Headlines

শহিদজায়া, শহিদমাতা, বীরঙ্গনা, ভূমিহীন চারুবালা বাস করছেন পদ্মার চরে একটি খুপড়ি ঘরে!

চারু বালা

কল্পকাহিনীকেও হার মানায় চারুবালার জীবনালেখ্য। বিভীষিকাময় একটি জীবন পার করেছেন তিনি। কেউ তা জানে না, জানাতেও চান না বীরঙ্গনা চারুবালা। কেন জানাবেন? পদে পদে লাঞ্চনা বঞ্চনা সহ্য করে এখন তিনি মৃত্যুর দ্বারপ্রান্তে।
আমরা জানি শুধু বিজয়ের গল্প। আমাদের মুক্তিযুদ্ধ আসলেই কি শুধু এক বিজয়গাঁথা মহাকাব্য? মোটেও তা নয়। হারানোর বেদনা লুকিয়ে আছে এদেশের প্রতিটি কোণায়, পরতে পরতে। কখনো কি খুঁজে দেখার চেষ্টা করেছে এ রাষ্ট্র সে শোকগাঁথার একটু আধটুও? যদি সত্যিই আমরা তা জানতে চাইতাম তাহলে প্রায় পঞাশ বছর গত হবার পরও কি চারুবালার খোঁজ রাষ্ট্রের না জানার কথা? সত্য হলো আমরা জানি না। আসলে জানতে চাই নাই বলেই জানি না। উপজেলা প্রশাসন, স্থানীয় সরকার কাউকেই কি দায়িত্ব দেওয়া যেত না চারুবালাদের খুঁজে বের করার জন্য? কেউ যে জানে না তাও ঠিক নয়। জানে, কিন্তু তারা জানাতে চায় না। জানাতে গেলে দায় চলে আসে, মুখে যে চুনকালি পড়ে!
আমরা যখন চরভদ্রাসনের গাজিরটেক ইউনিয়নের চেয়ারম্যানের কাছে জানতে চাইলাম চারুবালা সম্পর্কে তিনি কিছু মুখস্থ কথা বললেন। উপজেলা প্রশাসনও শহিদ পরিবারগুলোর কোনো খোঁজ খবর রাখে না বলে অভিযোগ শহিদ পরিবারের সদস্যদের। চারুবালা সম্পর্কে তেমন কিছুই জানে না স্থানীয় কেউ। বীর মুক্তিযোদ্ধারাও কিছু বলতে পারলেন না!

তবু তিনি আছেন, চারুবালা বেঁচে আছেন;

ভাস্কর্য নয় কোনো, জীবন্ত জীবাস্ম হয়ে।

বর্বরতার সাক্ষী,

কালান্তরের ইতিহাস হয়ে।

যেন এই রাষ্ট্রকে বলতে–

বেঈমান, বিশ্বাসঘাতক তুমি,

হন্তারক, হায়েনা তুমি,

কেড়ে নিয়েছো সব,

স্বীকার করোনি, ফিরিয়ে দাওনি কিছু,

দূর কি বাত আমার স্বদেশ ভূমি।

আবারও নিয়েছে ওরা

নিঃস্ব রিক্ত সর্বহারা আমাদের পিছু।

নারী, শিশু–

কোটি মানুষকে হত্যা করেছিল যারা

তাদের তোমরা আজ ভাস্কর্য আর মূর্তির

পার্থক্য বুঝাও!

কেন বুঝাও?

কাদের বুঝাও? 

মানুষ মেরে কাবার করেছিল ওরা,

ওরা শাবল চালিয়েছিল নারী গর্ভে

দোর্দন্ড প্রতাপে, সগৌরবে!

কীসের দুই লক্ষ!

কে শিখিয়েছে তোমাদের এমন সব গণনা?

তোমরা করেছো  অদ্ভুত সব রটনা!

বর্বর ওদের নখর থেকে রেহাই পায়নি

সেদিন আবাল বৃদ্ধ বা কোনো শিশুও,

তবু তোমরা ভাস্কর্য আর মূর্তির পার্থক্য বুঝাও!

আমার কাছে চারুবালা, বঙ্গবন্ধু মানে মূর্তি,

হা, উপাসনাই করব আমি সে মূর্তির পায়ে,

তোমরা আসবে জানি

আবার সেই পাকিন্তানি হানাদার হয়ে। 

পারলে ঠেকাও,

চাপাতি নিয়ে ঘুরে বেড়াও বা শূলে চড়াও।

চারুবালারা থাকে পদ্মার চরে,

ভাগাভাগি সব

জামায়াত, হেফাজত আর তোমাদের তরে!

লজ্জ্বা, কার লজ্জ্বা? তোমার, নাকি আমার?

আমাদের, নাকি শুধু সরকারের?

ট্রাম্প, মোদি বা পুতিনের,

নাকি এ পৃথিবীর, মেকি সব সভ্যতার? 

বুঝতে হবে, তোমাদের সাথে জুজতে হবে।

তবে চরভদ্রাসন উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা জানালেন, “চারুবালার বিষয়ে আমাকে কেউ কখনও কিছু জানায়নি, বা তিনি নিজেও কখনও কোনো সহায়তার জন্য আমার কাছে আসেননি। তবে করোনার প্রকোপের সময় সরকারের ত্রাণ সহায়তা দিতে চরে গেলে তিনি প্রশাসনের নজরে আসেন এবং তাকে সরকারিভাবে জমি ও ঘর প্রদানের বিষয়টি আমরা ভেবেছি এবং এ বিষয়ে উদ্যোগ প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। আশা করছি অল্প কিছুদিনের মধ্যেই তার জন্য গৃহীত পদক্ষেপ দৃশ্যমান হবে।” 

বিস্ময়বিমূঢ় হয়ে চরভদ্রাসন উপজেলার সহকারি কমিশনার (ভূমি) ইমদাদুল হক তালুকদার (প্লাবন ইমদাদ) কে নিয়ে এবং তার সার্বিক সহযোগিতায় ১৯ নভেম্বর (২০২০) বের হই চারুবালার খোঁজে। এর আগে গাজিরটেক ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য শান্তিরঞ্জন ঘোষ শহীদ পরিবার সম্পর্কে খোঁজ খবর করার কিছুটা দায়িত্ব নিয়েছিলেন। তিনি ১৮ নভেম্বর চারুবালাকে এনে প্রায় সারাদিন উপজেলায় বসিয়ে রাখেন, অথচ আমরা কিছুই জানি না। যেন একজন এমন চারুবালাকে সারাদিন বসিয়ে রাখা কোনো ব্যাপারই না! এমন তো কতই বসে থাকেন তিনি ইউনিয়ন বা উপজেলা পরিষদে কয়েক কেজি চাল বা গমের আশায়— চারুবালারা এভাবে নিয়তি মেনে সয়ে যায় সব। তাদের প্রতিবাদের সব ভাষা কেড়ে নিয়েছে ‘ধর্ম’, তাকিয়ে দেখুন গলায় তার “তুলসীর মালা”— ওতেই সর্বসয়ে, সকল বিকিয়ে ‘পরিত্রাণ’, এদেশ এবং দুবৃত্তের বেঁচে যায় মান-সম্মান।

ঐদিন সন্ধ্যায় চারুবালার সাথে আমরা কথা বলি হাজিগঞ্জ বাজারে বণিক সমিতির অফিসে বসে। কথা বলতে বলতে আমাদের ঘোর লেগে যায়। সত্যিই কি চারুবালার জীবনে এমনটি ঘটৈছে? সত্যিই তো ঘটেছে।
১৯৭১ সালের (১৩৭৮) বৈশাখ মাসের ২৩ (৭ মে ১৯৭১) তারিখ পাকিস্তানি বাহিনী স্থানীয় রাজাকার এবং ফরিদপুরের বিহারী এবং আল বদর বাহিনীর সহযোগিতায় ফরিদপুর সদর হতে ডিক্রিরচর ইউনিয়ন হয়ে গাজিরটেক ইউনিয়নের হিন্দু অধুষ্যিত গ্রামগুলোতে প্রবেশ করে। পাকিস্তানি বাহিনী নির্বিচারে বাড়িঘর পোড়াতে থাকে, হত্যা করতে থাকে পুরুষদের। নারীদের ওপর নেমে আসে অকথ্য নির্যাতন, রেহাই পায়নি শিশুরাও— অনেক শিশুকে মায়ের কোল থেকে কেড়ে নিয়ে পদ্মা নদীতে ছুড়ে ফেলা হয়। আট দশটি গ্রাম জ্বালিয়ে পুড়িয়ে দেওয়া হয়, হত্যা করা হয় কয়েকশো মানুষ। গাজিরটেক ইউনিয়নের রমেশবালাডাঙ্গি গ্রামের বাসিন্দা চারুবালার স্বামী সেদিন আরো তিনজনের সাথে অদূরে অন্যের ক্ষেতে শ্রমিক হিসেবে কাজ করছিলেন। পাকিস্তানি বাহিনী চারজনকেই গুলি করে হত্যা করে। চারুবালা চার মাসের শিশু সন্তান কোলে নিয়ে যাচ্ছিলেন স্বামীর খোঁজে। কিন্তু তিনে হায়েনাদের চোখ এড়িয়ে পৌঁছুতে পারেননি। মাঠের মধ্যে তার শিশু সন্তানটিকে ছুড়ে ফেলে দিয়ে পাকিস্তানি বাহিনীর কয়েকজন সদস্য তার উপর বর্বরভাবে নির্যাতন চালায়। জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন চারুবালা। চারুবালার মা তাকে বাড়িতে নিয়ে আসেন। শিশু সন্তানটি ততক্ষণে মারা গিয়েছে। স্বামী-সন্তান হারিয়ে চারুবালা পাগলপ্রায়। এখানেই শেষ নয়, এরপর তাকে সইতে হয়েছে নানান ধরনের লাঞ্চনা— ‘ধর্ষিতা’ হিসেবে এলাকার মানুষ চিনতে শুরু করে তাকে!
জীবিকার প্রয়োজনে তিনটি সন্তান নিয়ে তিনি দিশেহারা। না সরকার, না সমাজ, কেউই চারুবালার পাশে দাঁড়ায়নি কখনও । বাবার বাড়িতে কোনোমতে থাকার জায়গা হয়। মুড়ি ভেজে হাটে হাটে বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করতে থাকেন। যতটুকু আয় হয় তা দিয়ে চলে না। ছেলে মেয়ের পড়াশুনা তো অনেক দূরের কথা, প্রাণ বাঁচানোর বন্য সংগ্রামে লিপ্ত তখন দেশের দায়ে স্বামী-সন্তান হারানো বীরঙ্গনা চারুবালা। অভাবে অনাহারে অপুষ্ট তেরো চৌদ্দ বছরের ছেলেটিও একদিন মারা যায়। এভাবে বাকী দুই মেয়ের মধ্যে আরো একজন মারা যায় ‘জ্বর-সর্দি-কাশিতে’। কাঁদতে কাঁদতে চারুবালা বলেন, ছেলে মেয়েদের চিকিৎসা করানোর মতো সামার্থ আমার ছিল না। চোখের সামনে ওদের মরে যেতে দেখেছি, বাঁচানোর জন্য কিছুই করতে পারিনি আমি।
হাজিগঞ্জ বাজারে বসে কথা বলার পর আমরা গিয়েছিলাম পদ্মার চরে রমেশবালাডাঙ্গি গ্রামে। ফরিদপুর জেলার চরভদ্রাসন উপজেলার গাজিরটেক ইউনিয়ন এবং সদরের ডিক্রিরচর ইউনিয়নের কয়েকটি গ্রাম পদ্মায় বিলীন হয়ে গিয়েছিল পঁচিশ-ত্রিশ বছর আগে। প্রধানত এই গ্রামগুলোতেই পাকিস্তানি বাহিনী গণহত্যা চালিয়েছিল। অধিবাসীরা ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ায় এবং অনেকে ভারত চলে যাওয়ায় তাদের খুঁজে পাওয়া এখন খুব কষ্টসাধ্য। বিলীন হওয়া গ্রামগুলো পদ্মা শুকিয়ে আবার জেগে উঠেছে— বদলে গিয়েছে ভূমিরূপ— পদ্মার শাখা তৈরি হয়ে এলাকাটিকে খণ্ডিত করেছে ফরিদপুর সদর উপজেলা এবং চরভদ্রাসন উপজেলা থেকে। ফলে জেগে ওঠা গ্রামগুলো এখন বিচ্ছিন্ন একটি দ্বীপের মতো। সেখানেই অরক্ষিত অবস্থায় একটি খুপড়িতে বাস করেন শহীদ জায়া, শহীদ মাতা, বীরঙ্গনা চারুবালা!
এ দৃশ্য দেখে আমরা দু:খ পেয়েছি, বেশি পেয়েছি লজ্জ্বা! জামায়াতি বা হেফাজতি— যারা পাকিস্তানী বাহিনী সঙ্গে নিয়ে ১৯৭১ সালের নয় মাস এ ভূখণ্ডে বর্বর হত্যাকাণ্ড চালিয়েছিল, চারুবালাদের করেছিল স্বামী-সন্তানহারা, তাদের ভয়ে আবারও রাষ্ট্রযন্ত্র কাঁপছে। আবারও হয়ত ওরা প্রস্তুতি নিচ্ছে এরকম কোনো হত্যাকাণ্ডের। চারুবালাদের পাশে দাঁড়িয়ে বিক্ষুব্ধ, ক্রোধান্বিত হওয়া ছাড়া আরা কী’বা করতে পারি আমরা?

১৯৭১-এর গণহত্যায় স্বামী-সন্তান হারানো, পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর হাতে নির্যাতিতা চারুবালা-এর সাক্ষাৎকার নিয়েছেন গবেষক সাংবাদিক দিব্যেন্দু দ্বীপ এবং চরভদ্রাসনের সহকারী কমিশনার (ভূমি) ইমদাদুল হক তালুকদার (প্লাবন ইমদাদ)।