শহীদ জায়া আরতী রাণী দাস
বাড়ীয়া গণহত্যা, বাড়ীয়া, গাজীপুর
স্বামী: শহীদ সত্য রঞ্জন দাস
পিতা: দেবেন্দ্র চন্দ্র দাস
মাতা: হিরণী রাণী দাস
আরতী রাণী দাসের তখন দুই সন্তান— ছেলের বয়স ৫ বছর, মেয়ের বয়স পাঁচ মাস। ১৪ মে (১৯৭১) অতর্কিতে বাড়ীয়া গ্রামে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী আক্রমণ করলে অন্যান্যদের মতো তিনিও এক কাপড়ে স্বামীর সাথে শিশু সন্তান নিয়ে পালাতে শুরু করেন। বিলের মধ্যে ছেলেটিকে তার জ্যাঠা শনিরাম দাস তার নৈৗকায় তুলে নেয়। নৌকায় সবার জায়গা হওয়া সম্ভব ছিল না, তাছাড়া নৌকাগুলোই ছিল সবচেয়ে অনিরাপদ— পাকিস্তানি বাহিনী নৌকাগুলো টার্গেট করে গুলি করছিল। আরতী মেয়ে কোলে বিলের মধ্য দিয়ে এগোতে পারছিলেন না, পানি কাঁদায় বারে বারে পিছিয়ে পড়ছিলেন তিনি। এ সময় তার স্বামী সত্য রঞ্জন দাস (সিতু) পাঁচ মাসের মেয়েটিকে কাঁধে নিয়ে এগোতে থাকে। বৈশাখ মাসের শেষ, তবু মাঝে মাঝে বিলে অনেক পানি। তাছাড়া বিলের মধ্যে রয়েছে একটি খাল। খাল এবং আরও কিছু দূরে বালু নদী পেরিয়ে ওপারে জয়রামবেড় গ্রাম।
পিছনে পাকিস্তানি বাহিনী এবং তাদের বাঙালি দোসরদের দেওয়া আগুনে জ্বলছে পুরো গ্রাম। চারিদিকে দড়াম দড়াম গুলির শব্দ, আশেপাশে ভয়ার্ত রক্তাক্ত মানুষের গগনবিদারী চিৎকার। সিতু মাথায় মাথাল দিয়ে নিচু হয়ে থাকে, মাঝে মাঝে একটু এগোয়। এভাবে আর পেরে ওঠে না। এক পর্যায়ে মাথাটা উঁচু করে চারিদিক একটু দেখার চেষ্টা করে।
ঠিক সেই সময় একটা গুলি এসে সিতুর ঘাড়ে লেগে ভেদ করে অন্য ঘাড় দিয়ে বের হয়ে চলে যায়। গুলি লাগার সাথে সাথে কিছু বুঝে উঠতে না পেরে তিনি ডুব দেন। কেন ডুব দিয়ে আছে আরতী বুঝে উঠতে পারে না। বলতে থাকে, “তুমি ডুব দিয়ে আছো যে, মেয়েটা তো মরে যাবে!” কোনো সাড়া না পেয়ে আরতী স্বামীকে টেনে তোলার চেষ্টা করে। অনেক কষ্টে টেনে নিয়ে একটু উঁচু জায়গায় রাখে। মেয়েটা তখনও পানিতে নিখোঁজ। রক্তে ভেসে গিয়েছে সত্য রঞ্জন দাস-এর সমস্ত শরীর, লাল সে রক্ত মিশে যাচ্ছে বিলের পানিতে হালকা থেকে হালকাতর হয়ে— একজন কৃষকের রক্ত, বর্বর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর তাড়ায় পলায়নপর একজন পিতার রক্ত।
আরতী পানিতে পা নাড়িয়ে মেয়টাকে খুঁজতে থাকে— একবার পায়ে বাঁধলে মনে করে অন্যকিছু, আশেপাশে খুঁজতে থাকে। একটু পরে সন্দেহ হওয়ায় আবার ঐ জায়গাটিতে পায়ে বাধিয়ে শিশুটিকে টেনে তোলে। শিশুটি তখন মৃতপ্রায়। বাঁচানোর কোনও চেষ্টা করছে না আরতী, চেষ্টা করতে সে যেমন জানে না, তাছাড়া পাশেই মৃত্যু যন্ত্রণায় কাঁতরাচ্ছে স্বামী। একটু পরে আপনা থেকেই শিশুটি গিলে ফেলা পানি বমি করে দিয়ে শ্বাঃস নেয়— বেঁচে ওঠার আলামত, তবু সেদিকে তেমন লক্ষ নেই আরতীর— দু’জন মৃতপ্রায় আপনজন নিয়ে বিলের মধ্যে পঁচিশ বছর বয়সী একা নারী, চারিদিক থেকে ছুটে আসছে বর্বর পাকিস্তানি বাহিনীর ছোড়া শত শত গুলি! এ দৃশ্য কল্পনা করাও কি খুব সহজ? অথচ বাস্তবেই এমন একটি নারকীয় দৃশ্যের সৃষ্টি হয়েছিল সেদিন বাড়ীয়া গ্রাম পেরিয়ে বিলাই বিলে।
অদূরে একটি নৈৗকা যাচ্ছিল, আরতী নৈৗকালাকে ধর্মের ভাই ডেকে তাদের একটু তুলতে বলে। অনেক অনুনয় বিনয় করার পরে নৈৗকালা তুলতে রাজি হয়। কিন্তু নৈৗকালা কিছুতেই হাত লাগায় না। নৈৗকায় একজন মহিলা ছিল, সে এসে আরতীর সঙ্গে মিলে মুমূর্ষু সত্য রঞ্জন দাসকে নৈৗকায় টেনে তোলেন। নদী থেকে বড় মাছ মেরে নৈৗকার খোলে ফেলার মতো সিতুকে রাখা হয়। কিছুই করার ছিল না— কে করবে তখন কার যত্ন? এ যেন সাক্ষাৎ মুত্যুপুরি! আরতীর কোলে মৃতপ্রায় শিশু কন্যা। শিশুটি কিছুক্ষণ পর পর পেট ঠেলা দিয়ে উঠছে দেখে আরতী বুঝতে পারে যে, মেয়েটি মরে নাই। শেষ পর্যন্ত শিশুটি বেঁচে যায়, সে যেন এক অলৌকিক বেঁচে যাওয়া! নৈৗকায় বিল পার হয়ে কালিগঞ্জ উপজেলার রাঙ্গামিাটি গ্রামে অন্যান্য অনেকের মতো আরতীরাও রাঙ্গামাটি চার্চে আশ্রয় নেন।
স্বামী তখনও মারা যাননি, রক্ত ঝরতে ঝরতে ফ্যাকাশে হয়ে গিয়েছে। মাঝে মাঝে ক্ষীণ স্বরে ডাক্তার ডাকতে বলছেন। কিন্তু কে কার জন্যে ডাক্তার ডাকবে তখন! আশ্রয় পেলেও খাবারের কোনো ব্যবস্থা নেই। আরতীর শিশুপুত্র এবং পানিতে ডুবে মরতে লাগা পাঁচ মাসের শিশু কন্যাটিও অভুক্ত। এভাবে ধুকতে ধুকতে কোনোমতে রাতটি পার হয়ে যায়। সিতুরও যেন কইমাছের প্রাণ! চিকিৎসা পেলে বেঁচে যেতেন নিশ্চিত। অবশেষে ১৫ মে (১৯৭১) সকাল সাতটা নাগাদ তিনি মারা যান।