আমি ছিলাম রামপুরা এলাকার প্লাটুন কমান্ডার। দাসেরকান্দি, কায়েতপাড়া, মেরাদিয়া, ফকিরখালি ইত্যাদি এলাকাগুলিতে আমাদের তৎপরতা ছিল। তখন বাড়িটি এমন ছিল না, বলতে গেলে এ এলাকায় তেমন কোনো ভবনই ছিল না। আমাদের বাড়িটি ছিল একটা টিনের ঘর। টিভি সেন্টার হিসেবে তখন কেবল একটি একতলা ভবন হয়েছে।
৮ এপ্রিল আমি ট্রেনিং করতে ভারতে যাই। মুরাদনগর দিয়ে নদী পার হয়ে আমরা ভারতে ঢুকেছিলাম। কলকাতার মণীপুরিপাড়ায় ঢুকেছিলাম। আমি আওয়ামী লীগের এক নেতা— সম্ভবত উনি আওয়ামী লীগের প্রচার সম্পাদক ছিলেন— যতদূর মনে পড়ছে নুরুল ইসলামই তো ওনার নাম ছিল! ওনার সাথে আমি ভারতে গিয়েছিলাম। আমি ট্রেনিং করেছিলাম সিংলা, উমকিনগর এবং মেলাঘরে। দেশে ঢুকি ১৮ জুলাই (১৯৭১)। এসে মুক্তিযোদ্ধাদের ফকিরখালি ক্যাম্পে যোগদান করি।
যে ঘটনাটির কথা আপনি বলছেন— ঘটনাটি কবে ঘটেছিল, এটা নিয়ে আমার একটু সংশয় আছে। যতদূর মনে পড়ে মেরাদিয়াতে আমি পাকিস্তানি আর্মির সাথে যুদ্ধে জড়িয়েছিলাম যেদিন সেই একইদিনে খিলগাঁও-এর মুক্তিযোদ্ধা বাকীকে হত্যা করা হয়েছিল।
তখন তো এই এলাকাটি গ্রাম। বিলের মধ্যে ছোট ছোট টিলার মতো জায়গায় বসতবাড়ি। ফলে এই এলাকায় পাকিস্তানি আর্মিদের চলাফেরা করা খুব সহজ ছিল না। বিশেষ করে বর্ষাকালে তাদের চলাফেরায় অসুবিধা হতো। আমরা যেহেতু স্থানীয়, ফলে আমরা খুব সুবিধাজনক অবস্থায় ছিলাম।
মেরাদিয়াতে পাকিস্তানি আর্মির আসা যাওয়া চলছিল, এটা জানার পর আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম একজন আর্মি ধরে ফেলব আমরা। একজনকে ধরে জিম্মি করতে পারলে অনেক তথ্য আদায় করতে পারব। সিদ্ধান্ত মোতাবেক আমি ঘটনাস্থলে গিয়েছিলাম। রেকি করতে গিয়ে আমি দু’জন পাকিস্তানি আর্মি এবং একজন রাজাকারকে দেখতে পাই। খুব ভোরে আমি বাসা থেকে বের হয়েছিলাম। পথে বাকীর সাথে দেখা হয়েছিল। মনসুর চেয়ারম্যানের (তৎকালীন সাঁতারকুল ইউনিয়নের চেয়ারম্যান) শশুরবাড়ির কাছে গিয়ে পাকিস্তানি আর্মিদের দেখতে পাই। ওরা দুটো রাজাকার সাথে নিয়ে মেরাদিয়া এলাকায় হাঁস মুরগী ধরতে এসেছিল। একজন আর্মির কাছে অস্ত্র ছিল, আরেক জনের কাছে অস্ত্র ছিল না।
এই মুহূর্তে আমার তফাজ্জলের সাথে দেখা হয়। তফাজ্জলকে আমি বললাম, “যে আর্মিটার কাছে অস্ত্র আছে ওকে আমি জাপটে ধরো ফেলব, এই সময়ে তুমি স্টেনগান নিয়ে হাজির হবা।” পঞ্চাশ হাত দূরে আমি তফাজ্জ্বলকে দাঁড় করিয়ে রেখে গিয়েছিলাম। তফাজ্জলের সাথে চুক্তি ছিল— আমি আর্মি ধরার সাথে ও এগিয়ে গিয়ে গুলি করে আমাকে সহযোগিতা করবে। কিন্তু বাস্তবে সেটি ঘটেনি। আমি রেকি করতে গিয়ে পাকিস্তানি আর্মির তল্লাসির মুখে পড়ে যাই। আমাকে ওরা তল্লাসি করতে চাইলে আমি সাথে সাথে ঐ আর্মিকে গলা ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিয়ে অস্ত্র কেড়ে নিয়ে ছুড়ে ফেলি। এ সময়ে আমার সাথে ওদের ধস্তাধস্তি শুরু হয়। ঐ সময় যদি তফাজ্জল এগিয়ে আসতে পারত, তাহলে আর্মিটাকে আমরা ঠিকই ধরে আনতে সমর্থ হতাম। তফাজ্জল আসতে অনেক দেরি করে ফেলেছিল। এর মধ্যে রাজাকার দুটো এবং বাকি আর্মিটা এসে আমাকে মারধর করে। আমাকে আহত করে ফেলে রেখে যাওয়ার পর তফাজ্জল আসে। ওরা ভেবেছিল আমি মরেই গেছি। এ সময় মহিলারা চিৎকার করছিল। চিৎকার শুনে কয়েকজন এসে আমাকে উদ্ধার করে। যে কয়জন আমাকে কোষা নৌকায় করে দাসেরকান্দি ক্যাম্পে নিয়ে গিয়েছিল তাদের মধ্যে আকবর কমিশনার ছিল, তফাজ্জল তো আগে থেকেই ছিল।
পাকিস্তানি আর্মির লঞ্চ ছিনিয়ে নেওয়ার যে ঘটনাটি এ এলাকায় ঘটেছিল— সেটি ঘটেছিল নন্দিপাড়া মন্দিরের সামনে খালে। এটি আমার সাথে মেরাদিয়াতে যে ঘটনাটি পাকিস্তানি আর্মির সাথে ঘটে সে ঘটনার আগে ঘটেছিল— সম্ভবত কয়েক মাস আগের ঘটনা হবে। পাকিস্তানি বাহিনীর ক্যাম্প ছিল মাদারটেক। একটি মটর বোট নিয়ে ওরা এই এলাকায় টহল দিত। লঞ্চটি মেরাদিয়া হাটের কাছে অথবা নন্দিপাড়া মন্দিরের সামনে খালে রাখত। মন্দিরটি এখন আর নেই। লঞ্চ ছিনিয়ে নেওয়ার ক্ষেত্রে এ এলাকার সকল মুক্তিযোদ্ধার অবদান ছিল। এটি কারও একার কৃতিত্ব নয়। তৈয়ব আলী কমান্ডার ছিল, আমি ছিলাম, জিন্নাহ নামে একজন ছিল, আরও অনেকে ছিল। যতদূর মনে পড়ে তৈয়ব আলী কমান্ডারই লঞ্চ ছিনিয়ে নেওয়ার ঘটনাটিতে নেতৃত্ব দিয়েছিল।