আজ কার্যদিবসের শুরুতে যুদ্ধাপরাধী মীর কাসেম আলীর ফাঁসির রায় পুনর্বিবেচনার (রিভিউ) আবেদন সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ খারিজ করে দিয়েছে।
এর ফলে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় কিশোর মুক্তিযোদ্ধা জসিমকে অপহরণ, আটকে রেখে নির্যাতন ও হত্যার অপরাধের জামায়াতে ইসলামীর অর্থ জোগানদাতার দণ্ড কার্যকরে আর কোনো আইনি বাধা থাকল না।
নিয়ম অনুযায়ী একাত্তরের বদর নেতা কাসেম এখন কেবল নিজের কৃতকর্মের জন্য অনুশোচনার কথা জানিয়ে রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষা চাইতে পারেন। এর নিষ্পত্তি হলেই সরকার দণ্ড কার্যকর করবে।
প্রধান বিচারপতি এসকে সিনহার নেতৃত্বে পাঁচ সদস্যের আপিল বেঞ্চ মঙ্গলবার এই রায় ঘোষণা করেন। বেলা ৯টায় এজলাসে এসে প্রধান বিচারপতি বলেন, “ডিসমিসড”।
এই বেঞ্চের বাকি চার সদস্য হলেন- বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন, বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী, বিচারপতি মির্জা হোসেইন হায়দার ও বিচারপতি মোহাম্মদ বজলুর রহমান।
সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রার দপ্তরের এক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, রিভিউয়ের পূর্ণাঙ্গ রায়ের প্রত্যায়িত অনুলিপি শিগগিরই ট্রাইব্যুনালের মাধ্যমে কারাগারে পাঠানো হবে।
মুক্তিযুদ্ধকালীন চট্টগ্রামের ত্রাস কাসেম রাজনৈতিক ও আর্থিক ক্ষেত্রে অসাধারণ ধূর্ততার স্বাক্ষর রেখে অত্যন্ত দ্রুততায় নিজের ও দলের উন্নতি ঘটান, পরিণত হন জামায়াতের আর্থিক মেরুদণ্ডে। তেষট্টি বছর বয়সী এই যুদ্ধাপরাধী এখন আছেন গাজীপুরের কাশিমপুর কারাগারের কনডেম সেলে।
কাসেম হলেন ষষ্ঠ যুদ্ধাপরাধী, যার সর্বোচ্চ সাজার রায় কার্যকরের পর্যায়ে এসেছে। তিনি হলেন জামায়াতের পঞ্চম শীর্ষ নেতা, শেষ বিচারেও যার মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখা হয়েছে।
বিচার ঠেকানোর চেষ্টা বার বার
আপিল বিভাগের একই বেঞ্চ গত ৮ মার্চ মীর কাসেমের আপিলের রায় ঘোষণা করে। ২০১৪ সালের ২ নভেম্বর আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের দেওয়া প্রাণদণ্ডের সাজাই তাতে বহাল থাকে।
ট্রাইব্যুনালে এ মামলার বিচার চলার মধ্যেই ২০১৩ সালের ২৮ এপ্রিল তৎকালীন আইনমন্ত্রী শফিক আহমেদ সাংবাদিকদের বলেছিলেন, মীর কাসেম আলী মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারকাজ প্রশ্নবিদ্ধ করতে যুক্তরাষ্ট্রের একটি লবিস্ট প্রতিষ্ঠানকে ২ কোটি ৫০ লাখ ডলার দিয়েছেন। লবিস্ট প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে ওই চুক্তির কপি এবং টাকা দেওয়ার রসিদ রয়েছে সরকারের কাছে।
সেই অভিযোগের পক্ষে সুপ্রিম কোর্টে এ মামলার আপিল শুনানিতে একটি মেমো দাখিল করে রাষ্ট্রপক্ষ। ওয়াশিংটনের ফার্ম ক্যাসিডি অ্যান্ড অ্যাসোসিয়েটসের ওই মেমোতে বলা হয়, তারা ‘পেশাগত সেবার’ জন্য মীর কাসেমের পাঠানো আড়াই কোটি ডলার হাতে পেয়েছে।
রিভিউ শুনানিতে প্রধান বিচারপতি বলেন, আদালত ওই মেমোকে প্রমাণ হিসাবে নেয়নি, কিন্তু আসামি যতগুলো কোম্পানির সঙ্গে যুক্ত, তাতে রাষ্ট্রপক্ষের অভিযোগ ‘বাড়াবাড়ি বলে মনে হয় না’।
আপিল বিভাগে এ মামলার শুনানির সময় প্রসিকিউশন ও তদন্ত সংস্থার কাজ নিয়ে প্রধান বিচারপতির অসন্তোষের বিষয়টি আলোচনার জন্ম দেয়। অ্যাটর্নি জেনারেলও শুনানিতে বলেন, যে দুই অভিযোগে ট্রাইব্যুনালে কাসেমের মৃত্যুদণ্ড হয়েছিল, তার একটিতে তিনি আপিলে খালাস পেয়ে যান প্রসিকিউটার ও তদন্ত সংস্থার ‘অযোগ্যতার’ কারণে।
আপিলের রায় পুনর্বিবেচনার শুনানি পেছাতেও বার বার চেষ্টা করতে দেখা যায় আসামিপক্ষকে। যুদ্ধাপরাধের অন্য মামলার রিভিউয়ে যে সময় লেগেছে, মীর কাসেম আলীর ক্ষেত্রে তার দ্বিগুণ সময় ব্যয় হয়েছে বলে অ্যাটর্নি জেনারেলের তথ্য।
‘বাঙালি খান’
ইসলামী ছাত্রশিবিরের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি মীর কাসেম ১৯৮৫ সাল থেকে জামায়াতের কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদ অর্থাৎ মজলিসে শূরার সদস্য হিসেবে দলে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছিলেন। ২০১২ সালের ১৭ জুন মতিঝিলে নয়া দিগন্ত কার্যালয় থেকে যুদ্ধাপরাধের মামলায় তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। পরের বছর ৫ সেপ্টেম্বর অভিযোগ গঠনের মধ্য দিয়ে শুরু হয় তার যুদ্ধাপরাধের বিচার।
এ মামলার শুনানিতে রাষ্ট্রপক্ষ মীর কাসেমকে আখ্যায়িত করেছে পাকিস্তানের খান সেনাদের সঙ্গে মানবতাবিরোধী অপরাধে লিপ্ত হওয়া ‘বাঙালি খান’ হিসাবে, যিনি সে সময় জামায়াতের তখনকার ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্রসংঘের পূর্ব পাকিস্তান শাখার সাধারণ সম্পাদক ছিলেন।
মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে পাকিস্তানি সেনাদের সহযোগিতায় ছাত্রসংঘের বাছাই করা সদস্যদের নিয়ে গঠিত সশস্ত্র আলবদর বাহিনীর চট্টগ্রাম অঞ্চলের কমান্ডার হিসেবে মীর কাসেম যেসব মানবতাবিরোধী অপরাধ ঘটান, তা উঠে এসেছে ট্রাইব্যুনাল ও আপিল বিভাগের রায়ে।
একাত্তরে মীর কাসেমের নির্দেশেই চট্টগ্রাম টেলিগ্রাফ অফিস সংলগ্ন এলাকায় হিন্দু মালিকানাধীন মহামায়া ভবন দখল করে নাম দেওয়া হয় ডালিম হোটেল। সেখানে গড়ে তোলা হয় বদর বাহিনীর চট্টগ্রাম অঞ্চলের ঘাঁটি এবং বন্দিশিবির। ট্রাইব্যুনালের রায়ের পর্যবেক্ষণে সেই ডালিম হোটেলকে বলা হয় ‘ডেথ ফ্যাক্টরি’।
সুপ্রিম কোর্ট ৬ জুন আপিলের রায়ের পূর্ণাঙ্গ অনুলিপি প্রকাশ করলে ট্রাইব্যুনাল মৃত্যু পরোয়ানা জারি করে, পরদিন তা পড়ে শোনানো হয় যুদ্ধাপরাধী কাসেমকে।
এরপর আইনে নির্ধারিত ১৫ দিন সময় শেষ হওয়ার আগেই গত ১৯ জুন আপিলের রায় পুনর্বিবেচনার (রিভিউ) আবেদন করেন মীর কাসেম। সেই রিভিউ আবেদনের ওপর ২৪ ও ২৮ অগাস্ট দুই দিন শুনানি নিয়ে আপিল বিভাগ মঙ্গলবার রায় ঘোষণা করল। যার মধ্য দিয়ে পরিসমাপ্তি ঘটল যুদ্ধাপরাধী কাসেমের বিচার প্রক্রিয়ার।
কাসেমের বিচার
ট্রাইব্যুনাল | আপিল বিভাগ |
# ট্রাইব্যুনালের রায়ে প্রসিকিউশনের আনা ১৪ অভিযোগের মধ্যে দশটিতে কাসেমকে দোষী সাব্যস্ত করে বাকিগুলোতে খালাস দেওয়া হয়।
# এর মধ্যে ১১ ও ১২ নম্বর ঘটনায় কাসেমের ফাঁসির রায় আসে। # ২, ৩, ৪, ৬, ৭, ৯, ১০ ও ১৪ নম্বর অভিযোগে মোট ৭২ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয় তাকে। |
# চূড়ান্ত রায়ে ১১ নম্বর অভিযোগে অপহরণ, নির্যাতন ও হত্যার দায়ে কাসেমের ফাঁসির রায় বহাল থাকে।
# ২, ৩, ৭, ৯, ১০ ও ১৪ নম্বর অভিযোগে মোট ৫৮ বছরের কারাদণ্ড বহাল রাখে আদালত। # ৪, ৬ ও ১২ নম্বর অভিযোগ থেকে কাসেমকে খালাস দেয় আপিল বিভাগ। |
যে অভিযোগে প্রাণদণ্ড
অভিযোগ ১১: ১৯৭১ সালে ঈদুল ফিতরের পরের যে কোনো একদিন মীর কাসেমের পরিকল্পনা ও নেতৃত্বে আলবদর বাহিনীর সদস্যরা চট্টগ্রাম শহরের কোনো এক অজ্ঞাত স্থান থেকে মুক্তিযোদ্ধা জসিমকে অপহরণ করে আন্দরকিল্লার ডালিম হোটেলে নিয়ে যায়। তাকে ২৮ নভেম্বর পর্যন্ত সেখানে আটকে রেখে নির্যাতন করা হয়। নির্যাতনের ফলে জসিমের মৃত্যু হলে আরো পাঁচজন অজ্ঞাতপরিচয় ব্যক্তির লাশসহ তার মৃতদেহ কর্ণফুলী নদীতে ফেলে দেওয়া হয়।
পরের ধাপ প্রাণভিক্ষা
দণ্ড কার্যকরের আগে যুদ্ধাপরাধী কাসেমের শেষ আইনি সুযোগ ছিল রিভিউ আবেদন। তা খারিজের মধ্য দিয়ে আইনি লড়াইয়ের পরিসমাপ্তি হয়েছে। এখন সংবিধানের ৪৯ অনু্চ্ছেদ অনুসারে শেষ সুযোগে দণ্ডাদেশ পাওয়া আসামি প্রাণভিক্ষা চাইতে পারেন।
আসামি তা না চাইলে বা রাষ্ট্রপতির ক্ষমা না পেলে সরকার দিনক্ষণ ঠিক করে কারা কর্তৃপক্ষকে ফাঁসি কার্যকরের নির্দেশ দেবে। তার আগে স্বজনেরা কারাগারে গিয়ে তার সঙ্গে সাক্ষাত করতে পারবেন।
একাত্তরের যুদ্ধাপরাধে অভিযুক্ত প্রথম ব্যক্তি হিসেবে ২০১৩ সালের ১২ ডিসেম্বর ফাঁসিতে ঝোলানো হয় জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল কাদের মোল্লাকে।
আর ২০১৫ সালের ১১ এপ্রিল জামায়াতের আরেক সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মুহাম্মদ কামারুজ্জামানের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করে কারা কর্তৃপক্ষ।
তাদের দুজনের রিভিউ আবেদন একদিনের মধ্যে শুনানি শেষে খারিজ হয়ে গিয়েছিল। তারা রাষ্ট্রপতির ক্ষমা চাননি বলে সরকারের পক্ষ থেকে সে সময় জানানো হয়, পরে তাদের ফাঁসিতে ঝোলানো হয়।
এরপর জামায়াত নেতা আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ ও বিএনপির সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয় একই দিনে, গতবছর ২১ নভেম্বর। তারা প্রাণভিক্ষার আবেদন করলেও রাষ্ট্রপতি তা নাকচ করে দেন বলে সে সময় সরকারের পক্ষ থেকে জানানো হয়।
আর সর্বশেষ জামায়াতে ইসলামীর আমির মতিউর রহমান নিজামীর রিভিউ আবেদন খারিজের ছয় দিনের মাথায় গত ১১ মে তাকে ফাঁসিতে ঝোলানো হয়। তিনি প্রাণভিক্ষার আবেদন করেননি বলে সে সময় সরকারের পক্ষ থেকে জানানো হয়।
এর বাইরে যুদ্ধাপরাধ মামলার আসামিদের মধ্যে কেবল জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর রায় এসেছে আপিল বিভাগে। ট্রাইব্যুনালে তাকে দেওয়া সর্বোচ্চ সাজার রায় কমিয়ে আপিল বিভাগ আমৃত্যু কারাদণ্ডের যে রায় দিয়েছে, তার রিভিউ চেয়েছে দুই পক্ষই।
সূত্র: বিডিনিউজ