বৈটপুরে ‘৭১-এ নৃশংস গণহত্যার শিকার গুহ পরিবারের বিশাল সম্পত্তি দখল করে রেখেছে কে?

হরিশ গুহর বাড়ি

গুহপরিবারের বাড়িটি একটি একতলা পাকাবাড়ি। সামনে ঘাট বাঁধানো পুকুর। বাড়িতে জায়গা প্রায় ৫ একর। একাত্তরের নৃশংস গণহত্যার শিকার হয়েছিলো এই পরিবারটি। লোমহর্ষক ঘটনা এটি। কাউকে গলাকেটে, কাউকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছিলো সেদিন। এতবড় একটি বেদনাদায়ক ঘটনার পরও কিন্তু ইতিহাসের শত্রুরা পিছু হটেনি। গুহ বাড়ির সম্পত্তি তারা দখল করে নিয়েছে। প্রশাসন থেকেও ফেলে যাওয়া বা অর্পিত এ সম্পত্তি উদ্ধারে কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। এ সম্পর্কে স্থানীয় কয়েক জনের সাথে কথা বললে তারা জানায়— ১৯৮৬ সালের পরে গুহ বাড়ির ওয়ারিশ কেউ আর বাংলাদেশে থাকেনি বা বাংলাদেশে আসেনি, ফলে ’৯১ সালে বাড়িটি কিনে নিয়েছে বলে যারা দাবী করছে, তারা আসলে দখলকারী। এলাকাবাসী জানায়— কিছুটা পাপ মোচনের জন্যে হলেও বাড়িটি উদ্ধার করে সরকারের জিম্মায় নেওয়া প্রয়োজন।

তবে বাড়িটার বর্তমান ভোগদখলকারী সালাম হাওলাদার বলেন, আমি এ বাড়ির ক্রয়সূত্রে মালিক। ‘৮৯ এবং ‘৯১-তে দু’টো দলিলের মাধ্যমে নির্মল গুহর দুই ছেলে তাপস গুহ এবং মানস গুহর কাছ থেকে এই জমি ক্রয় করি। তাদের মা রমা রাণী গুহ এবং বোন রিতা গুহ বিষয়টি জানতেন, এবং তারা তখন দেশে ছিলেন।

যদিও জানা যায়— ১৯৮৬ সালে নির্মল গুহর পরিবার ভারতে চলে যায়, এবং তারা দলিলের মাধ্যমে এ জমি হস্তান্তর করেননি।

হরিশ গুহর বাড়ি

কিছুদিন একটি দখলদার পরিবার থাকলেও ’৭১-এর গণহত্যার শিকার হরিশ গুহর বাড়িটি এখন এভাবেই পড়ে আছে।

বাগেরহাট জেলার দড়াটানা নদীসংলগ্ন বৈটপুর গ্রামে গুহবাড়িতে গণহত্যার ঘটনাটি ঘটেছিলো ১০ অক্টোবর (২২ আশ্বিন) দিবাগত রাতে। রাজাকার বাহিনীর অর্ধ শতাধিক সদস্য ঐ দিন পাঁচ জনকে হত্যা করে। বৈটপুর গ্রামের হরিশ গুহ ছিলেন সম্পদশালী মানুষ। তার জামাতা শিবপদ বসু ছিলেন বাগেরহাট পৌরসভার নির্বাচিত চেয়ারম্যান। মুক্তিযুদ্ধকালীন একটা পর্যায়ে হরিশগুহর পরিবার বাঁচার জন্য ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছিলেন। হরিশ গুহর মেয়ে দিপালী গুহর বিয়ে হয়েছিলো মুসলিম ছেলের সঙ্গে, নাম হয়েছিলো তাহমিনা বেগম। কিন্তু তাতে শেষ রক্ষা হয়নি। রাজাকারেরা তাতে বরং ভেবেছিলো— এখন আর হরিশ গুহর জায়গা সম্পত্তি দখল করে যাবে না।

ঐদিন রাতে রাজাকারেরা বাড়িটিকে ঘিরে ফেলে। এরপর মুক্তিযোদ্ধা পরিচয় দিয়ে সবাইকে ডেকে বাইরে আনে। হরিশ গুহর বড় ছেলে প্রদীপ গুহ বুঝতে পেরে ছাদে উঠে সুপারী গাছ বেয়ে পালাতে চেষ্টা করেছিলেন। তখন পিছন থেকে রাজাকারেরা তাকে ধরে ফেলে। বাড়ির সামনের রাস্তায় এনে প্রদীপ গুহকে জবাই করে হত্যা করে। সামান্য দূরে আড়ালে দাঁড়িয়ে থাকা প্রতীক্ষদর্শীদের ভাষ্যমতে— প্রদীপ গুহ তখন রাজাকারদের বলতেছিলো, আমার খুব কষ্ট হচ্ছে, গলায় আরেকটু জোরে পোচ দেন।

সিরাজ মাস্টারের নেতৃত্বে রাজাকারেরা সেদিন যাদেরকে হত্যা করেছিলো— হরিশ গুহ, তার ভাই নির্মল গুহ, হরিশ গুহের বড় ছেলে প্রদীপ গুহ, সুশীল রায়ের বাড়ির কাজের লোক গোপাল প্রামাণিক এবং স্থানীয় জমিদার সুশীল রায় চৌধুরীকে।

গণহত্যার পর গুহ পরিবারকে কবর দিয়েছিলো স্থানীয় কিছু মানুষ। কবরের গায়ে একটি নামফলকও ছিলো। পরবর্তীতে দখলদারেরা কবরের গা থেকে নামফলকটি তুলে ফেলে। স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদ সদস্য কবরটি সণাক্ত করছেন। ছবিঃ পান্না বৈরাগী
বৈটপুর গ্রাম
স্থানীয় জমিদার সুশীল রায় চৌধুরীর সমাধি, যাকেও ঐদিন গুহ পরিবারের সাথে হত্যা করা হয়। কে বার কারা যেন সমাধি থেকে নাম ফলকটি তুলে ফেলেছে!