শহীদ কাজী আজিজুল হক। রাতের আকাশে অসংখ্য তারার মাঝে মিশে থাকা একটি উজ্জ্বল তারার নাম। পরিবারের বাইরে আজ আর কারো তাকে মনে আছে কিনা জানি না, তবে এই মহান শহীদের পরিবারের প্রত্যেকটি সদস্য তাদের জীবনের প্রতিটা মুহুর্ত বয়ে বেড়ায় এক সীমাহীন শূন্যতা। বরিশাল জেলার পূর্বেকার গৌরনদী থানা এবং বর্তমানের আগলঝাড়া উপজেলার ভালুকসি গ্রামের একটি সম্ভ্রান্ত পরিবারে তার জন্ম। এলাকায় বাড়িটি কাজী বাড়ি বলে পরিচিত। এই বাড়ির কাজী আফতাব উদ্দীনের নয় সন্তানের ভেতর চতুর্থ সন্তান জনাব কাজী আজিজুল হক। খুব ছেলেবেলায় মাকে হারিয়ে বৈমাত্রেয় ভাইবোনদের সাথেই বেড়ে ওঠা। এলাকার বার্থি হাইস্কুল থেকে ম্যাট্রিক পাশ করে গৌরনদীর একটি কলেজ থেকে আইকম পাশ করেন তিনি। এরপর চাকুরী জীবন। প্রথম জীবনে তিনি চাকরী করেন সেটলমেন্ট অফিসে। যশোর এলাকায় তিনি সেটেলমেন্ট অফিসার হিসাবে কাজ করেন। সেটলমেন্টে চাকুরীরত অবস্থায় ১৯৬৩ সালে তিনি বিয়ে করেন মহেশপুর উপজেলার খালিশপুরে সরকারী চাকুরীতে কর্মরত গফুর সরদারের বড় মেয়ে হামিদা বেগমকে। লেখাপড়ায় তখন পর্যন্ত স্কুলের গন্ডি না পেরোলেও পারিবারিক শিক্ষা এবং সংস্কৃতির প্রভাবে হামিদা বেগম ছিলেন একজন পরিশিলীত মননশীল মানুষ। বিয়ের বছর খানেক পরেই আজিজুল হক পেশা পাল্টান। সরকারি চাকরি ছেড়ে তিনি চাকরি নেন খুলনার কোকোনাট প্রসেসিং মিলে। হিসাবরক্ষক হিসাবে। ছাত্রজীবনে রাজনীতির সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত থাকা সত্বেও এতদিন কেবল সরকারি চাকরির কারণে রাজনীতির সাথে প্রত্যক্ষ কোনো সম্পর্ক রাখতে পারতেন না তিনি। এবার দূর হলো সেই বাধা। চাকরির পাশাপাশি আবার তিনি যোগ দিলেন সক্রিয় আওয়ামী রাজনীতিতে। চোখের সামনে তখন একটিই স্বপ্ন— স্বাধীনতা।
১৯৬৪ সালের দিকে খুলনার টুথপাড়ায় জোড়াকলের সামনে ঘোষের ভিটায় একটি ছোট্ট বাড়িতে শুরু হয় তাদের সংসার জীবন। এই বাড়িটাতে কাটে তাদের প্রায় চার বছর। দীর্ঘদেহী, প্রখর ব্যক্তিসম্পন্ন, সবসময় হাসিখুশি এই মানুষটির সংসার ছিল একটি স্বর্গরাজ্য। কাজী আজিজুল হক যে কোকোনাট প্রসেসিং মিলে চাকরি করতেন, তার মালিক ছিলেন একজন বাঙালি ভদ্রলোক। রপ্তানীযোগ্য পাপোষ, কাতা (নারকেলের ছোবড়া দিয়ে তৈরি এক প্রকার দড়ি) ইত্যাদি তৈরী হতো এই মিলে। ১৯৭০ এর দিকে মিলের ম্যানেজার এদেশ ছেড়ে চলে গেলে মিলের মালিক তার একান্ত বিশ্বাসভাজন কাজী আজিজুল হককে মিলের ম্যানেজারের দায়িত্ব প্রদান করেন। এই সময়ে তারা টুথপাড়ার বাড়ি ছেড়ে খুলনা শিপইয়ার্ড রোডে শিপইয়ার্ডের পাশে অবস্থিত কোকোনাট প্রসেসিং মিলের ভেতরে ম্যানেজারের বাংলোতে এসে ওঠেন।
১৯৭১ এর উত্তাল মার্চের প্রথম থেকেই প্রতিরোধের গনগনে আগুনে জ্বলছিল বৃহত্তর খুলনা যশোর অঞ্চল। জাতীয় সংসদের নির্ধারিত অধিবেশন স্থগিতের প্রতিবাদে দেশব্যাপী অসহযোগ আন্দোলনে একাত্বতা ঘোষনা করে এদেশের আপামর জনগোষ্ঠী। ২ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে উত্তোলিত হয় বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা। ৩ মার্চ ঘোষিত হয় বিক্ষোভ দিবস। দেশের অন্যান্য অঞ্চলের মতোই আন্দোলন, সমাবেশ, মিছিলে একেবারেই পিছিয়ে ছিল না খুলনা শহরের দেশপ্রেমী রাজনৈতিক কর্মী এবং সাধারণ নাগরিকরা। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে ৩ মার্চ সকালে বের হয় বিক্ষোভ মিছিল, যে মিছিলের সামনের সারিতেই ছিলেন কাজী আজিজুল হক। সেদিন এই বিক্ষোভ মিছিলের উত্তাপ টের পেয়েছিল পাকিস্তানী বেনিয়া শাসকগোষ্ঠী । আর তাই তারা চেয়েছিল বিক্ষোভের আগুন জ্বলে ওঠবার আগেই নিভিয়ে দিতে। বেলা ১০:৩০-১১:০০ টার দিকে খুলনা সার্কিট হাউজের কাছাকাছি আসতেই মিছিলে গুলি চালায় পাক হানাদার বাহিনী। বুকের বাম পাশে গুলি লেগে পাখির মতো মাটিতে লুটিয়ে পড়েন কাজী আজিজুল হক । এই মিছিলে গুলিবিদ্ধ হন আরো দুজন। ছত্রভঙ্গ মিছিল থেকে গুলিবিদ্ধ কাজী আজিজুল হককে হাসপাতালে নিতে নিতেই মহিমান্বিত মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন তিনি। একই মিছিলে উপস্থিত ছিলেন তার স্ত্রীর ছোট ভাই মুক্তিযোদ্ধা গোলাম রহমান, মিছিলের হট্টগোলে যিনি নিজেও শেষ মুহূর্তে থাকতে পারেননি তার প্রাণপ্রিয় আত্নীয়ের কাছে।
মৃত্যুর সময়ে কাজী আজিজুল হক রেখে যান অন্ত:সত্বা স্ত্রী এবং বয়সে খুবই কম ব্যবধানের চারটি শিশু সন্তান। আজিজুল হকের মৃত্যুর দুদিন পরেই খুলনার বাংলো থেকে এক কাপড়ে পালিয়ে আসেন তার স্ত্রী। এ সময়ে তার সাথে ছিল শুধুমাত্র ছেলে মেয়েরা আর শহীদ কাজী আজিজুল হকের শহীদ হওয়ার সময়ে পরিহিত রক্তমাখা সাদা হাওয়াই শার্ট আর ছাইরঙা প্যান্ট। হামিদা হক তার মৃত্যুর দিন পর্যন্ত এই মহামূল্যবান রক্তমাখা পোষাকগুলো যক্ষের ধনের মতো আগলে রেখেছিলেন। টুথপাড়া গোরস্তানে অত্যন্ত যেনতেনভাবে দাফন করা হয় শহীদের মৃতদেহ। এই কবরটিকেও পরবর্তীতে আর চিহ্নিত করা যায়নি। কাজী আজিজুল হকের রেখে যাওয়া সন্তানদের ভেতরে চতুর্থ সন্তানটি পরবর্তীতে খাদ্য ও চিকিৎসার অভাবে মারা যায়। তার মৃত্যু হয় গরুর গাড়িতে চেপে যখন শহীদের স্ত্রী এক গ্রাম থেকে আর এক গ্রামে পালাচ্ছিলেন, তেমনি এক করুণ মুহূর্তে। কাজী আজিজুল হক ছিলেন খুলনার তৎকালীন আওয়ামী লীগ নেতা শেখ আব্দুল আজিজের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ, স্বাধীনতার পরে যিনি সরকারের কৃষি মন্ত্রী হয়েছিলেন। তারই ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় খুলনা শিপইয়ার্ড রাস্তাটি (দাদাভাই ম্যাচ ফ্যাক্টরির সামনের রাস্তা) শহীদ আজিজ সড়ক নামে নামকরণ করা হলেও বর্তমানে খুলনা জেলার মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কিত বিভিন্ন ইতিহাস থেকে এই সাহসী বীর শহীদের নামটি প্রায় হারিয়ে যেতে বসেছে।