বীরঙ্গনাশ্রেষ্ঠ ভাগীরথী // জি. সি. পাইক

পিরোজপুর

গভীর নিশীতে ক্লান্ত পিরোজপুর ঘুমন্ত,

খোলা জানালায় চোখ পড়তেই পোস্ট অফিসের মোড়,

কোথাও কেউ নেই, অবারিত শূন্যতা,

অজানা কোনো স্থান হতে যেন

ভেসে আসছে গগনবিদারী করুণ আর্তচিৎকার।

শুরুটা মনে হয় কোনো এক অভাগা অষ্টাদশী মায়ের মতো।

হাতড়িপেটা হতে থাকলো বুকের ভেতর—

এ আমার বীরাঙ্গনা মা ভাগীরথীর অতৃপ্ত আত্মার আর্তনাদ নয়তো?

নগ্ন পায়ে রাজপথে নেমে, আলো আধারে পথ চলে,

শূন্যতার দিকে চেয়ে ভাগীরথী মা-কে উদ্দেশ্য করে বলছি—

মা তুই অতৃপ্ত কেন?

তুই কি দেখিস না তোর সহস্র সন্তানের মতো

আজও আমি পিরোজপুরের রাজপথে নগ্ন পায়ে চলি।

পা ফেললেই মনে হয় ঐ ইটটা বুঝি সেই বিকেলে

মা তোর রক্তে রঞ্জিত হয়েছিলো।

ঐ পাথরটার খাঁজে বুঝি তোর দেহ ছেড়া মাংসপিণ্ড, হাড়ের খন্ড;

আজও আটকে আছে।।

এ শহরের কোনো রাস্তার ইট-পাথর-বালুকনায়

মা তুই মিশে নেই?

তোর প্রতিরোধের কাহিনী আজও মুক্তিকামীর রক্তে আগুন জ্বালায়।

কতটা আগুন হন্তারকদের গায়ে জ্বেলেছিলি তুই সেদিন!

ওরা তোকে ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করেছিলো!

মা তুই কত বড় বীর!

ওরা তোকে পিরোজপুরের রাজপথে মিশিয়ে দিয়েছিলো।

মা তোর বীরত্বের ইতিহাস পড়ে

যে ক্রোধাগ্নিতে জ্বলে না, ফেলে না চোখের জল,

তার মানুষ হয়ে জন্মানো বৃথা, নিস্ফল।

এ রাষ্ট্র বড় বেঈমান,

এ রাষ্ট্র তোকে বীরাঙ্গনা করে হয়েছে ক্ষান্ত,

এত বড় যোদ্ধা তুই!

এখনো নয় কেন মুক্তিযোদ্ধা?

বীরশ্রেষ্ঠ, বীর বিক্রম, বীর উত্তম তবে কারা?

আমাদের কাছে

বীরাঙ্গনাশ্রেষ্ঠ তুই, তুই এ বাংলা মুক্তির সহস্রধারা।


পাদটিকাঃ ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধে বীরাঙ্গনা ভগীরথী (ভগীরথী সাহা) পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে। মূলত তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের পক্ষে গুপ্তচরবৃত্তি করতেন। পাকিস্তানি বাহীনি ক্ষিপ্ত হয়ে তার মাথার মুল্য এক হাজার টাকা ধার্য করেছিলো। রাজাকারেরা অনেক চেষ্টায় তাকে ধরিয়ে দেয়। ১৯৭১-এর এক বিকেলে পিরোজপুরের কেন্দ্রীয় মসজিদ সংলগ্ন পোস্ট অফিসের মোড়ে (চৌমাথায়) দু’টি জিপে বেঁধে তাকে ছিঁড়ে ফেলা হয়। পূর্বে জিপের সাথে বেঁধে বিবস্ত্র অবস্থায় তাকে সারা শহরের রাস্তায় টানা হয়েছিলো। পুরো শহর ঘুরানোর পরেও দেহে প্রাণ ছিলো ভগীরথীর। সে অবস্থায়ই গুলি করে মেরে ফেলা হয় তাকে!

শহীদ ভগীরথী

বাগেরহাট জেলার কচুয়া উপজেলার দেবীপুর গ্রামে ভাগীরথীর জন্ম ১৯৪০ সালে। তাঁর বাবা মুড়ি বিক্রি করতেন। স্কুলে পড়ার সুযোগ হয় নি ভাগীরথীর। ১৯৫৬ সালে বিয়ে হয়েছিল পিরোজপুর সদর উপজেলার কদমতলা ইউনিয়নের বাঘমারা গ্রামের প্রিয়নাথ সাহার সঙ্গে। ১৯৬৭ সালে দুটি শিশু ছেলে রেখে স্বামী প্রিয়নাথ মারা যান।