গণহত্যা-১৯৭১: প্রত্যক্ষদর্শীর ভাষ্য

Sunil Ghosh Pintu

সিরাজদিখানের রসুইন গ্রামে রামকৃষ্ণ সিংহের বাড়িতে ১৯৭১ সালে সংগঠিত গণহত্যার ভুক্তভোগী এবং প্রত্যক্ষদর্শী

সুনীল ঘোষ পিন্টু

পিতা: শহীদ জীবন ঘোষ

ঠিকানা: ২৪ ফরাশগঞ্জ লেন, সূত্রাপুর, ঢাকা-১১০০।

শহীদ জীবন ঘোষ সূত্রাপুর
শহীদ জীবন ঘোষ

জীবন ঘোষের পরিবার মালাকারটোল হত্যাকাণ্ড সংগঠনের দিন এলাকা ছেড়ে নদীর ওপার বিক্রমপুরের দিকে চলে যান। রসুইন গ্রামের যে বাড়িতে জীবন ঘোষের পরিবার আশ্রয় নিয়েছিল সে বাড়িতে হামলা হয়। হামলায় জীবন ঘোষ এবং বাড়ির মালিক রামকৃষ্ণ সিংহসহ তোরোজন মারা যান। ভাগ্যক্রমে বেঁচে যান জীবন ঘোষের জ্যোষ্ঠ সন্তান সুনীল ঘোষ। তিনি ঘটনা সম্পর্কে বলেন-

বুড়িগঙ্গা পার হয়ে আমরা ওপার গেলাম। আমার তখন পাঁচ সন্তানের পিতা। যেহেতু আমরা অনেক লোক, দুটি নৌকা নিতে হয়েছিল। আমার নৌকায় হামলা হয়েছিল, আমি ঝাপ দিয়ে বেঁচে গিয়েছিলাম।

এরপর আমরা চলে গেলাম বাগড়। বাগড় থেকে আমরা জিঞ্জিরা আক্রমণের খবর পেয়েছিলাম। বাগড়ে দশ বারোদিন ছিলাম, ওখানে যাদের বাড়িতে ছিলাম ওরা বলল, পাক বাহিনী খবর পেয়েছে, আপনাদের ওপর হামলা হতে পাওর, আপনারা চলে যান।

এরপর আমরা সিরাজদিখানের রসুইন গ্রামে রামসিংহ জমিদারের বাড়িতে উঠি। ওখানে আরো লোক আশ্রয় নিয়েছিল। ঢাকায় আমরা এখন যে বাড়িতে আছি এটাও ওনাদের বাড়ি ছিল। আমার বাবাকে অল্প পয়শায় এই বাড়িটা দিয়েছিলেন।

রাতে রামসিংহের বাড়িতে হামলা হয়, ওখানে আমরা চৌদ্দজন পুরুষ ছিলাম, তার মধ্যে শুধু আমি বেঁচে যাই, আমার বাবা তখনই মারা যান। আমি যখন লাশগুলোর মধ্য থেকে বের হলাম সে এক বিভৎস চেহারা, আমার স্ত্রীকে বললাম, আমাকে এভাবে দেখলে ওরা (সন্তানেরা) ভয় পাবে, তুমি একটা কাপড় দাও। চাদর দিয়ে জড়ায়ে রাখলাম, তখন গ্রামের মানুষ চিকিৎসার জন্য অদূরের এক খ্রিস্টান চার্চে আমাকে নিয়ে যায়।

বুঝলাম, এখানো কোনোভাবেই আর থাকা যাবে না। এরপর রামচন্দ্রপুর দিয়ে নৌকা পথে বের হয়ে আগরতলায় পৌঁছালাম। ভারতে গিয়ে শরণার্থী শিবিরে ছিলাম।

ডিসেম্বর মাসে দেশে ফেরার আগে আমি যশোর সীমান্ত দিয়ে এসে অবস্থা দেখে গেছিলাম। তখন তো বর্ডার ওপেন ছিল, ইচ্ছা করলেই আসা গেছিল। পরে পরিবার নিয়ে এই বাড়িতেই ফিরে আসি। বাড়িতে এসে কিছুই পাইনি, শুধু ফাঁকা বাড়ি।

দেশে এসেও আমাকে চিকিৎসা নিতে হয়েছিল। দীর্ঘদিন আমি আহত হয়ে ছিলাম, ঢাকা মেডিকেলে প্রফেসর আলি আক্তারের কাছে অপারেশন করেছিলাম। দেশ স্বাধীন হওয়ার আগেই আমরা চলে এসেছিলাম।

বাড়িতে তখন বিহারীরা ছিল। যেহেতু তখন দেশ স্বাধীন হয়ে যাচ্ছিল, ওরা চলে যেতে চাইছিল। এলাকার মুসলিম প্রতিবেশীরা বাড়িতে উঠতে আমাদের খুব সহযোগিতা করেছিল।

পেশা হিসেবে আমি বাবার মিষ্টির দোকানটা চালাতে শুরু করি। আশির দশকে দোকানটি বিক্রী করে দিই। তারপর সন্তানরা বড় হয়েছে, ওরা এখন সংসার চালায়, বয়স হয়েছে, আমি এখন আর কিছু করি না।