজ এগিয়ে মিত্তিরদের বাড়ির সামনেকার খোয়া ওঠা রাস্তায়। হরিশ গুহর লাশ চিত হয়ে পড়ে আছে। তার চিবুকের নিচ দিয়ে মোলায়েম করে কেটে দুফাঁক করা। রক্ত ঝরে ঝরে কাটা মাংস রবারের মত ফ্যাকাশে। শাদা মনি বের করা চোখ। গলাও ফাক হয়ে আছে। কিন্তু মাথার খুলির উপরের চাড়া নেই। তচনচ ঘিলু। কিছুটা হলুদ ঘিয়েরঙা ঘিলু পাশের কচুপাতার সবুজ চাতালে। আর বেশ কিছুটা দূরে খুলির চাড়াটা চুলসুদ্ধ ছিটকে পড়ে আছে লাল খোয়ার উপর।”
স্থানীয় বাসিন্দা জব্বার শেখ এ প্রসঙ্গে বললেন, “মুসলিম হল্লো ওনারা, মানে পরিবার সহই মুসলিম হল্লো, খতনা দেওয়া দেয়িও করিল্লো, নামাজ টামাজও পড়েছে, গরু বাছুরও খাইছে। কিন্তু দেশ স্বাধীন হওয়ার কিছু আগে রাত্তিরে মারে থুয়ে যায়।”
এ প্রসঙ্গে তখন সদ্য বিবাহীত খাদিজা বেগম বলেন, “দিপু ঐদিন মাছ মারে নিয়ে আল্লো। আমাদের বাড়িতে ছিল। আমাদের পুকুরে গোসল করে ও বাড়ি চলে গেল্লো। আমার স্বামী নিষেধ করিল্লো বাড়ি যাতে না যায়। কারণ, নদীর ওদিকে গোলাগুলি হতিল্লো তাই। আমার বিয়ে তহন কেবল ছয় মাস হবে। ওরা বাঁচার জন্য মুসলিম হইছে, গরুর গোস খাইছে, আমি রান্না করে দিছি। মুসলিম হওয়ার পরও মারলো, কারণ, রাজাকাররা ভাবছিল মারে ফেলালি ওগো সম্পত্তি দখল দিতি পারবে। বাগেরহাটেও ওদের এট্টা বাড়ি ছিল।”


[তাহমীনা বেগমের (মুসলিম নাম, পূর্বে নাম ছিল দিপালী রাণী গুহ) নিচের এই জবানবন্দি মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস থেকে নেওয়া]

তাহমীনা বেগম (দিপালী)
গ্রাম- বৈটপুর
ডাকঘর ও থানা- বাগেরহাট
জেলা-খুলনা

২৪ শে এপ্রিল পাকসেনারা কাড়পাড়া হয়ে বাগেরহাট আসে। এসেই কাড়াপাড় এলাকাতেই ১০০ উপরে লোককে হত্যা করে। নাগেরবাজার তেলপট্টি ইত্যাদি এলাকা আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেওয়া শুরু করে এবং বলে দেয় লুট করার জন্য, মুসলমানের অধিকাংশ ঘরবাড়ী সব লুট করা শুরু করে।
মে মাসে এখানে শান্তি কমিটি সেই সঙ্গে রাজাকার বাহিনী গঠন হয় পরবর্তীকালে রজব আলী ফকির শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান নিযুক্ত হয়। সমগ্র বাগেরহাট এলাকাতে পাকসেনার চাইতে রাজাকাররাই অত্যাচার চালিয়েছে বেশী।
শ্রাবণ মাসের শেষের দিকে বাগেরহাট শহর এলাকাতে যত হিন্দু ছিল কিছু হত্যা বাদে সবাইকে মুসলমান ধর্মে দীক্ষিত করে। এরপর গ্রামের দিতে হাত বাড়ায়। গ্রামকে গ্রাম ধরে সবাইকে মুসলমান করতে থাকে।
আমি আমার স্বামী, ছেলেমেয়ে, বাবা, মা, কাকা, কাকীমা তাদের ছেলেমেয়ে সবাই ইসলাম ধর্মে দিক্ষা নিই। কিন্তু রাজাকাররা এর পরেও অত্যাচার করতে ছাড়েনি। এরপরও অসংখ্যা লোককে হত্য করেছে।
২২ শে আশ্বিন রাত তিনটার দিকে ৫০/৬০ জন রাজাকার আমাদের বাড়ী ঘিরে ফেলে। প্রথমে তারা মুক্তিবাহিনী বলে পরিচয় দিয়ে থাকতে চায় রাতের মত। অনেক অনুনয়-বিনয় করে। প্রথমে আমার ভাই প্রদীপ গুহ দেখেই চিনেছিল তারা রাজাকার। তাই সে ছাদ দিয়ে গাছ বেয়ে পিছনে নামবার চেষ্টা করেছে। উপর থেকে নিচে নামলেই রাজাকাররা ধরে ফেলে। ওকে কিছু দুর নিয়ে গিয়ে বেয়োনেট দিয়ে গলা কেটে হত্যা করে। তারপর বাবা কাকা এবং পাশের বাড়ীর তিনজনকে কিছু দুর নিয়ে গিয়ে সিরাজ মাষ্টার এবং তার দল গুলি করে মাথা সব উড়িয়ে দেয়। সকালবেলা আমরা সেসব লাশ উদ্ধার করি। হত্যা করে বাড়ীঘর লুট করে সব নিয়ে চলে যায়। আমরা যারা বেঁচে ছিলাম বাগেরহাট শহরে চলে আসি। বাড়ীতে কেবল একজন কৃষাণ এবং আমার ৭০ বছরের বৃদ্ধা দিদিমাকে রেখে আসি।
কার্ত্তিক মাসের ১২/১৩ তারিখ হবে। রাজাকাররা আবার যায় আমাদের গ্রামে। দড়াটানা নদীর ওপার থেকে মুক্তিবাহিনী গোলাগুলি করতো। তাই রজব আলী অর্ডার দেয় সমস্ত এলাকা ঘরবাড়ী ভেঙ্গে ধ্বংস করে গাছপালা পরিস্কার করে ফেলার জন্য। ঐদিন আমাদের বাড়ীতে ঢোকে এবং দিদিমাকে লেপকাঁথা দিয়ে জড়িয়ে কেরোসিন তেল ঢেলে দিয়ে পুড়িয়ে হত্যা করে। আগুন দিয়ে দিদিমা আমার কাকার নাম ধরে বার বার চিৎকার করেছিলেন। শেষ পর্যন্ত সমস্ত এলাকা পুড়িয়ে ধ্বংস করে। ভোলা বোসকে নৃশংসভাবে হত্যা করে। রাধা বল্লভ গ্রামে মেয়েদের রাজাকাররা ধরে নিয়ে আসে। রাজাকাররা সারারাত পাশবিক অত্যাচার চালিয়ে দিনের বেলা গুলি করে হত্যা করে রাস্তায় ফেলে রাখে। বলরাম সাহাকে রাজাকাররা গুলি করে হত্যা করে। তার বিরাট গদির উপরে রজব আলী বসত, চারিদিকে রাজাকার ঘিরে থাকতো। ওখানে একটি ঘরে লোকদের জবাই করতো।
প্রত্যেকদিন ১০টি লোক যোগাড় করতেই হতো, ১০ টি করে জবাই করতোই। লোক না পারলে যেভাবেই হোক, ফকির হোক, এনে দিতেই হতো। আমি একদিন এক লোকের সুপারিশ করতে গিয়ে দেখলাম ঘরের ভিতর চাপ চাপ রক্ত পড়েছে। মদনের মাঠ ওয়াপদা রেষ্ট হাউসে একটি কক্ষে অসংখ্য লোককে জবাই করেছে। খাদ্দার গ্রামে এক বাড়ী থেকে সবাই ধরে এনে হত্যা করে। ডাক বাংলো ঘাটে প্রত্যহ অসংখ্য লোককে জবাই করেছে বেয়োনেট দিয়ে।
এক বৃদ্ধ রামদা দিয়ে অসংখ্য লোককে কেটেছে। সে পিঠ সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারতো না। লোক ধরে বলতো ‘বাবা নীচু হও তা নইলে কাটতে আমার কষ্ট হয়। তাড়াতাড়ি বসে পড়ে তোমাদের কষ্টও কম হবে, আমারও কষ্ট কম হবে।’
ইসহাক মিয়ার বাড়ীতে অনেক মেয়ে আশ্রয় নিয়েছিল। তা সত্ত্বেও কেউ রেহাই পায়নি। সমস্ত এলাকাতে সন্ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছিলো।
গ্রাম গ্রামাস্তর থেকে ব্যাপকভাবে হিন্দু মেয়ে ধরে পাকসেনাদের হাতে তুলে দিতো রাজাকাররা। এছাড়া রাজাকাররা গ্রামে গ্রামে ঢুকে অধিকাংশ মেয়ের উপর পাশবিক অত্যাচার চালিয়েছে।
বাগেরহাট থানার মীর্জাপুর গ্রাম এবং সারাগ্রামে বহু মেয়ে অপমাণিত হয়ে আতœহত্যা করেছে বিষপানে কেউ বা গলায় দড়ি দিয়ে।
রাজাকার, আল-বদর এদের মানুষ চরমভাবে ঘৃণা করতো। আমার মনে হয় সমস্ত বাংলাদেশে রাজাকাররা এমন ভাবে সন্ত্রাস আর নৃশংস অত্যাচার কোথাও চালায়নি। নদীর ঘাটে দড়ি বাঁধা অবস্থায় এক মাসে ৪/৫ টি লোককে গলা কাটা অবস্থায় পেয়েছি। গলা সম্পূর্ণ কাটতো না অল্প কেটে ছেড়ে দিতো, ছটফট করে শেষ হয়ে যেত। হাড়ি খালীতে (বাগেরহাট থানা) বিষ্ণু মহাশয়কে তার বৌয়ের কাছ থেকে জোর করে কেড়ে নিয়ে আরও পাঁচজনকে ধরে ওর স্ত্রীর সামনে গুলি করে হত্যা করে।
অত্যাচার চালায় সারা গ্রামে। বি,এ,পাশ এক মেয়েকে ধরে অত্যাচার চালিয়ে ছুরি দিয়ে হত্যা করে। মদনের মাঠের এক ঘরে ওরা নিয়মিত মানুষ কেটেছে।

স্বাক্ষর

তাহমীনা বেগম (দিপালী)
৩/৮/৭৩