Headlines

একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনঃ জাতীয় ও আঞ্চলিক নিরাপত্তা

প্রাণতোষ তালুকদার

২৬ জুলাই বৃহস্পতিবার ‘একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন: জাতীয় ও আঞ্চলিক নিরাপত্তা’ শীর্ষক আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয় রাজধানীর ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন মিলনায়তনের সেমিনার কক্ষে। একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি এ আলোচনা সভার আয়োজন করে।

উক্ত আলোচনা সভায় প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মাননীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী জনাব আসাদুজ্জামান খাঁন এমপি। তিনি বলেন, আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বলেছেন জনগণের ইচ্ছা এবং আকাঙক্ষা নিয়েই আমরা কাজ করি, জনগণকে নিয়ে কাজ করব, আমরা সেইজন্যই আমরা জনগণের সমর্থন নিয়ে আমরা আজকে দেশ পরিচালনা করছি, সেইজন্যেই আমরা এই উন্নয়নের মহাসড়কে উপস্থিত হয়েছি। যদি আমাদেরকে জনগণ সহযোগিতা না করত, সমর্থন না দিত, এই উন্নয়ন আমরা করতে পারতাম না। এদেশের জনগণ দেশকে ভালোবাসে।
তিনি আরও বলেন আঞ্চলিক নিরাপত্তার কথা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী সব সময়ই জানিয়ে আসছেন; যার জমি নাই তাদেরকেও থাকতে দিবেন। এবং দিয়েছেন এবং বলেছেন কোনদিন জঙ্গীবাদকে এদেশে আশ্রয়-প্রশ্রয় দেওয়া হয় না, দিবেনও না। এবং যতদিন শেখ হাসিনার নেতৃত্বে সরকার থাকবে ততদিন আমাদের দেশে কোনো জঙ্গীবাদ, কোনো সন্ত্রাসী আমাদের দেশে আশ্রয়-প্রশ্রয় পাবে না। এবং আগামীতে একটি সুষ্ঠু ও সুন্দর নির্বাচন হবে বলে জানান তিনি। লক্ষ লক্ষ রেহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মানবতা দেখিয়ে আশ্রয় দিয়েছেন এবং তাঁরা যাতে বার্মায় আবার ফেরত যাইতে পারে, তার জন্য চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। মোট কথা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশকে উন্নয়নের পথে এগিয়ে নিচ্ছেন। আগামীতেও যাতে আওয়ামীলীগ সরকার টিকে থাকে, তাহলে এদেশটির আরও উন্নয়ন হবে, জনগণ নিরাপদে থাকবে। একমাত্র শেখ হাসিনার নেতৃত্বে দেশ নিরাপদ থাকবে, সুষ্ঠু ও সুন্দর থাকবে। দেশের আরও উন্নয়ন হবে।

একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সভাপতি লেখক, সাংবাদিক শাহরিয়ার কবির বলেন, ধর্ম যখন রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হয় তখন তার প্রধান অনুষঙ্গ হয় গণতন্ত্রহীনতা ও অসহিষ্ণুতা, যার অনিবার্য পরিণতি হচ্ছে সংঘাত ও সন্ত্রাস। গত শতাব্দীতে রাজনৈতিক ইসলামের তিন প্রধান তাত্ত্বিক মিশরের ‘ইখওয়ানুল মুসলেমীনে’র হাসান আল বান্না ও সাঈদ কুত্ব্ এবং অখন্ড ভারতবর্ষ ‘জামায়াতে ইসলামী’র প্রতিষ্ঠাতা আবুল আলা মওদুদি ধর্মরাজ্য প্রতিষ্ঠার জন্য যাবতীয় হত্যা, সন্ত্রাস ও ধ্বংসযজ্ঞকে বৈধতা দিয়েছেন; যার চূড়ান্ত রূপ আমরা প্রত্যক্ষ করেছি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে। পাকিস্তানি সামরিক জান্তা এবং তাদের প্রধান রাজনৈতিক ও আদর্শিক মিত্র জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশে গণহত্যা ও নারী নির্যাতন সহ যাবতীয় মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটিত করেছে পাকিস্তানের অখন্ডতা ও ইসলাম রক্ষার দোহাই দিয়ে। বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধা এবং মুক্তিকামী সাধারণ মানুষকে তারা হত্যা করেছে ‘দুষ্কৃতকারী’, ‘পাকিস্তানের দুষমন’, ‘ইসলামের দুষমন’, ‘ভারতের এজেন্ট’ ইত্যাদি আখ্যা দিয়ে। জামায়াতের এই রাজনীতি, রণনীতি ও রণকৌশল এখনও অক্ষুণœ রয়েছে।
তিনি বলেন, শুধু ৩০ লক্ষ বাঙালি নয়, মুক্তিযুদ্ধের পর জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নৃশংস হত্যাকান্ড থেকে আরম্ভ করে গত চার দশকের অধিক কাল মুক্তিযুদ্ধের চেতনার অনুসারী রাজনৈতিক নেতা, বুদ্ধিজীবী, পেশাজীবী, সংস্কৃতিকর্মী এবং সাম্প্রতিকালে ‘নাস্তিক’ আখ্যা দিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের তরুণ লেখক ও অনলাইন অ্যাক্টিভিস্টদের যাবতীয় হত্যাকান্ড এই রাজনীতিরই অন্তর্গত। ধর্মের নামে এসব হত্যা, সন্ত্রাস ও মানবতাবিরোধী অপরাধ নির্মূূলের পাশাপাশি ধর্মের পবিত্রতা রক্ষার জন্য বঙ্গবন্ধু স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সংবিধানে ধর্মের নামে রাজনীতি নিষিদ্ধ করেছিলেন। বঙ্গবন্ধু এবং তাঁর সহযোগীদের হত্যা না করে বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জেনারেল জিয়াউর রহমান ধর্মের নামে রাজনীতি ও সন্ত্রাস বাংলাদেশ পুনঃপ্রবর্তন করতে পারতেন না।
তিনি বলেন পৃথিবীর অন্য কোনও দেশে সরকার পরিবর্তন হলে রাষ্ট্রের চরিত্র বদলে যায় না। আমেরিকা থেকে আরম্ভ করে প্রতিবেশি ভারত ও পাকিস্তানের দিকেও যদি তাকাইÑসরকার বদল হলেও রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ বা বৈদেশিক নীতির ক্ষেত্রে কোনও মৌলিক পরির্তন ঘটে না। কারণ পৃথিবীর কোনও দেশে এমন কোনও দলকে রাজনীতি করতে দেয়া হয় না যারা রাষ্ট্রের স্বাধীনতার বিরোধিতা করে, কিংবা সংবিধানের মূলনীতির পরিপন্থী কাজ করে। বাংলাদেশ এ ক্ষেত্রে এক বিস্ময়কর ব্যতিক্রম। এখানে মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষ শক্তি শুধু রাজনীতিই করে না, স্বাধীন বাংলাদেশের গত ৪৭ বছরের ইতিহাসে অধিকাংশ সময় তারাই প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে ক্ষমতায় ছিল। বাংলাদেশের এই বিচিত্র চরিত্র নিয়ে মুনতাসীর মামুনের দুই বই আছে, একটির শিরোনামÑ‘সব সম্ভবের দেশ’, অপরটি ‘যে দেশে রাজাকার বড়।’
তিনি বলেন ২০১৪ সালের এপ্রিলে পাকিস্তানের লাহোরে জামায়াতে ইসলামীর প্রতিষ্ঠাতা আবুল আলা মওদুদির পুত্র বিশিষ্ট ইসলামী চিন্তাবিদ হায়দার ফারুখ মওদুদি আলোচনা প্রসঙ্গে শাহরিয়ার কবিরকে বলেছিলেন, ‘বাংলাদেশে জামায়াত ইসলামীর কোনও রাজনৈতিক অধিকার থাকতে পারে না। বাংলাদেশের রাজনীতিতে জামায়াত হচ্ছে জারজ সন্তান। কারণ এই দলটি বাংলাদেশের জন্মের বিরোধিতা করেছে। জারজ সন্তান যেমন পিতার সম্পত্তির উত্তরাধিকার হতে পারে না তেমনি জামায়াতও বাংলাদেশে রাজনীতি করতে পারে না। শেখ হাসিনাকে বলুন দ্রুত এদের নিষিদ্ধ করতে। নাহলে তারা বাংলাদেশের সর্বনাশ করবে।’ লেখক, সাংবাদিক শাহরিয়ার কবির তার কাছে জানতে চেয়েছিলেন, ‘দল নিষিদ্ধ করলে জামায়াতের কর্মীরা কী করবে, কোথায় যাবে?’ হায়দার ফারুখ বলেছেন, ‘তারা মানুষের খেদমত করবে, কৃতকর্মের জন্য বাংলাদেশের মানুষ এবং আল্লাহর কাছে মাফ চাইবে। বাংলাদেশের মানুষ যদি তাদের মাফ না করে স্বয়ং আল্লাহও তাদের মাফ করবেন না।
একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সভাপতি লেখক, সাংবাদিক শাহরিয়ার কবির বলেন মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় ধর্মনিরপেক্ষ, মানবিক ও মর্যাদাসম্পন্ন রাষ্ট্র ও সমাজ প্রতিষ্ঠা এবং জামায়াতের মতো ফ্যাসিস্ট মৌলবাদী, সাম্প্রদায়িক দলের রাজনীতি নিষিদ্ধকরণের জন্য একাত্তরের ঘাতক দালাল নিমর্ূূল কমিটি গত ২৭ বছর ধরে আন্দোলন করছেন। নির্মূল কমিটির আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় বঙ্গবন্ধুর কন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষ শক্তি ক্ষমতায় এসেছে, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার আরম্ভ হয়েছে, অবহেলিত, লাঞ্ছিত মুক্তিযোদ্ধারা হৃত গৌরব ফিরে পেয়েছেন এবং মুক্তিযুদ্ধে নির্যাতিত নারীদের মুক্তিযোদ্ধার মর্যাদা প্রদান করা হয়েছে। বর্তমান সরকারের আমলে আর্থ-সামাজিক উন্নয়নেরর উজ্জ্বল উদাহরণ হিসেবে বাংলাদেশে সমগ্র বিশ্বের মনোযোগ আকর্ষণ করেছে। জলে-স্থলে-অন্তরীক্ষে সীমানা প্রসারিত করার পাশাপাশি আমাদের সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়েছেÑযা বানচাল করার জন্য মুক্তিযুদ্ধের চিহ্নিত শত্রু এবং তাদের সহযোগীরা বহুমাত্রিক ষড়যন্ত্র ও তৎপরতা রেখেছে। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ও চেতনার বিরুদ্ধে বিএনপি-জামায়াতের বিভিন্ন কার্যক্রম বাংলাদেশের জাতীয় নিরাপত্তা ব্যবস্থাকে দুর্বল করছে।
তিনি বলেন ২০০১ সালে বিএনপি-জামায়াত জোট ক্ষমতায় আসার পর সাম্প্রদায়িক সহিংসতার পাশাপাশি জঙ্গী মৌলবাদী সন্ত্রাসের ভয়াবহ উত্থানের কারণে জাতীয় নিরাপত্তার পাশাপাশি আঞ্চলিক নিরাপত্তাও বিপণœ হয়েছিল। ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের উপর নজিরবিহীন নির্যাতনের কারণে ২০০১ সালে নির্বাচনের পর প্রায় ৩ লক্ষ হিন্দু প্রতিবেশী ভারতে চলে যেতে বাধ্য হয়েছিল। বিএনপি-জামায়াতের জোট সরকার উত্তর-পূর্ব ভারতের বিচ্ছিন্নতাবাদী ও সন্ত্রাসীদের জন্য বাংলাদেশের সীমান্ত উন্মুক্ত করে দিয়েছিল। ২০০১ সালের অক্টোবরে ভয়ঙ্কর সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাসের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসার পর উত্তরপুর্ব ভারতের দুটি বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন খালেদা জিয়ার সরকারকে অভিনন্দন জানিয়ে বলেছিলেনÑ শেখ হাসিনা তাদের সন্ত্রাসী মনে করেন, পক্ষান্তরে খালেদা জিয়া মনে করেন তারা স্বাধীনতাকামী। এভাবে বিএনপি-জামায়াত জোট বার বার বাংলাদেশের জনগণের নিরাপত্তা ও রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার পাশাপাশি দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক নিরাপত্তা বিপন্ন করেছে।
তিনি বলেন যে কোনও দেশের জাতীয় নিরাপত্তা ব্যবস্থা যত দুর্বল হয় সে দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন ব্যহত হওয়ার পাশাপাশি জননিরাপত্তাও বিপন্ন হয় এবং স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব হুমকির ভেতর থাকে। বিএনপি-জামায়াত জোর সরকারের আমলে ১২৫টি জঙ্গী মৌলবাদী সন্ত্রাসী সংগঠনের তালিকা আমরা প্রকাশ করেছিলাম। জামাতুল মুজাহিদীনের শীর্ষ নেতা, শীর্ষ মৌলবাদী সন্ত্রাসী সিদ্দিকুর রহমান ওরফে বাংলা ভাই নওগাঁয় শরিয়া আদালত বসিয়ে যখন নিরীহ মানুষ ও আওয়ামী লীগের কর্মী-সমর্থকদের হত্যা ও নির্যাতন করছিল তখন তার অস্তিত্ব অস্বীকার করে খালেদা জিয়ার মন্ত্রিসভার প্রভাবশালী সদস্য জামায়াতের আমীর মতিউর রহমান নিজামী বলেছিলেন, ‘বাংলা ভাই’ নাকি ‘মিডিয়া সৃষ্ট কাল্পনিক চরিত্র’। এরপর আমেরিকার সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ক্রিস্টিনা রোকা বাংলাদেশে এসে নিজামীর কাছে রসিকতা করে জানতে চেয়েছিলেন, আপনার বাংলা ভাই-এর খবর কী? (ডযধঃ ধনড়ঁঃ ুড়ঁৎ ইধহমষধ ইযধর?)। খালেদা জিয়ার বিএনপি-জামায়াত জোট যদি দ্বিতীয়বার ক্ষমতায় থাকত জঙ্গী দমনের নামে আমেরিকা এতদিনে ঘাঁটি গেঁড়ে বাংলাদেশকে ইরাকের মতো গোরস্থানে পরিণত করত। জঙ্গী মৌলবাদী সন্ত্রাসের ঘটনা বর্তমান সরকারের আমলেও ঘটেছে। তবে এসব ঘটনার জন্য কারা দায়ী দেরেশর মানুষ যেমন জানে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ও জানে। শেখ হাসিনার মহাজোট সরকার যেভাবে জঙ্গীদমন করেছে, তা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দ্বারা বিশেষভাবে প্রশংসিত হয়েছে।
শাহরিয়ার কবির বলেন, বর্তমান সরকারের সময়কালের সঙ্গে আমরা যদি বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের শাসনামল তুলনা করিÑযে কোনও বিবেচনায় তখন আমাদের জাতীয় নিরাপত্তার পাশাপাশি দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক নিরাপত্তাব্যবস্থা ছিল অত্যন্ত দুর্বল। এক্ষেত্রে আরেকটি বিষয় প্রণিধানযোগ্য। একটি দেশ যত বেশি সমৃদ্ধির পথে অগ্রসর হবেÑজাতীয় ও আঞ্চলিক নিরাপত্তার বিষয়টি তত বেশি গুরুত্ব পাবে। আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের সময় লক্ষ্য রাখতে হয় জাতীয় নিরাপত্তার সঙ্গে সম্পর্কিত সকল ক্ষেত্রে একইভাবে উন্নয়ন হচ্ছে কিনা। ৩০ লক্ষ শহীদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় নীতি, সার্বিক উন্নয়ন এবং জাতীয় নিরাপত্তার বিষয়টি নিশ্চিত করেছিল বঙ্গবন্ধুর সংবিধান। আলোকাভিসারী একটি দেশ ও জাতিকে লক্ষুচ্যুত করার জন্য এই সংবিধানের আমূল পরিবর্তন জরুরি ছিল, যে কাজটি জেনারেল জিয়া অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে করেছেন। সংবিধান এমন কোনও দলিল বা ধর্মগ্রন্থ নয় যে, কখনও তা সংশোধন করা যাবে না। কীভাবে তা করা যাবে তা এই দলিলেই বলা হয়েছে। জেনারেল জিয়া ক্ষমতা দখল করেছিলেন অসাংবিধানিকভাবে, যে বিষয়ে খালেদা জিয়ার আমলেই সর্বোচ্চ আদালতের রায়ে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে। যৌক্তিক কারণেই জেনারেল জিয়া এবং তার উত্তরাধিকারীদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সংবিধানের প্রতি কোনও দায়বদ্ধতা থাকতে পারে না।
লেখক, সাংবাদিক শাহরিয়ার কবির বলেন, জেনারেল জিয়ার আমল থেকে বাংলাদেশের সমাজ ও রাজনীতির মৌলবাদীকরণ ও সাম্প্রদায়িকীকরণ জাতীয় নিরাপত্তা ব্যবস্থাকে ক্রমশঃ দুর্বল থেকে দুর্বলতর করেছে, যার চূড়ান্ত রূপ আমরা প্রত্যক্ষ করেছি ২০০১Ñ২০০৬ সালে বিএনপি-জামায়াত জোটের জমানায়। আগামী নির্বাচনে তরুণ নির্বাচকমন্ডলীÑযারা মুক্তিযুদ্ধ দেখেননি, বেড়ে উঠেছেন এক অন্ধকার সময়ে, অথচ দেশকে ভালবাসেন, মানুষকে ভালবাসেন, বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবে গর্ব অনুভব করতে চান, দেশ ও সমাজ গঠনে অবদান রাখতে চানÑবাংলাদেশের সার্বিক নিরাপত্তার বিষয়গুলো তাদের বিশেষভাবে বিবেচনা করতে হবে।

আলোচনা সভায় উপস্থিত অন্যান্য বক্তারা বলেন, ১৯৯৪ সালের ২৬ জুলাই চট্টগ্রামের জামায়াতে ইসলামী দলের তৎকালীন আমীর ’৭১-এর শীর্ষস্থানীয় যুদ্ধাপরাধী গোলাম আযমকে চট্টগ্রামে আনার জন্য এক জনসভার আয়োজন করেছিল। এর আগে ২৩ জুন (১৯৯৪) পাকিস্তানি নাগরিক গোলাম আযমকে বিএনপি সরকারের হাইকোর্ট নাগরিকত্ব প্রদান করেছিল। নাগরিকত্ব প্রাপ্তি উদযাপন করার জন্য গোলাম আযম চট্টগ্রাম থেকে আত্মপ্রকাশের অভিযান আরম্ভ করতে চেয়েছিল। চট্টগ্রামের ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন ও ‘একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল জাতীয় সমন্বয় কমিটি’ ঘাতক গোলাম আযমের জনসভা প্রতিহত করার ঘোষণা দিয়েছিল। এই দিন জাতীয় সমন্বয় কমিটি এক বিক্ষোভ মিছিলের আয়োজন করেছিল। জামায়াত-শিবিরের ঘাতকরা রাইফেল ও মেশিনগান নিয়ে সেই মিছিলে গুলীবর্ষণ করে, যার ফলে ছাত্রলীগের মুনির, টিটো ও বাদল সহ ৫ জন তরুণ সেদিন শহীদ হন, আহত হন শতাধিক মিছিলকারী। যুক্তিসঙ্গত কারণেই মিছিলের নিরস্ত্র মানুষের উপর ঘাতক জামায়াত-শিবির চক্রের নৃশংস হামালা ও ছাত্রহত্যার ঘটনায় জামায়াতের প্রতি সাধারণ মানুষের ঘৃণা আরও তীব্র হয়েছে।
বক্তারা আরও বলেন, স্বাধীন বাংলাদেশ আত্মপ্রকাশের পর থেকে জামায়াত-শিবিরের ঘাতকদের ধারাবাহিক হত্যা ও সন্ত্রাসী কর্মকা- ’৭১-এর যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিকে আরও জোরদার করেছে। ধর্মের নামে হত্যা, নির্যাতন, সন্ত্রাস ও বোমাবাজির রাজনীতি অনুমোদন করলে অন্তিমে তা ’৭১-এর ভয়াবহ গণহত্যা ও মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের জন্ম দেয়। একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি প্রতিবছর ২৬ জুলাই চট্টগ্রামের পাঁচ শহীদের স্মরণে সারাদেশে আলোচনা সভার আয়োজন করে থাকেন।
আলোচনা হয়– ১৯৭৫ সালে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নৃশংস হত্যাকান্ডের পর বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জেনারেল জিয়াউর রহমান অবৈধভাবে ক্ষমতা দখল করেন। পাকিস্তানের সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই এর নীল নকশা অনুযায়ী সাবেক আইএসআই কর্মকর্তা জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় এসেই সংবিধান ও সরকারি বয়ান থেকে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ও চেতনা মুছে ফেলে বাংলাদেশের সমাজ ও রাজনীতির মৌলবাদীকরণ, সাম্প্রদায়িকীকরণ ও পাকিস্তানিকরণ আরম্ভ করেছিলেন, যার পরিণাম এখনও আমাদের ভোগ করতে হচ্ছে।
বঙ্গবন্ধুর সংবিধান থেকে ধর্মের নামে রাজনীতির উপর নিষেধাজ্ঞা বাতিল করে জিয়াউর রহমান নিষিদ্ধঘোষিত জামায়াতে ইসলামী এবং তাদের সহযোগী ’৭১-এর ঘাতক দালালদের বাংলাদেশের রাজনীতিতে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করেছেন। তার যোগ্য উত্তরসূরী দুর্নীতির দায়ে সাজাপ্রাপ্ত বিএনপি প্রধান বেগম খালেদা জিয়া জামায়াতের শীর্ষস্থানীয় যুদ্ধাপরাধীদের মন্ত্রী এবং ক্ষমতার অংশীদার বানিয়ে ৩০ লক্ষ শহীদের আত্মদান উপহাসের পাশাপাশি বাংলাদেশের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির উজ্জ্বল ঐতিহ্য বিনষ্ট করেছিলেন।
অতীতের মতো বিএনপি-জামায়াত জোট আগামী নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বহুমাত্রিক ষড়যন্ত্র আরম্ভ করেছে, যার কিছু গণমাধ্যমও প্রকাশিত হয়েছে। একাদশ সংসদ নির্বাচনের প্রস্তুতি গ্রহণকালে প্রশান ও এবং নির্বাচন কমিশনকে জাতীয় ও আঞ্চলিক নিরাপত্তার জন্য হুমকি স্বরূপ জামায়াত-বিএনপির যাবতীয় ষড়যন্ত্র সম্পর্কে সতর্ক থাকতে হবে।

বাংলাদেশ সম্মিলিত ইসলামী জোটের সভাপতি হাফেজ মওলানা জিয়াউল হাসান বলেন এদেশ ৩০ লক্ষ শহীদের রক্তের বিনিময়ে স্বাধীন হয়েছে। এবং আমরা একটি স্বাধীন বাংলাদেশ পেয়েছি। আমাদের জাতীয় সঙ্গীত ও জাতীয় পতাকা প্রত্যেকটি মাদ্রাসায় এবং ইসলামী বিদ্যালয়গুলিতে রীতিমত জাতীয় সঙ্গীত গাওয়া হয় কিনা ও জাতীয় পতাকা টাঙানো হয় কিনা শিক্ষামন্ত্রণালয়কে লক্ষ্য রাখার অনুরোধ করেছেন। হিন্দু নেতৃবৃন্দও বলেছেন যে এদেশের সকল মানুষ সাম্প্রদায়িকতা ভুলে, অসাম্প্রদায়িক হোক ও শান্তিতে সকল ধর্মের মানুষ যেন বসবাস করতে পারে এবং বিশেষ করে হিন্দু-সংখ্যালঘুগণ বেশি নির্যাতিত হয়। আর যাতে ভবিষ্যতে নির্যাতিত না হয়, সেই দিকে সকলকে লক্ষ্য রাখার অনুরোধ করেছেন।
আলোচনা সভায় বক্তব্য প্রদান করেন প্রধান অতিথি জনাব আসাদুজ্জামান খাঁন এমপি (মাননীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার), একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সভাপতি লেখক সাংবাদিক শাহরিয়ার কবির, ইন্সটিটিউট অব কনফ্লিক্ট, ল’ এ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ-র চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল মোহাম্মদ আব্দুর রশীদ (অব.), রিজিওনাল এন্টি টেররিস্ট রিসার্চ ইন্সটিটিউড-র নির্বাহী পরিচালক মেজর জেনারেল একে মোহাম্মদ আলী শিকদার (অব.), বাংলাদেশ সম্মিলিত ইসলামী জোটের সভাপতি হাফেজ মওলানা জিয়াউল হাসান, শ্রী শ্রী প্রণব মঠের অধ্যক্ষ শ্রীমৎ স্বামী সঙ্গীতানন্দজী মহারাজ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশ্ব ধর্ম ও সংস্কৃতি বিভাগের চেয়ারম্যান ফাদার ড. তপন ডি রোজারিও, বাংলাদেশ বুড্ডিস্ট ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক ভিক্ষু সুনন্দপ্রিয় প্রমুখ। এবং পরিশেষে সভায় সভাপতিত্ব করেন নির্মূল কমিটির অন্যতম উপদেষ্টা বিচারপতি শামসুদ্দীন চৌধুরী মানিক।